ব্যবসায়ীদের দাবি মেনে দাম বাড়ানো, একের পর এক বৈঠক এবং আশ্বাসের পরও বাজারে সরবরাহ সংকট কাটছে না চিনির; প্যাকেট পাওয়াই যাচ্ছে না আর খোলা চিনি প্রতিকেজিতেই বেঁধে দেওয়া দরের চেয়ে বাড়তি নেওয়া হচ্ছে আট টাকা।
পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এক সপ্তাহ আগে থেকে মিলাররা প্রতিকেজি চিনির দাম রাখছেন প্রায় ১০৬ টাকার কাছাকাছি। তাদের দাবি, ৫০ কেজি চিনির বস্তাপ্রতি মাত্র ১০ থেকে ২০ টাকা মুনাফা রেখে তা বেচে দিচ্ছেন খুচরা বিক্রেতাদের কাছে। সেই চিনি খুচরায় বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ১১৫ টাকায়।
বাড়তি এ দরে খোলা চিনি মিললেও প্রায় সব এলাকার ছোট বড় প্রায় সব দোকানে প্যাকেটের চিনি পাওয়া যাচ্ছে না বললেই চলে।
মিরপুরের কয়েকটি বাজারের খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, কোম্পানিগুলো প্রায় দুই মাস ধরে প্যাকেট চিনি দিচ্ছে না। অন্য এলাকার চিনি বেচাকেনার চিত্রও প্রায়ই একই। একে তো চিনি থাকে না দোকানে আবার বেশি দাম শুনে ক্রেতাদের সঙ্গে বাধে ক্যাচাল। যে কারণে অনেক দোকানি চিনি রাখা প্রায়ই বন্ধ করে দিয়েছেন বলে জানালেন।
শুধু খুচরা দোকান নয়, ঢাকার অন্যতম প্রধান সুপারশপ ‘স্বপ্ন’ এর আউটলেটগুলোও সরবরাহ না পাওয়ায় প্রায় দুই মাস ধরে প্যাকেট চিনি বিক্রি করতে পারছে না বলে তথ্য দিলেন এক বিক্রয়কর্মী।
এর আগে বাংলাদেশ সুগার মিল অ্যাসোসিয়েশনের এক চিঠির প্রেক্ষিতে প্রতি কেজি খোলা চিনির দাম পাঁচ টাকা বাড়িয়ে ১০৭ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনির দাম চার টাকা বাড়িযে ১১২ টাকা নির্ধারণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ বাড়তি দর ১ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকরের কথা ছিল। তবে এর আগে থেকেই বাজারে এর চেয়েও বেশি দরে চিনি বিক্রি হতে দেখা গেছে।
মিরপুর রূপনগর আবাসিক সোনারবাংলা বাজারের আল আমিন জেনারেল স্টোরের মালিক মো. ফজল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে প্রতিকেজি খোলা চিনি ১১৫ টাকায় বিক্রি করছেন। আগের চেয়ে প্রতিকেজিতে ৫ টাকা বেশি দামে কিনতে হচ্ছে বলে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।”
এর আগে পাইকারিতে দাম কম থাকায় ১০৫ টাকা কেজি বিক্রি করতেন বলে জানান তিনি।
পাশের দোকান মাজেদা জেনারেল স্টোরের মালিক মো. লোকমান হোসেন বলেন, “তীর ও ফ্রেশ কোম্পানির বিক্রয় কর্মী আমাদের আমাদের পণ্য সরবরাহ করে। কিন্তু গত দুই মাস ধরে তারা আমার কাছে প্রতিকেজি প্যাকেট চিনির দাম চায় ১১০ টাকা। কিন্তু প্যাকেটের গায়ে দাম লেখা আছে ১০৭ টাকা। তারা বলে, ১২০ টাকায় বিক্রি করতে।”
অভিযান আর জরিমানার ভয়ে তিনি চিনি বিক্রিই বন্ধ করে দিয়েছেন বলে জানান।
এ এলাকার সুপারশপ ‘স্বপ্ন’ এর বিক্রয়কর্মী বশির আহমেদ জানান, গত প্রায় এক মাসের বেশি সময় ধরে তারা শুধু ফ্রেশ ব্র্যান্ডের খোলা চিনি পাচ্ছেন। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে প্রতিকেজি খোলা চিনি ১১৫ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।
মিরপুর শাহ স্মৃতি মার্কেটের চিনির পাইকারি ব্যবসায়ী মদিনা ট্রেডার্সের মালিক আমিরুল ইসলাম টুটুল জনগণের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, “মিল মালিক অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ সরকারের কাছে এসে নতুন দাম প্রস্তাব করে প্রতিশ্রুতি করল। আবার সেই প্রতিশ্রুতি তারা রক্ষা করছে না।”
তিনি জানান, ৫০ কেজি চিনির বস্তার দাম গত সপ্তাহ থেকে ২০০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে একটি ব্র্যান্ড। শনিবার প্রতি বস্তার দাম রেখেছে ৫ হাজার ৩৩০ টাকা। অর্থাৎ প্রতিকেজি খোলা চিনি কিনতে হচ্ছে ১০৬ টাকা ৬০ পয়সায়। প্রতিবস্তায় মাত্র ১০ টাকা লাভে তিনি বিক্রি করছেন বলে দাবি করেন।
এই ব্যবসায়ী চিনির বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার জন্য মিলারদের সিন্ডিকেটকে দায়ি করেন। প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে সরবরাহ না বাড়ানোর জন্য তিনি চিনি পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে সরকারের আরও কঠোর হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন।
শাহ আলী মার্কেটের পাইকারি ব্যবসায়ী জসীম এন্টার প্রাইজের কর্মী নাজিম উদ্দিন জানান, এখন চাইলেই চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু একটি ব্র্যান্ডের চিনি পাচ্ছেন তারা। গত সপ্তাহ থেকে সেই কোম্পানিই প্রতিকেজিতে দর দুই টাকা বাড়িয়েছে। যে কারণে তাদের বাড়তি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে বলে জানান তিনি।
কারওয়ান বাজারে চিনির পাইকারি দোকান সোনালী ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ নাঈমের দাবি প্রতিবস্তা (৫০ কেজি) চিনি ৩০ টাকা মুনাফায় ৫ হাজার ৩৫০ টাকায় বিক্রি করছেন। এতে প্রতিকেজি চিনির দাম ১০৭ টাকা করে পড়ছে। এখন এ দামে কেনার পর মুদি দোকানিরা কেজিতে ২ টাকা মুনাফা করলেই যথেষ্ট হওয়ার কথা।
তিনি বলেন, “সেক্ষেত্রে কেউ যদি এরচেয়ে বেশি দামে বিক্রি করে সেবিষয়ে আমাদের কী করার বা বলার আছে। হয়তো তারা একটা সুযোগ নিচ্ছে।
“আপাতত মিল পর্যায়ে চিনির কোনো সংকট নেই বলেই আমি জানি। চিনির জন্য ট্রাক গেলে ২/৪ ঘণ্টার মধ্যেই চিনি পাওয়া যাচ্ছে।”
চিনির সরবরাহ সংকট ও বাড়তি দরের বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান একই রকম অভিযোগ ও অনিয়ম পাওয়ার কথা জানান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “দুই দিন আগে আমরাও অভিযান পরিচালনা করেছি। বিভিন্ন বাজারে আমরাও এসব অনিয়ম দেখেছি। অভিযানে আমরা অনিয়মের জন্য বিভিন্ন বাজারের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীকে জরিমানাও করা হয়েছে।”
এবিষয়ে মিলারদের সঙ্গে বৈঠক হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, আজ (শনিবার) ও আগামীকালও (রোববার) সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে বৈঠক আছে।
চিনির সরবরাহ সংকট নেই দাবি করে বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও দেশবন্ধু চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মিলগুলো থেকে এখন পর্যাপ্ত চিনি সরবরাহ করা হচ্ছে। মিল পর্যায়ে প্রতিকেজি চিনির দাম ১০১ টাকা থেকে ১০২ টাকার মধ্যে থাকছে।
তার দাবি, আপাতত কোথাও কোনো সংকটের অভিযোগ নেই। তারপরও কোনো স্তরে কেউ যদি বেশি মুনাফা করে সেটা খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারের।
এর আগে গত ২৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন বাণিজ্য সচিবের কাছে এক চিঠিতে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি এবং ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়া ও উৎপাদন ব্যয় বিবেচনায় প্রতিকেজি চিনির দাম ৫ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করে। সেই প্রস্তাবে সায় দিয়ে প্রতি কেজি খোলা চিনির দাম পাঁচ টাকা বেড়ে ১০৭ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনির দাম চার টাকা বেড়ে ১১২ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
এর আগে গত নভেম্বরে খুচরায় প্রতি কেজি খোলা চিনি ১০২ টাকা এবং প্যাকেট ১০৮ টাকা নির্ধারণ করেছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।