বুয়েট ছাত্র ফারদিন নূর পরশের ‘আত্মহত্যা’র বিষয়ে খোলাখুলি জানতে র্যাব কর্মকর্তাদের সঙ্গে তিন ঘণ্টা বৈঠক করেছেন ফারদিনের সহপাঠীরা; তবে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের বিস্তারিত কিছু জানাননি তারা।
শুক্রবার বিকাল পৌনে ৪টার দিকে র্যাব সদর দপ্তরে যান ফারদিনের ২০ সহপাঠী; সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত তারা বৈঠক করেন।
পরে র্যাব কার্যালয় থেকে বের হতেই সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়েন তারা। সাংবাদিকরা জানতে চান- ফারদিনের ‘আত্মহত্যা’ নিয়ে র্যাবের ব্যাখ্যার সঙ্গে তারা একমত হতে পেরেছে কিনা।
জবাবে শিক্ষার্থীরা বলেন, র্যাব কর্মকর্তারা তাদের সামনে মামলার প্রাপ্ত তথ্য ও আলামতগুলো প্রেজেন্টেশন আকারে তুলে ধরেছেন। অস্পষ্টতার বিষয়গুলো কর্মকর্তারা ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
সেই ব্যাখ্যা তাদের কাছে যৌক্তিক মনে হয়েছে কিনা- এমন প্রশ্নে তারা জানান, বুয়েটে ফিরে সবার সঙ্গে কথা বলে তারা সিদ্ধান্ত নেবেন। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
গত বুধবার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, ফারদিন ডেমরা সেতু থেকে ঝাঁপ দিয়ে ‘আত্মহত্যা’ করেছেন। তাৎক্ষণিকভাবে এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে বৃহস্পতিবার বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা দেয় ফারদিনের সহপাঠীরা।
তবে ওই কর্মসূচির আগে ডিবি কার্যালয়ে তাদের ডাক পড়ে। ফারদিনের মৃত্যু নিয়ে সবকিছু খোলাখুলি জানানোর প্রস্তাব আসে ডিবির পক্ষ থেকে।
বৃহস্পতিবার ডিবি কার্যালয়ে গিয়ে প্রায় তিন ঘণ্টা বৈঠকের পর শিক্ষার্থীরা সাংবাদিকদের জানান, ডিবির ভাষ্য ও আলামত গুলো তাদের কাছে ‘যৌক্তিক’ মনে হয়েছে। তবে কিছু অস্পষ্টতাও রয়ে গেছে।
ডিবির সঙ্গে বৈঠকের পর র্যাব সদর দপ্তরেও শিক্ষার্থীদের ডাকা হয়। শুক্রবার র্যাবের সঙ্গে আলোচনার পর শিক্ষার্থীরা জানান, তারা এখানে কিছু বলতে চান না। বুয়েটে গিয়ে সব শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার পর তারা তাদের মতামত গণমাধ্যমে জানাবেন।
গত ৪ নভেম্বর রাতে নিখোঁজ হওয়ার পর ৭ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল থেকে বুয়েটছাত্র ফারদিনের (২৪) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
পরদিন ময়নাতদন্তে হত্যার আলামত পাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন চিকিৎসক। তিনি মাদক কারবারিদের হাতে খুন হয়েছেন বলেও সংবাদ মাধ্যমে খবর এসেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বরাতে।
তদন্ত নিয়ে পরিবার ও সহপাঠীদের হতাশার মধ্যে র্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশ বুধবার হঠাৎ করেই জানায়, ওই তরুণ আত্মহত্যা করেছিলেন বলে তারা এখন ধারণা করছেন।
ফারদিনের মৃত্যুর ঘটনাটির তদন্তভার গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাতে, পাশাপাশি ছায়া তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছিল র্যাব। এর আগে দুই সংস্থার ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যে বিভ্রান্তি ছড়ালেও বুধবার একই উপসংহারে পৌঁছায় র্যাব ও ডিবি।
দুই পক্ষই বলেছে, নিখোঁজ হওয়ার দিন ভোররাতে ডেমরার সুলতানা কামাল সেতু থেকে শীতলক্ষ্যা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ফারদিন।
গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়া এবং বিদেশ যেতে অর্থ জোগাড় করতে না পারার হতাশা থেকে ওই তরুণ আত্মহননের পথ বেছে নেন।
