সড়কে বেপরোয়া গতির খেলা আর নিয়ম ভাঙার প্রতিযোগিতা বন্ধে প্রচলিত পদ্ধতির সীমাবদ্ধতায় নিরাপদ মহাসড়ক নিশ্চিতে প্রযুক্তির যোগ হচ্ছে; দেশের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় যন্ত্রের বুদ্ধিমত্তাকে ব্যবহারের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
উন্নত বিশ্বের মত ‘ইন্টেলিজেন্ট ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম’ (আইটিএস) প্রযুক্তি ব্যবহার করে মহাসড়কে যানবাহনে নজরদারি বাড়ানো হবে। এটি দ্রুত গতি নিয়ন্ত্রণে চালকদের বাধ্য করার পাশাপাশি তাদের নিয়ম ভাঙার বিরুদ্ধে ত্বরিৎ ব্যবস্থা এবং দুর্ঘটনার পর তাৎক্ষণিক সহায়তা কার্যক্রমে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে বলে আশা সরকারের।
দুটি প্রকল্পের আওতায় প্রায় পৌনে তিনশ কোটি টাকা ব্যয়ে দুই মহাসড়কে স্বয়ংক্রিয় আইটিএস প্রযুক্তির ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা স্থাপনের মাধ্যমে সড়ক পর্যবেক্ষণের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে।
তবে এমন ব্যয়বহুল ও উন্নত প্রযুক্তির কাজ শুরুর পাশাপাশি দক্ষ জনবল তৈরি ও আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে প্রকল্প টেকসই করতে সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ এসেছে সড়ক যোগাযোগ খাতের বিশেষজ্ঞ বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইন্সটিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক শামসুল হকের কাছ থেকে।
ঢাকা মহানগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা এনালগ থেকে ডিজিটাল হওয়ার কার্যক্রমে অনেক অর্থ ব্যয় করার পর ব্যর্থতার খারাপ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন তিনি।
কোন পথে থাকছে আইটিএস
সফটওয়্যার ও ডিভাইসভিত্তিক আইটিএস প্রযুক্তির সহায়তায় দূর থেকে সড়কে চলাচলকারী যানবাহনের গতিপথে নজর রাখা যাবে। চলতি পথে চালকরাও জানতে পারবেন তার বাহনের গতি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রয়েছে কি না। নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগেই সতর্ক হওয়ার সুযোগ পাবেন।
একই সঙ্গে কন্ট্রোল রুম থেকে ‘ভেহিকল ডিটেক্টিভ সিস্টেমের’ মাধ্যমে কোনো গাড়ি নির্ধারিত গতি অতিক্রম করলে সেটিকে চিহ্নিত করা যাবে।
এ ব্যবস্থা চালু হলে নির্ধারিত সড়কে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে যান চলাচল এবং নির্দিষ্ট লেইন মেনে চলতে চালকদের বাধ্য করার সুযোগ তৈরি হবে। তাৎক্ষণিক সংকেত আর বার্তা পাঠিয়ে স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে অবহিত করা যাবে।
এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে সড়ক নিরাপদ করা গেলে দুর্ঘটনা কমবে বলে প্রকল্প দুটির প্রস্তাবে বলা হয়েছে। মহাসড়কে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের পাশাপাশি যানবাহনের তথ্য সংগ্রহ ও গতি শনাক্তকরণ করা যাবে এ প্রযুক্তির মাধ্যমে। একই সঙ্গে দুর্ঘটনার বার্তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাওয়া যাবে।
পদ্মা সেতুর পথে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জাতীয় মহাসড়কের (এন ৮) ৪০ কিলোমিটার সড়কে পরীক্ষামূলক এ ব্যবস্থা চালুর জন্য একটি প্রকল্প নিয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। এটি বাস্তবায়ন করবে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর।
অপরদিকে গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে রংপুর পর্যন্ত ২৬০ কিলোমিটার মহাসড়কে নিরবচ্ছিন্ন আইটিএস প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে।
