পরিবেশ দূষণ ঠেকাতে নারায়ণগঞ্জকে ‘মডেল’ ধরে আগামী বছর থেকে কাজ শুরু করতে যাচ্ছে পরিবেশ অধিদপ্তর। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
২০৪০ সাল পর্যন্ত এ কার্যক্রমে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সফল হলে ঢাকার আশেপাশের অন্যান্য জেলাতেও তা বাস্তবায়ন করা হবে।
সম্প্রতি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশ অধিদপ্তর এই খসড়া কর্মপরিকল্পনাটি প্রণয়ণ করেছে।
এর আগে সংসদীয় কমিটির একটি বৈঠকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় নাগরিক সমাজকে সঙ্গে নিয়ে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে সম্মিলিতভাবে একটি পরিকল্পনা প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়।
পরিবেশ অধিদপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খসড়া কর্মপরিকল্পনাটি আরও যাচাই-বাছাই করার পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে মতবিনিয় করে চূড়ান্ত করা হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের উপ-পারিচালক মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আল-মামুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা একটা কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে দিয়েছি। সংসদীয় কমিটি সেটা দেখেছে।"
কমিটির সুপারিশের বিষয়ে তিনি বলেন, “তারা বলেছেন সিটি কর্পোরেশন এবং সিভিল সোসাইটিকে এই কাজে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আমরা সেজন্য নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনকে আমাদের পরিকল্পনা পাঠিয়েছি।
“তারাও পরিবেশ দূষণ রক্ষায় বেশ কিছু কাজ করে। তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে কাজ শুরু হয়ে যাবে।”
পরিবেশ অধিদপ্তর অগ্রাধিকার দিয়ে এক বছর মেয়াদী (জানুয়ারি-ডিসেম্বর ২০২৩) কর্মপরিকল্পনা; স্বল্প মেয়াদী (দুই বছর- জানুয়ারি ২০২৪ থেকে ডিসেম্বর ২০২৫); মধ্যমেয়াদী (৫ বছর-জানুয়ারি ২০২৬ থেকে ডিসেম্বর ২০৩০) এবং দীর্ঘমেয়াদী (১০ বছর-জানুয়ারি ২০৩১ থেকে ডিসেম্বর ২০৪০) খসড়া কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছে।
সংসদীয় কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, “নারায়ণগঞ্জের পরিবেশ দূষণ রোধে একটি কর্মপরিকল্পনার খসড়া হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করেপোরেশনের মেয়রের সঙ্গে বসে এটা চূড়ান্ত করা হবে। এটা বাস্তবায়নে সফলতা এলে ঢাকার আশপাশের অন্যান্য জেলাতেও এ ধরনের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে।”
স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) গবেষণা বলছে, দেশে বায়ু দূষণের দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে নারায়ণগঞ্জ। বায়ু দূষণে প্রথম গাজীপুর এবং দ্বিতীয় অবস্থানে ঢাকা।
জার্মানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান লোকাল গভার্নমেন্ট ফর সাসটেইনেবিলিটির (ইকলি) ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী, নারায়ণগঞ্জ সিটি এলাকায় বাতাসে কার্বন নিঃসরণ বেড়েছে। এই কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী শিল্প খাত।
ইকলির পর্যালোচনায় দেখা গেছে, নারায়ণগঞ্জে বার্ষিক কার্বন নিঃসরণ প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৮ শতাংশ।
পরিবেশ অধিদপ্তরের গত বছরের হিসাব বলছে, নারায়ণগঞ্জে তরল বর্জ্য নির্গমণ হয় এমন শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা চারশ’র বেশি। পরিবেশবান্ধব বর্জ্য শোধনাগার- ইটিপি প্লান্ট আছে তিনশটির মতো কারখানায়। প্রায় একশ কারখানায় ইটিপি প্লান্ট নেই। এসব কারখানার বর্জ্য শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা নদীতে গিয়ে পড়ছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, নারায়ণগঞ্জ জেলায় বৈধ-অবৈধ ইটভাটার সংখ্যা ৩৪৪। যার ২৫৪টিই চলছে অবৈধভাবে। আর বৈধ ইটভাটার সংখ্যা মাত্র ৯০টি। অবৈধ এসব ইটভাটার কারণে নারায়ণগঞ্জের বায়ুর মান খুবই নাজুক।
যা আছে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিকল্পনায়
নদী দূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরের অগ্রাধিকারভিত্তিক কর্ম পরিকল্পনায় সাব/জেলা কমিটি করে দূষণের ধরণ ও উৎস চিহ্নিত করার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়া কারখানা ও ইটিপি ছাড়া শিল্প কারখানা চিহ্নিত করা।
দূষণকারী কারখানার বিরুদ্ধে সুপারিশ প্রণয়ন ও সিটি করপোরেশন এলাকায় পয়ঃবর্জ্য যাতে শীতলক্ষ্যা নদীতে অপরিশোধিত অবস্থায় না পড়ে সে লক্ষ্যে পরিশোধন প্লান্ট স্থাপনে উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
বায়ু দূষণ ঠেকানোর কর্মপরিকল্পনায় দূষণের ধরন ও উৎস চিহ্নিত করার কথা বলা হয়েছে। সেইসঙ্গে দূষণকারী কারখানা চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে সুপারিশ দেওয়ার কথা বলা হয়।
কঠিন বর্জ্যের দূষণ ঠেকাতেও দূষণের ধরন ও উৎস চিহ্নিত করার কথা রয়েছে। অপরিকল্পিত কঠিন বর্জ্য ডাম্পিংয়ের স্থান চিহ্নিত করে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
কর্মপরিকল্পনায় অবৈধ ইটভাটা চিহ্নিত করে জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সমন্বয়ে সেসবের তালিকা হালনাগাদ করার কথা বলা হয়। সেইসঙ্গে অবৈধ ইটভাটা বন্ধে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা।
চিকিৎসা বর্জ্যের পরিবেশসম্মত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। শব্দদূষণকারী প্রতিষ্ঠান এবং স্থাপনা চিহ্নিত করে শব্দদূষণকারী কারখানা ও স্থাপনার বিরুদ্ধে সুপারিশ প্রণয়ন। জলাধার ভরাট করা ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা চিহ্নিত করা।
নিষিদ্ধ পলিথিন শপিং ব্যাগ বন্ধ করা। এর উৎপাদনকারী কারখানা চিহ্নিত করা। নিষিদ্ধ পলিথিন বিক্রয় ও মজুদকারী বাজার এলাকা চিহ্নিত করা ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ।
সবুজায়নের লক্ষ্যে পরিবেশ ছাড়পত্র নেওয়া সকল শিল্প প্রতিষ্ঠান ও শিল্পাঞ্চলের খালি জায়গা এবং সীমানা প্রাচীর সংলগ্ন স্থানে বনজ, জলদ, কিংবা ওষুধি বৃক্ষ রোপণ। পাশাপাশি সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বৃক্ষ রোপনের ব্যবস্থা করা।
দূষণ বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কর্মশালার আয়োজন এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা।
মধ্যমেয়াদী কর্মপরিকল্পনায় নদী দূষণ বন্ধে পরিবেশ ছাড়পত্র ও ইটিপিবিহীন কারখানার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ও যথাযথ মনিটরিংয়ের কথা বলা হয়। এছাড়া সিটি করপোরেশনের পয়োবর্জ্য পরিশোধন প্লান্ট স্থাপন প্রকল্প বাস্তবায়ন।
বায়ু দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ আদায়সহ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ। সরকারি নির্মাণ কাজে ব্লক ইটের ব্যবহার। চিকিৎসা বর্জ্যের পরিবেশ সম্মত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।
শব্দ দূষণে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া এবং ক্ষতিপূরণ আদায়। জলাধার ভরাট করা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ আদায়।
পলিথিন ব্যাগ বন্ধে উৎপাদক, সরবরাহকারী ও বিক্রেতার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ। পলিথিনমুক্ত বাজার ঘোষণা করা। সবুজায়নে শিল্প প্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বৃক্ষরোপনের আওতায় আনা।
দীর্ঘ মেয়াদের কর্মপরিকল্পনায় নদী দূষণ বন্ধে পরিবেশ ছাড়পত্র ও ইটিপিবিহীন কারখানায় অভিযান চালিয়ে মামলা দায়ের করা ও সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কথা বলা হয়েছে।
এছাড়া অনলাইনে ইটিপি পর্যবেক্ষণ ও নারায়ণগঞ্জ জেলা কার্যালয়ে গবেষণাগার স্থাপন। সিটি করপোরেশনের পয়োবর্জ্য যাতে শীতলক্ষ্যা নদীতে অপরিশোধিত অবস্থায় নির্গমন না হয় সেজন্য প্রকল্প বাস্তবায়ন।
বায়ুদূষণকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা। বাতাসের গুণগত মাণ পরীক্ষার ল্যাব স্থাপন। এছাড়া কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় প্রকল্প গ্রহণের কথা বলা হয়েছে।
সকল ক্ষেত্রে ব্লক ইটের ব্যবহার নিশ্চিত করা। চিকিৎসা বর্জ্য পরিবেশসম্মত না করলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া। মামলা দায়ের ও সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা।