Loading...
The Financial Express

দুর্যোগ প্রশমন: বিরূপ আবহাওয়ার অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর পরামর্শ


দুর্যোগ প্রশমন: বিরূপ আবহাওয়ার অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর পরামর্শ

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, আবহাওয়ায় অস্বাভাবিক আচরণ এখন বাড়ছে; সেই সঙ্গে বাড়ছে অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টির ক্ষতি।

চলতি বছরের জুনে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও সীমান্ত উজানে ভারী বর্ষণ বন্যা ডেকে আনলেও জুলাই-অগাস্টে অনাবৃষ্টির সঙ্গে ছিল দীর্ঘ সময়ের তাপপ্রবাহ; সেপ্টেম্বরে কিছুটা বৃষ্টিপাত হলেও অক্টোবরে ভ্যাপসা গরমের দুর্ভোগ কাটছে না। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এ বছর তিনটি বিষয় প্রকট ছিলম সেগুলো নতুন মাত্রা পাচ্ছে। আবহাওয়ায় এমন অস্বাভাবিক আচরণ এখন বাড়ছে; সেই সঙ্গে বাড়ছে অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টির ক্ষতি।

বৈরী আবহাওয়ার এই প্রভাব ফসল উৎপাদনসহ সার্বিক অর্থনীতিতে পড়ার কথা জানিয়ে তারা বলেছেন, আগামী কয়েক বছর এমন চললে দুর্ভোগ আরও বাড়বে।

গত জুনে ভারী বর্ষণের পাশাপাশি সীমান্ত সংলগ্ন উজানেও অতিবর্ষণ সিলেট-সুনামগঞ্জে শত বছরের মধ্যে সবথেকে ভয়াবহ বন্যা ডেকে আনে। জুলাইয়ে সারা দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫৭ দশমিক ৬ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়, যা ৪২ বছরের মধ্যে জুলাইয়ে সর্বনিম্ন বৃষ্টিপাত। এরপর অগাস্টে ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়।

আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান বলেন, মার্চ-জুন পর্যন্ত দেশের উত্তরে সীমান্তবর্তী এলাকা এবং উজানে অতি বৃষ্টি হয়েছে। অতিবৃষ্টির এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে সীমান্তবর্তী উত্তরাঞ্চল, সিলেট, ময়মনসিংহ রংপুর। স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগণের বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে অনেক জায়গায়। কিন্তু ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম- এই পাঁচ বিভাগে এ বছর অনেক বেশি ঘাটতি রয়ে গেছে।

তেমননিভাবে হিটওয়েভ। জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বর্ষা মৌসুমে এরকম লং হিটস্পেল আসেনি। একই ধারায় কারেন্ট অ্যাটমোস্ফেয়ারিক প্যাটার্ন লক্ষ্য করিনি। সাধারণত যে রকম মুনসুনে যেমন থাকে, সে রকম আসেনি।

কোস্টাল এরিয়াতেও তেমন প্রবাহ আসেনি। এখন পর্যন্ত ভ্যাপসা গরম সবখানে। সেটাও দূরীভূত হচ্ছে না সহজে। তার মানে আমরা সাফার করছি ব্যাপকভাবে।

এ বিশেষজ্ঞের ভাষ্য, “ভবিষ্যতে যখন টেম্পেরেচার ইনক্রিজ করবে, তখন এসব ইভেন্টের ব্যাপকতাও বাড়বে। হয়ত বৃষ্টিবহুল এরিয়ায় আরও বৃষ্টি বাড়বে, কম বৃষ্টির এলাকায় আরও কমে যাবে।

অথবা উল্টো হতে পারে- যেখানে কম হওয়ার কথা সেখানে বৃষ্টি বেড়ে যাবে, আবার যেখানে বেশি হওয়ার কথা সেখানে কম বৃষ্টি হবে। অন্যান্য ফেনোমেনাগুলো মিসলিডিং বিহেভিয়ার করবে। এতে সব খাতে সাফার করবে।

সিলেটে বন্যার অভিজ্ঞতা কী বলে?