সাউথ এশিয়া সাবরিজিওনাল ইকনোমিক কোঅপারেশন (সাসেক) এর আওতায় আঞ্চলিক মহাসড়ক নির্মাণ কাজের অংশ হিসেবে এ প্রযুক্তি বসানো হবে। এজন্য সড়ক ও জনপথ বিভাগ চলতি বছর এপ্রিলে ঢাকার ন্যাশনাল ডেভলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড (এনডিই) ও চীনের ফাইবারহোম টেলিকমিউনিকেশন টেকনোলজিস কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করেছে বলে সাসেকের ওয়েবসাইটে জানানো হয়েছে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে ১৫১ কোটি টাকা ব্যায়ে চলমান ‘সাসেক সড়ক সংযোগ প্রকল্প: এলেঙ্গা-হাটিকামরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ' প্রকল্পের আওতায় এই আটিএস পদ্ধতি চালু করা হচ্ছে।
অপরদিকে ঢাকা থেকে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে আটিএস প্রযুক্তি ও ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সেন্টার স্থাপনে সার্বক্ষণিক নজরদারি করা হবে যানবাহনগুলোতে।
১২২ কোটি টাকা ব্যয়ের ‘ইম্প্রুভিং দ্য রিলায়েবিলিটি অ্যান্ড সেইফটি অন ন্যাশনাল হাইওয়েজ করিডোরস অব বাংলাদেশ বাই ইন্ট্রোডাকশন অব ইন্টেলিজেন্ট ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম (আইটিএস)’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে শেষ হলে এর সুফল মিলবে।
গত ১১ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় এটির চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় সরকার।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কোরিয়া আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থা (কোইকা) ৮৩ কোটি টাকার অনুদান ও কারিগরি সহায়তা দেবে। বাকি প্রায় ৩৯ কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে দেওয়া হবে।
তবুও সংশয়
স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে নজরদারির এ ব্যবস্থা সড়কে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় নতুন মাত্রা যোগ করলেও অতীতের বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়নে নাজুক ব্যবস্থাপনার কারণে এ প্রকল্পের সফলতা নিয়ে আশঙ্কার প্রকাশ করেছেন সড়ক যোগাযোগ খাতের বিশেষজ্ঞ বুয়েটের পুর কৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক।
আগের উদ্যোগগুলোতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবে আইটিএস প্রকল্পের কেনাকাটাও শেষে এক ধরনের ‘পণ্ডশ্রম’ ও অর্থের অপচয় হতে পারে বলে সংশয় তার।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি জানান, এর আগেও সড়কের নিরাপত্তার জন্য অনেক ধরনের কার্যক্রম বিশেষ করে ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছিল। তখন ঢাকা শহরে অনেক সাইনবোর্ড, সিগন্যাল বাতি লাগিয়ে ডিজিটাল পদ্ধতিতে যান চলাচল ব্যবস্থাপনার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু কয়েক মাস পরই এসব জিনিস নষ্ট হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত এনালগ সিস্টেমেই এতবড় একটা মেগাসিটির যানবাহন ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে।
ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডেও সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে ডিজিটাল পদ্ধতিতে যানবাহনের চলাচলের সংকেত ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রসঙ্গও তুলে ধরেন তিনি।
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইন্সটিটিউটের সাবেক এই পরিচালক বলেন, “প্রথমে কোনো ধরনের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা ছাড়াই বিপুল পণ্য কেনা হল। কিছুদিনের মধ্যে এসব নিম্নমানের পণ্য যখন নষ্ট হওয়া শুরু হয় তখন ১০ হাজার টাকার ক্যামেরা ১ লাখ টাকার চাহিদা দেওয়া হল।
“তখন বলা হল এত টাকা দিয়ে এসব করার দরকার নাই। এরপর ওই কার্যক্রম পণ্ড হয়ে গেল।“
দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত ভঙ্গুর ও নাজুক মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এটা নিয়ে টেকসই কিছু করতে গেলে অবশ্যই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
