নিউক্লিয়ার ফিউশনে শক্তি তৈরিতে সাফল্য যুক্তরাষ্ট্রে


এফই অনলাইন ডেস্ক | Published: December 13, 2022 12:52:10 | Updated: December 13, 2022 17:22:00


ক্যালিফোর্নিয়ার লরেন্স লাইভমোর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির ন্যাশনাল ইগনিশন ফ্যাসিলিটির টার্গেট চেম্বার, যার ভেতরে ঘটানো হয়েছে নিউক্লিয়ার ফিউশন।ছবি: সিএনএন

যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা নিয়ন্ত্রিত নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রথমবারে মত গবেষণাগারে শক্তি উৎপাদনে সাফল্য পেয়েছেন বলে খবর দিয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। à¦–বর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।

সিএনএন জানিয়েছে, ক্যালিফোর্নিয়ার লরেন্স লাইভমোর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির ন্যাশনাল ইগনিশন ফ্যাসিলিটিতে বিজ্ঞানীরা সফলভাবে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন, যেখানে ব্যবহার করা জ্বালানির চেয়ে বেশি মাত্রায় শক্তি তৈরি সম্ভব হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি বিভাগ মঙ্গলবার এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে পারে বলে জানানো হয়েছে সিএনএন এর প্রতিবেদনে। 

সূর্যের মত নক্ষত্রে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমেই শক্তি তৈরি হয়। বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে পৃথিবীতে নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় সেই বিক্রিয়া ঘটানোর কৌশল উদ্ভাবনের চেষ্টা চালিয়ে আসছেন।

সত্যি সত্যি যদি পৃথিবীতে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে নিউক্লিয়ার ফিউশন ঘটানো যায়, তার মধ্য দিয়ে দৃশ্যত অসীম পরিমাণ শক্তি উৎপাদন করা যাবে পরিবেশবান্ধব উপায়ে। এ প্রক্রিয়ায় কার্বন নির্গামন বা তিজস্ক্রিয় নিঃসরণের ঝুঁকিও তেমন বাড়বে না।

যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীদের গবেষণা সফল হয়ে থাকলে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে আনার একটি নতুন পথ খুলতে যাচ্ছে বলে গবেষকরা আশাবাদী। 

যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা জয়েন্ট ইউরোপিয়ান টোরাস (জেইটি) ল্যাবরেটরির গবেষকরা এ বছর ফেব্রুয়ারিতে হাইড্রোজেনের দুটি আইসোটপ ব্যবহার করে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে তাপ উৎপাদনের নতুন রেকর্ড গড়ার খবর দেন।

জেইটি ল্যাবের গবেষকরা তাদের গবেষণায় ৫ সেকেন্ডে ৫৯ মেগাজুল (১১ মেগাওয়াট) শক্তি তৈরি করতে পেরেছিলেন, যা ১৯৯৭ সালে তাদের একই ধরনের গবেষণায় উৎপাদিত শক্তির দ্বিগুণেরও বেশি।

যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা যে প্রক্রিয়ায় কাজটি করেছেন, তাকে বলা হয় থার্মোনিউক্লিয়ার ইনারশিয়াল ফিউশন। তারা লেজারের মাধ্যমে নিউট্রনের গায়ে আইসোটপ ছুড়ে দিয়ে ধারাবাহিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন, যার মাধ্যমে তৈরি হয়েছে তাপ।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, যে কাজটি তারা করেছেন, সেটি গবেষণাগারে যন্ত্রের মধ্যে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে অতি ক্ষুদ্র একটি নক্ষত্রের জন্ম দেওয়ার মত। এখন সেই ফিউশন বিক্রিয়া ধরে রেখে আরও বড় পর্যায়ে শক্তি উৎপাদন এবং তা বিদ্যুৎ উৎপাদনে কাজে লাগানোর কৌশল তাদের উদ্ভাবন করতে হবে।

ভবিষ্যতে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদুৎকেন্দ্র তৈরি করলে তাতে গ্রিনহাউস গাস নির্গমণ হবে না। স্বল্পস্থায়ী তিজস্ক্রিয় বর্জ্য তৈরি হলেও তার পরিমাণ হবে খুবই সামান্য।

এই শতকের দ্বিতীয় ভাগেই নিউক্লিয়ার ফিউশন একটি নির্ভরযোগ্য জ্বালানি উৎস হয়ে উঠতে পারে বলে আশা করছেন গবেষকরা। 

নিউক্লিয়ার ফিউশন কী?

কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ায় একটি পরমাণুর নিউক্লিয়াস ভেঙে ভিন্ন মৌলের একাধিক হালকা নিউক্লিয়াস তৈরি হলে কিংবা উল্টোভাবে একাধিক পরমাণুর নিউক্লিয়াস যুক্ত হয়ে কোনো ভিন্ন মৌলের নিউক্লিয়াস তৈরি করলে বিপুল পরিমাণ শক্তির বিকিরণ ঘটে, যাকে বলে পারমাণবিক শক্তি।

এটা ঘটতে পারে দুই ধরনের বিক্রিয়ার মাধ্যমে। একটিকে বলে নিউক্লিয়ার ফিশন, অন্যটি নিউক্লিয়ার ফিউশন।  

ফিশন বিক্রিয়ায় একটি ভারী মৌলের পরমাণুকে নিউট্রন দিয়ে আঘাত করা হয়। তাতে ভারী মৌলের নিউক্লিয়াস ভেঙে দুটি হাল্কা মৌলের পরমাণুতে পরিণত হয়। তাতে নির্গত হয় বিপুল পরিমাণ পারমাণবিক শক্তি।

এভাবে পারমাণবিক শক্তি তৈরির কৌশল মানুষ আয়ত্ত করেছে আগেই। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আর পারমাণবিক বোমা এই প্রক্রিয়ারই ফল।

এ বিক্রিয়ার সময় ভারী মৌলের নিউক্লিয়াস যখন ভেঙে যায়, তখন তিনটি নিউট্রনও উৎপন্ন হয়। সেই তিনটি নিউট্রন তখন আরও তিনটি নিউক্লিয়াসে আঘাত করে নতুন তিনটি বিক্রিয়ার সূচনা করে। তাতে পাওয়া যায় আরও শক্তি এবং নয়টি নিউট্রন।

তত্ত্বীয়ভাবে এই প্রক্রিয়া শুরু হলে ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকবে, সেজন্য একে বলে চেইন রিঅ্যাকশন। এই চেইন রিঅ্যাকশন অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলতে থাকলে বিপজ্জনক পরিমাণ তাপ বিকরিত হয়। এই মূলনীতিতেই তৈরি হয়েছে পারমাণবিক বোমা।

কিন্তু চেইন রিঅ্যাকশনের সময় তৈরি হওয়া প্রতি তিনটি নিউট্রনের মধ্যে দুটি যদি শোষণ করার ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে এই ফিশন বিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। তখন বিপদ না ঘটিয়ে নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় তাপ উৎপাদন করা যায়। এই কৌশল ব্যবহার করেই তৈরি হয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।

পারমাণবিক চুল্লিতে ইউরেনিয়াম পরমাণুকে একটি নিউট্রন দিয়ে আঘাত করে এর ফিশন ঘটানো হয়। সমস্যা হল, এর জ্বালানি সহজলভ্য নয় এবং এ প্রক্রিয়ায় বিপুল পরিমাণ তেজস্ক্রিয় বর্জ্য তৈরি হয়।

নিউক্লিয়ার ফিউশনের সূচনা হয় ফিশন বিক্রিয়ার উল্টো প্রক্রিয়ায়। এক্ষেত্রে দুটি বা তার বেশি নিউক্লিয়াস যুক্ত হয়ে এক বা একাধিক ভিন্ন মৌলের পরমাণু তৈরি করে, সঙ্গে পাওয়া যায় বিপুল শক্তি।

যেমন হাইড্রোজেনের দুটি আইসোটোপ ডিউটেরিয়াম ও ট্রিটিয়াম যুক্ত হয়ে হিলিয়াম তৈরি করে। সেই সাথে মুক্ত হয় একটি নিউট্রন। সূর্যে প্রচণ্ড মধ্যাকর্ষণের চাপের মধ্যে নিউক্লিয়ার ফিউশনেই ক্রমাগত শক্তি তৈরি হচ্ছে। সেখানে মোটামুটি ১ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ওই বিক্রিয়া ঘটছে।

কিন্তু পৃথিবীতে ওই মাত্রায় চাপ তৈরি করা সম্ভব না। ফলে যদি ফিউশন বিক্রিয়া ঘটাতে হয়, তাহলে তাপমাত্রা বাড়িয়ে মোটামুটি ১০ কোটি সেলিসিয়াসে নিতে হবে।

পৃথিবীতে এমন কোনো বস্তু নেই, যেটা ওই তাপমাত্রায় টিকে থাকতে পারে। ফলে ল্যাবরেটরিতে এ গবেষণা চালাতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা ভিন্ন কৌশল নিয়েছেন। প্রচণ্ড উত্তপ্ত গ্যাস বা প্লাজমাকে তারা শূন্যে ঝুলিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছেন শক্তিশালী ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি করে।

এখন পর্যন্ত গবেষণাগারে ফিউশন বিক্রিয়া ঘটিয়ে যে পরিমাণ শক্তি তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে, পুরো প্রক্রিয়া শুরুর জন্য তার চেয়ে বহু গুণ বেশি শক্তি খরচ করতে হচ্ছে।

তবে এ বিষয়ে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হতে পেরেছেন যে, বড় পরিসরে প্লাজমার পরিমাণ বাড়িয়ে ফিউশন বিক্রিয়া ঘটানো গেলে খরচ করা শক্তির চেয়ে বেশিই উৎপাদন করা সম্ভব।

সেজন্য যেতে হবে আরও বহু পথ, দরকার হবে আরও অনেক গবেষণা, তাতে লাগবে আরও অনেক সময়। 

Share if you like