তবে সহপাঠী আর স্বজনরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওই নতুন ব্যাখ্যায় প্রথমে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। ফারদিন আত্মহত্যা করেছেন– এটা মানতে নারাজ ছিলেন তার সহপাঠীরা।
কিন্তু বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন ফারদিনের সহপাঠীরা। আগে হত্যা বললেও এখন পুলিশ কেন ‘আত্মহত্যা’ বলছে, সেই প্রমাণ দেখতে তারা ডিবি কার্যালয়ে যান।
বৈঠক শেষে শিক্ষার্থীদের পক্ষে তাহমিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “আলামতগুলো তারা আমাদের দেখিয়েছেন। আলামতগুলো আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়েছে। তারা এগুলোর পেছনে বেশ এফোর্ট দিয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় হয়ত কিছু গ্যাপ আছে। আশা করি সামনে এগুলো নিয়ে তারা আরও অগ্রসর হবে। এ ব্যাপারে তারা আমাদের একটা আশ্বাসও দিয়েছে।”
যেসব আলামত দেখানো হয়েছে, তা আত্মহত্যা বলে ধরে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট কিনা- এমন প্রশ্নে ফারদিনের আরেক সহপাঠী বলেন, “এ নিয়ে ডিবির সাথে আমাদের কথা হয়েছে, তারা (ডিবি) বলেছেন যে, শতভাগ কাজ করা যায় না বা এটা সম্ভব না। কিছু ক্ষেত্রে গ্যাপ আছে বা থাকে।
“সেক্ষেত্রে উনারা কাজ করছেন, আমরা আমাদের পয়েন্ট বলেছি…। তারা পরবর্তীতে এ বিষয়টি জানাবেন।”
ডিবির ব্যাখ্যায় ‘সন্তুষ্ট কিনা’ জানতে চাইলে ব্রিফিংয়ে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, “তাদের সহযোগিতায় আমরা অনেকটা সন্তুষ্ট। তারা অনেক কাজ করছেন। আমরা চূড়ান্ত কিছু বলছি না। বুয়েটে ফিরে সবার সাথে আলোচনা করে আমরা বিস্তারিত বলব।”
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান হারুন অর রশীদ বৈঠকের পর সাংবাদিকদের বলেন, “পুরোটাই যে আত্মহত্যা, তাদের আমরা বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। তারাও বিষয়টি বুঝেছেন।”
তবে ফারদিনের বাবা নূরউদ্দিন রানা এখনও মানতে রাজি নন যে তার ছেলে আত্মহত্যা করে থাকতে পারে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে না থাকলেও পরে তিনি ডিবি কার্যালয়ের মিডিয়া সেন্টারে উপস্থিত হয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “আমি মানি না, এটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। বিষয়টি আমি এখনও মানি না।”
কেন তিনি হত্যা বলে মনে করছেন জানতে চাইলে নূরউদ্দিন বলেন, “র্যাব বা ডিবি কোনো ভিডিও দেখাতে পারেনি, কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি।”
গত ৪ নভেম্বর দুপুরে কোনাপাড়ার বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন ফারদিন; বলে গিয়েছিলেন, পরদিন তার পরীক্ষা রয়েছে বলে রাতে বুয়েটের হলেই থাকবেন। পরীক্ষা দিয়ে বাসায় ফিরবেন।
কিন্তু পরদিন পরীক্ষায় তার অনুপস্থিত থাকার পর জেনে খোঁজাখুজি করে ছেলেকে না পেয়ে থানায় জিডি করেন ফারদিনের বাবা নূরউদ্দিন রানা। তিন দিন পর ৭ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে লাশ পাওয়া যায়।
ফারদিনের লাশ পাওয়া যায় গোদনাইলে বর্ণালী টেক্সটাইল মিলের ঘাট এলাকায়। উদ্ধারের সময় তার হাতে ঘড়ি পরা ছিল; জামা-প্যান্ট ছিল প্রায় অক্ষত। তার মানিব্যাগও সঙ্গে ছিল বলে পুলিশ জানায়।
তবে নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালে ময়নাতদন্তের পর চিকিৎসক শেখ ফরহাদ সাংবাদিকদের বলেন, নিখোঁজ হওয়ার দিনই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন ফারদিন। তার মাথা ও বুকে একাধিক আঘাতের চিহ্ন রয়েছে৷ মৃত্যুর আগে শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ওই ছাত্র৷