“দায়িত্বশীল অ্যাকাউন্টেবিলিটি থাকতে হয়। কিন্তু আমাদের মধ্যে এখনও সেই পেশাদারিত্ব তৈরি হয়নি। আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাব রয়েছে।”
নতুন প্রকল্প নিয়ে শঙ্কার বিষয়ে আগের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি জানান, ঢাকার যানবাহন ব্যবস্থাপনার জন্য চারটি ইন্টেলিজেন্ট ট্রাফিক সিগন্যাল বাস্তবায়নে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। চার বছর ধরে চেষ্টার পর বলা হয়, ঢাকার রিকশা না সরালে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যাবে না।
“রিকশা না সরালে যে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যাবে না এটা আগে কেন জানতে পারলেন না? অনেক কিছু কেনাকাটা করার পর আপনি বুঝতে পারলেন যে রিকশা না সরালে হবে না। এটাই হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাব,” উদাহরণ হিসেবে যোগ করেন তিনি।
নতুন প্রকল্পও ‘কিছু কেনাকাটার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে’ ওই রকমই একটা প্রকল্প হতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা তার।
“আইটিএস প্রযুক্তি ব্যবহার করার মত উন্নত সড়ক ব্যবস্থা এবং আইটিএস পরিচালনার জন্য দক্ষ জনবল সেবা দেওয়ার মত জনবল ও মানসিকতা নিয়েও সমস্যা রয়েছে। এনালগ মানসিকতা নিয়ে ডিজিটাল প্রযুক্তি প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব না। দক্ষ জনবল ছাড়া এ প্রকল্প টেকসই হবে না,” বলেন তিনি।
কীভাবে কাজ করবে আইটিএস
সমন্বিত ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য আইটিএস ব্যবস্থা চালুর জন্য পরীক্ষামূলক প্রকল্প হিসেবে ঢাকা- মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েকে বেছে নেওয়া হয়েছে।
এ ব্যবস্থায় যানবাহন চলাচলের পরিমাণ, গতি, দুর্ঘটনা সংক্রান্ত তথ্যের পাশাপাশি সড়কে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার অধীনে আসবে।
এই মহাসড়কের কোথাও কেউ নির্দেশনা অমান্য করলে আইটিএস তাৎক্ষণিকভাবে চিহ্নিত করে ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সেন্টারকে জানাবে। এতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া যাবে।
ওই সড়কে নিদির্ষ্ট লেইনের জন্য নির্দিষ্ট গতি এবং দিক নির্দেশনা দেওয়া থাকবে। কোনো যানবাহন নির্দেশনা অমান্য করলে আইটিএসের মাধ্যমে তা চিহ্নিত করা হবে। এরপর ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সেন্টার থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আবার ওই সড়কে কোনও যান দুর্ঘটনার কবলে পড়লে ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সেন্টারের নজরদারির মাধ্যমে তাৎক্ষনিক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে হতাহত কমানো সম্ভব হবে।
অপরদিকে জয়দেবপুর থেকে রংপুর পর্যন্ত ২৬০ কিলোমিটারে মহাসড়কের ২৫টি জায়গায় বিশেষ টাওয়ারে আইটিএস স্থাপন করে পুরো সড়কটি মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হবে।
এসব টাওয়ারে বসানো ‘ভ্যারিয়েবল মেসেজিং সাইন’ সড়কে চলা গাড়িগুলোকে যে কোনো প্রাকৃতিক বিপদ যেমন ঝড় বা বড় ধরনের সড়ক দুর্ঘটনাতে আগাম সতর্ক করে দেবে। এতে সঙ্গে সঙ্গে ওই পথের অন্য সব গাড়িকে বিপদের তথ্য জানিয়ে দেওয়া যাবে ।
এছাড়া প্রকল্পের আওতায় টাঙ্গাইলের পাকুল্লায়, বগুড়ার মহাস্থান এবং রংপুররের ইসলামপুরের তিনটি স্থানে মিডিয়াম স্পিড ওয়েই ইন মোশন সিস্টেমসহ এক্সেল লোড কন্ট্রোল স্টেশন স্থাপন করা হবে।
এগুলো যানবাহনের ওজন এবং শ্রেণি স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেকর্ড করবে এবং তা ঢাকার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সেন্টারে পাঠাবে। অতিরিক্ত ওজন পাওয়া গেলে আরও চেকিং বা পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য রিপোর্ট করবে। প্রকল্পটি ২০২৩ সালের ডিসেম্বর নাগাদ শেষ হওয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে।