নভেম্বর ও রবীন্দ্রালোকে উজ্জ্বলিত সৈয়দ মুজতবা আলী


মেহেদি হাসান | Published: November 22, 2022 16:04:28 | Updated: November 22, 2022 21:54:22


নভেম্বর ও রবীন্দ্রালোকে উজ্জ্বলিত সৈয়দ মুজতবা আলী

১৯১৩ সালে রবী ঠাকুরের নোবেলপ্রাপ্তি বাঙালি তথা এশীয়বাসীগণের নিকট গৌরবের মহাকারণ হয়ে দাঁড়াল। ভ্রমণপিপাসু রবীন্দ্রনাথ দেশ-দেশান্তর পরিক্রমায় বের হলেন। হাজারো সভায় সংবর্ধিত হলেন। তারই জের ধরে ১৯১৯ সালের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে কবিগুরুর আগমন ঘটল সিলেটে। সেখানকার মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজের ছাত্রাবাসে কবিগুরুর সংবর্ধনার আয়োজন করা হল। 

রবীন্দ্রনাথ সেখানে ‘আকাঙ্ক্ষা’ শিরোনামে তাঁর অমূল্য বক্তৃতা রাখলেন। রবী ঠাকুরের সে কথাগুলো পনের বছরের একটি কিশোরকে দারুণভাবে প্রভাবিত করল। রবীন্দ্রনাথ চলে যাওয়ার পর কিশোর তাঁকে চিঠি লিখলেন, “আকাঙ্ক্ষাকে বড় করিবার উপায় কি?” রবীন্দ্রনাথ আগরতলা থেকে নীল রঙের কাগজে স্বহস্তরচিত লিপিতে সে চিঠির উত্তর দিলেন, “আকাঙ্ক্ষা উচ্চ করিতে হইবে – এই কথাটার মোটামুটি অর্থ এই – স্বার্থই যেন মানুষের কাম্য না হয়।.... তোমার পক্ষে কি করা উচিত তা এতদূর থেকে বলে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে, তোমার অন্তরের শুভেচ্ছাই তোমাকে কল্যাণের দিকে নিয়ে যাবে।” রবীন্দ্রনাথের সে চিঠি কিশোর সিতু মিয়ার কৌতূহলকে আরো উস্কে দিল। শৈশবে সৈয়দ মুজতবার ডাকনাম ছিল ‘সিতারা' বা ‘সিতু’। সিতারা মানে তারকা। 

রবীন্দ্র সাহচর্যের প্রতি উদবাহু মুজতবার মনোবাঞ্ছা পূরণ হল ১৯২১ সালে শান্তিনিকেতনে শিক্ষার্থী হিসেবে প্রবেশের মধ্য দিয়ে। তিনি ছিলেন শান্তিনিকেতনের প্রথম মুসলিম শিক্ষার্থী। তখনকার দিনে একজন মুসলমানের পক্ষে শান্তিনিকেতনে গমনের বিষয়টি ছিল একপ্রকার চরম প্রথাবিরোধীতার শামিল। শান্তিনিকেতনের হিন্দু আশ্রমিকেরা মুজতবার আগমনে আপত্তি করলেও রবীন্দ্রনাথ তাকে সহৃদয়তায় গ্রহণ করেন। তার থাকা খাওয়ার আলাদা বন্দোবস্ত করা হয়। শান্তিনিকেতন নিয়ে স্মৃতিচারণায় মুজতবা রসসিক্ত ভাষায় অনেক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। তার দু-একটি বলছি –

শান্তিনিকেতনে প্রথম সাক্ষাতে রবীন্দ্রনাথ মুজতবাকে জিজ্ঞাসা করেন, “কি নিয়ে পড়তে চাও?”

“তা তো ঠিক জানিনে। তবে, একটা জিনিস খুব ভালো করে শিখতে চাই।”

রবীন্দ্রনাথ তখন বলেন, “নানা জিনিস শিখতে আপত্তি কি?”

“মনকে চারদিকে ছড়িয়ে দিলে কোনো জিনিস বোধহয় ভালো করে শেখা যায় না।”

শান্তদৃষ্টিতে চেয়ে রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, “এ কথা কে বলেছে?”

অপ্রস্তুত মুজতবা উত্তর দিলেন, “কনান ডয়েল।”

রবীন্দ্রনাথ তখন বললেন, “ইংরেজের পক্ষে এ বলা আশ্চর্য নয়!”

সেই থেকে মুজতবা তার চিত্তকে শান্তিনিকেতনের সকল অনুষদে বিস্তৃত করলেন। শিল্প-সাহিত্য, ধর্ম-ভাষাতত্ত্ব, কলা-বেদান্ত হেন বিষয় নেই যেথায় মুজতবা নিজেকে সমৃদ্ধ করেননি। শান্তিনিকেতনে মুজতবা পনের-ষোলটি ভাষা শিখলেন। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে বুৎপত্তি অর্জন করলেন। কয়েকটি দেশীয় সাহিত্যে বুৎপত্তি অর্জন করলেন। 

শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন আয়োজন-অনুষ্ঠানে মুজতবা আলী নিয়মিত কবিতা আবৃত্তি করতেন ও প্রবন্ধ পাঠ করতেন। শান্তিনিকেতনের ‘বিশ্বভারতী’ নামীয় হস্তলিখিত ম্যাগাজিনে মুজতবা আলী নিয়মিত লিখতেন। ১৯২২ সালে ‘বিশ্বভারতী সম্মিলনী’র নবম অধিবেশনে মুজতবা আলী ‘ইদ উৎসব' নামক প্রবন্ধ পাঠ করে রবীন্দ্রনাথসহ অনেকের প্রশংসায় সিক্ত হন। 

একবার রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের তরুণ ছাত্রদের ‘সোনার তরী' কবিতাটি আবৃত্তি করতে বলেন। সকলের আবৃত্তি শুনেটুনে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেন, “আলীর আবৃত্তিই সবচেয়ে ভালো, শুধু একটু কমলালেবুর গন্ধ।” কমলালেবুর এ গন্ধটি হল কথার ভেতর সিলেটীদের আঞ্চলিক টান। তবে রবীন্দ্রনাথ সিলেটের কমলালেবু ও তা থেকে জাত কমলামধু খুব পছন্দ করতেন। একবার শান্তিনিকেতন থেকে মুজতবা বাড়িতে আসার মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথকে জিগ্যেস করেন, “গুরুদেব, বাড়ি থেকে ফেরার পথে আপনার জন্যে কি কিছু আনবো?” এসময় রবীন্দ্রনাথ তাকে কমলামধু আনতে বলেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের সাথে মুজতবা আলীর দেখা হত বাংলা আর ইংরেজি ক্লাসে। রবীন্দ্রনাথ তাদের গ্যেটে ও কিটস পড়াতেন। একটি চিঠিতে মুজতবা আলী লিখেছিলেন, “আজ তিন চারদিন হইল রবীন্দ্রনাথ আমাদিগকে ইংরাজি পদ্য পড়ানো আরম্ভ করিয়া দিয়াছেন......তাঁর পদ্য পড়াইবার একটা আশ্চর্য ক্ষমতা আছে – অতি নীরস পদ্যও যেন তাঁর কাছে সরস হইয়া যায়।”

সৈয়দ মুজতবা আলী রবীন্দ্রালোকে উদ্ভাসিতগণের অন্যতম। রবীন্দ্রভক্তির এক মূর্তিমান পরাকাষ্ঠা মুজতবা আলী। অসংখ্য রবীন্দ্রপ্রবন্ধ, পদ্য, গদ্য তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল। শান্তিনিকেতন থেকে বের হয়ে শিক্ষা ও কর্মের সন্ধানে মুজতবা আলী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করেন। তিনি যেখানেই অবস্থান করেছেন বাংলা ও বাঙালির আবহমান সত্তাকে ধারণ করেছেন। দেশ-বিদেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতাগুলোর আলোকে তিনি যে ভ্রমণকাহিনী রচে গেছেন তা বাংলা ভাষায় আর কেউ পারেনি। রবীন্দ্রালোকে উদ্ভাসিত সৈয়দ মুজতবা আলী রবীন্দ্রলোকের সবচেয়ে দীপ্তিমান সিতারা। 

মেহেদি হাসান বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত।

mahedi.bcpsc.2016@gmail.com

Share if you like