এ বছর সিলেট-সুনামগঞ্জের ভয়াবহ বন্যার অভিজ্ঞতা আগামীতে কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, আগাম সতর্কতা দিয়ে বন্যা হয়ত বন্ধ করা যাবে না, তবে ক্ষয়ক্ষতি হয়ত কিছু কমানো যাবে।

তবে বন্যার প্রবণতা বাড়ছে। এখানে নতুন শঙ্কা হচ্ছে নগর বন্যা। বন্যাপ্রবণ দেশে বন্যা হবেই; আগে যেখানে বন্যা হত সেখানে তারা তা মোকাবেলাও করতে জানে। কিন্তু নগর বন্যা হওয়ায় সিলেট-সুনামগঞ্জ শহরে নগরবাসী অনভ্যস্ত থাকায় ক্ষতি বেশি হয়েছে।

তিনি বলেন, “বন্যা ব্যবস্থাপনাটা এমন হতে হবে যেন বন্যায় সবচেয়ে কম ক্ষতি করে। সব করতে হবে বন্যা ম্যানেজ করে; যাতে বন্যার সঙ্গে বসবাস করতে পারি। লিভিং উইথ ফ্লাডস।

দেশের প্লাবনভূমিও অযাচিতভাবে ভরে ফেলা হয়েছে মন্তব্য করে সাইফুল বলেন, “পানি কোথায় যাবে? নদীতে চলে আসবে, নদীর তল দেশ ভরে গেছে। রাস্তা-ঘাট বাড়ি ঘর হাওরাঞ্চলেও অনেক বেড়েছে। ইচ্ছেমত অবকাঠামো হয়েছে, কালভার্ট ঠিক মত দেওয়া হয়নি। শহরগুলোয়ও নগরায়ণ হয়েছে, খাল-বিল দখল হয়েছে জলাভূমি। ভূমির ব্যবহার পাল্টেছে।

আগে বন্যার পানি সহজে নেমে গেলেও এখন তা হচ্ছে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “প্রচুর আর্বানাইজেশন হয়েছে। অপরিকল্পিত বাধের কারণে নাব্যতা সঙ্কট হয়েছে। নদীও অনেক জায়গায় সরু হয়েছে, শহরেও খালবিল দখল হয়েছে। জনবসতি উপচে পড়ছে সবখানে।

জলাধার ভরাট ও অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ বন্ধে জোর দিয়ে বুয়েটের এই শিক্ষক বলেন, “নদীর যে নাব্য হারিয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করতে হবে। ডিটেইল স্টাডি দরকার। অনেক রাস্তাঘাট, অনেক স্থাপনা, ফ্যাক্টরি, মিল হয়েছে। সেগুলো অনেক ক্ষেত্রে পানি প্রবাহের কথা মাথায় রেখে করা হয়নি। এখন থেকে এ জিনিসগুলো সাধারণ মানুষের মাথায় রাখতে হবে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সিলেটের নদীরগুলো থেকে প্রায় সাত থেকে আট বছর ধরে বালি ও পাথর উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। এতে নাব্য কমে যাওয়ায় উজানের ফলে সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে এ সংক্রান্ত কমিটি কাজ করতে পারে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ‍যুগ্মসচিব মোমেনা খাতুন বলেন, “এ এলাকায় পাহাড়ি ঢল ছিল, সহনীয় ছিল; আগে এভাবে ভাসিয়ে নিয়ে যায়নি; ব্যাপক ক্ষতি হয়নি। এবারের অভিজ্ঞতা সামনে দিনগুলোতে কাজে লাগানো হবে। ইতোমধ্যে ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ করা হয়েছে।

আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থাকে কীভাবে আরও ফলপ্রসূ করা যায় এবং সংশ্লিষ্ট জেলা-উপজেলায় আশ্রয়কেন্দ্র বাড়ানো, পরিকল্পনা অনুযায়ী অবকাঠামোগত কাজ করার পরামর্শ রয়েছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

বজ্রপাতে মৃত্যু কমাতে উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে মেমেনা বলেন, “বজ্রপ্রবণ এলাকায় লাইটনিং অ্যারেস্টার ও বজ্রনিরোধক দণ্ড স্থাপন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে হাওর এলাকায় সেইফ সেন্টার ও লাইটনিং অ্যারেস্টার ও বজ্রনিরোধ দণ্ড স্থাপনে আলাদা একটি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে।

আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান জানান, পূর্বাভাস ব্যবস্থার পাশাপাশি আরও বেশি সচেতনতা প্রয়োজন। এ ব্যবস্থা তখনই কার্যকর হয় যখন জনগণ সচেতন হয়। পূর্বাভাস পেলেই সঙ্গে সঙ্গে তা মানতে হবে; তাতে ক্ষতিও কমবে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান বলছেন, দুর্যোগে জানমালের ক্ষতি কমাতে সরকার কাজ করছে।

মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “টেকসই ও নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষে্য সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ওপর মানুষের কোনো হাত নেই। যে কোনো দুর্যোগে জানমালের ক্ষতি কমিয়ে আনতে পূর্ব প্রস্তুতি ও সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই । আর বর্তমান সরকার সে কাজটি করে যাচ্ছে ।

উদ্বেগ দুর্ভোগের

আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান বলেন, “নতুন উদ্বেগের কারণ শুধু সিলেট নয়, পুরো দেশ। আপকামিং যে সিজন, শীতের সিজন সাফার করবে, অলরেডি এগ্রিকালচারাল প্রোডাক্ট এ অঞ্চলে সাফার করছে। এ সাফারিংসটা পরবর্তী সিজনে পড়বে, সয়েলে ময়েশ্চারের ঘাটতি থাকবে; অন্যান্য বিষয়ও রয়েছে। মানে ওই অঞ্চলে অতি বৃষ্টির কারণে দুর্যোগ হয়েছে, আর এ অঞ্চলে অনাবৃষ্টির কারণে আমাদের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে।

তিনি বলেন, “দুর্যোগ সরাসরি বলছি না এটাকে- কিন্তু লো রেইনফলের কারণে ইম্প্যাক্ট অনেক হাই। ক্রপ প্রডাকশনে শুধু নয়, অন্যখানেও এর ব্যাপকতা রয়েছে। খরা যেমন স্লো অনসেট প্রসেস, এটাও তাই। যশোর, খুলনা অঞ্চলে বিশেষ করে জুট প্রডাকশন অনেক হ্যাম্পার করেছে।

দুর্যোগ প্রশমন: বিরূপ আবহাওয়ার অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর পরামর্শ

যে কোয়ালিটির পাট পাওয়ার কথা ছিল, পর্যাপ্ত পানি না পাওয়ার কারণে কোয়ালিটি অঘোষিতভাবে ডিগ্রেড করবে। এরকম অন্যান্য ক্রপের ক্ষেত্রে সিগনিফিক্যান্ট ড্যামেজ লক্ষ্য করা যাবে।

উদাহরণ টেনে মান্নান বলেন, সেপ্টেম্বরে রাঙামাটিতে শুধু ৮০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। উপকূলীয় উপজেলায় কুতুবদিয়ায় এমনিতে এ সময়ে হাজার মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়, সেখানেও অনেক কম।

বৃষ্টি কম হওয়ার কারণে রাঙামাটিতে স্বাভাবিক কিছু ক্রপ লাগাতে পারেনি। পাহাড়ে তো ইরিগেশন সম্ভব নয়। যেখানে ৭০০ মিলিমিটার থেকে ১০০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হওয়ার কথা, সেখানে মাত্র ৮০ মিলিমিটার বৃষ্টি! সেখানে প্রডাকশন হ্যাম্পার হলে তা সিগনিফিক্যান্ট লস। যে পরিমাণ ফসল হওয়ার কথা, তা অনেক কমে যাবে পাহাড়ে।

সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এগুলো বিবেচনায় রাখার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের রেডি থাকতে হবে- হাই টেম্পেরেচার হলে কীভাবে অ্যাডাপ্ট করব; লো টেম্পেরেচার হলে কী করব; হাই রেইনফল হলে কীভাবে অ্যাডাপ্ট করব, লো রেইনফল হলে কিছু একটা অ্যাডাপটেশন থাকতে হবে। শুধু প্রডাকশন নয়, আরও যত ইন্ডাস্ট্রি আছে এমনভাবে রেডি রাখতে হবে যাতে, এটা যেন সহনশীল পর্যায়ে থাকে।

বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস; বাংলাদেশে এবার ‘দুর্যোগে আগাম সতর্কবার্তা, সবার জন্য কার্যব্যবস্থাপ্রতিপাদ্যে দিবসটি পালন করা হবে।

 

Share if you like

Filter By Topic