Loading...
The Financial Express

তপন সিনহা: চলচ্চিত্রে মানুষের ওপর আস্থা

| Updated: October 04, 2022 14:10:36


তপন সিনহা (১৯২৪-২০০৯), ছবি: টাইমস অভ ইন্ডিয়া তপন সিনহা (১৯২৪-২০০৯), ছবি: টাইমস অভ ইন্ডিয়া

ছোট্ট মেয়ে মিনি আর তার সাথে সখ্য গড়ে ওঠা আফগান কাবুলিওয়ালা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গল্প প্রায় সবারই পড়া। তবে এই গল্পকে ১৯৫৭ সালে চলচ্চিত্রে নিয়ে এসে হইচই ফেলে দেন তপন সিংহ। এর আগে আরো দুটো সিনেমা বানিয়েছিলেন তিনি। বিলি ওয়াইল্ডার, জন ফোর্ডদের কাজ দেখে অণুপ্রাণিত ছিলেন তিনি। আমেরিকায় সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা রাখা তপন সিনহা দেশে ফিরে চলচ্চিত্র পরিচালকই হয়ে উঠলেন।

সে সময়ের চলচ্চিত্রে সাহিত্যের রূপায়ন কেবল শুরু হয়েছে। অগ্রদূত (বিভূতি লাহা) আশাপূর্ণা দেবীর কাহিনী নিয়ে 'অগ্নিপরীক্ষা' নির্মাণ করেছেন। তবে এর আগে চলচ্চিত্রে ছিলো কিছু চিরাচরিত ফর্মুলার প্রয়োগ, যা বাণিজ্যিক সাফল্যের জন্য অনিবার্য মনে করা হতো। যেমন - চড়া গলায় সংলাপ, মেলোড্রামা, পৌরাণিক গান ইত্যাদি।

বিমল রায় বা বিভূতি লাহা তখন সেসব থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তবমুখীভাবে বাণিজ্যিক সফলতা তথা দর্শক পেতে চাইছেন। তপন সিনহা এই চিন্তার পালে নতুন হাওয়া দেন।

মৃণাল সেন বা ঋত্বিক ঘটকের মতো একেবারে নিরীক্ষার দিকে তিনি গেলেন না, ধরে নিলেন মাঝামাঝি পথ। জনপ্রিয় ও জীবনবোধসম্পন্ন সাহিত্যগুলোকে সিনেমায় রূপায়ন করতে থাকলেন। পাশাপাশি তিনি নজর দিলেন চলচ্চিত্রগুলোকে হৃদয়গ্রাহী করতে।

যেমন - কাবুলিওয়ালায় ছবি বিশ্বাস এর অভিনয়ে মনে হবে যেন সত্যি দূরদেশ থেকে নিঃসঙ্গ এক মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়। সিনেমার পর্দায় দেখা সেই চরিত্র কোন অতিমানব নয়, সাধারণেরই মতো অনুভূতিসম্পন্ন সাধারণ এক মানুষ। সেখানে মেয়েকে ছেড়ে এসে এখানে আরেকজনকে মেয়ের স্থান দিয়েছে।

     
কাবুলিওয়ালা (১৯৫৭) ছবির দৃশ্যে ছবি বিশ্বাস,  ছবি: টাইমস অভ ইন্ডিয়া

তপন সিনহা তার সিনেমায় সবসময় মানুষের সংবেদনশীলতাকে ছুঁতে চেয়েছেন।

জতুগৃহ (১৯৬৩) ছবির কথাই ধরা যাক। প্রধান একটি চরিত্রে মহানায়ক উত্তম কুমার। তার খুব শখ ছিলো সন্তানের। কিন্তু স্ত্রী সন্তান ধারণ করতে না পারায় তাদের বিচ্ছেদ ঘটে। তখন পুরুষ চরিত্রটির (উত্তম কুমার) মনে ছিলো সমাজের কটু কথা শোনার ভয়, পিতৃত্বের স্বাদ ও উত্তরাধিকার পাবার আকাঙ্খা।

কিন্তু অনেকদিন পর আবার যখন দেখা হলো, তখন দুজনেই বোঝে তারা এখন কোনো সম্পর্কে না থাকলেও তাদের পরস্পরের প্রতি থাকা অনুভূতি একটুও মরে যায়নি। এখানেই দর্শক হৃদয়ের সংবেদন ধাক্কা খায়। কাগজে কলমে যে সম্পর্ক নেই, কিন্তু এই যে অনুভূতি - এটি কি সম্পর্ক নয়?ঞ

তাছাড়া, তপন সিনহা দুটো চরিত্রের কাউকেই দেবতা বা শয়তান বানাননি। উভয়ে মানুষ- অন্য দশটি মানুষের মত। তাই সমাজের চাপ এড়ানো যায়না, আবার তাই বলে ঘৃণা এসে যায় - তাও নয়। একসময় বিচ্ছেদ ঘটলেও অনুভূতি মরে যায়না।  

 জতুগৃহ (১৯৬৩) ছবির একটি দৃশ্য, ছবি: আইএমডিবি

তপন ঝিন্দের বন্দী (১৯৬১) নির্মাণ করে ব্যাপক সাড়া ফেলেন। সত্যজিতের 'অপু' সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে খলচরিত্র ময়ূরবাহনে নির্বাচন করে অন্যরকম একটি নিরীক্ষা করেন। ছবিটি সুপারহিট হয়। এরফলে উত্তম-সৌমিত্র নায়ক-খলনায়ক জুটিও তৈরি হয়েছিল, যা আরো কিছু বাংলা সিনেমায় আমরা দেখি।

তপন সিনহার 'হাটে বাজারে' (১৯৬৭) দেখায় একজন মানবিক চিকিৎসক (অশোক কুমার) এর জীবন। যিনি শুধু রোগীদের সেবা দেননা, বরং অসহায় একজন বিধবাকেও স্থানীয় জমিদারের ছেলে লম্পট লছমনলাল এর থেকে রক্ষা করেন। লছমন এর চরিত্রে প্রখ্যাত মঞ্চঅভিনেতা অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় ছিলো সবার মুখে মুখে। এছাড়া বৈজয়ন্তীমালাকে সেই বিধবার চরিত্রে কাস্ট করে তপন চমক দেখান।

তার চলচ্চিত্রে ব্যক্তির বিকাশ, তাদের চিন্তা ও মতের বিকাশ অনেক বড় একটি জায়গা জুড়ে ছিলো। তিনি সমষ্টির চাপের কাছে ব্যক্তির নতিস্বীকার কিংবা সামষ্টিক চাপের মুখে ব্যক্তিগত বিবেক বিসর্জন দেয়ার পক্ষে ছিলেন না। তাই যখন সাম্যবাদ কিংবা প্রগতির নামে ব্যক্তিত্বের বিকাশ রোধ করা হয়, সেটিও সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হয়েছে তার সেলুলয়েডে।


সাগিনা মাহাতো (১৯৭০) সিনেমার পোস্টার, ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

১৯৭০ এ গৌরকিশোর ঘোষের লেখা 'সাগিনা মাহাতো' গল্প অবলম্বনে নির্মিত সিনেমাটিতে এমনটি ঘটতে দেখা যায়। চা শ্রমিকদের নেতা সাগিনা মাহাতো (দিলীপ কুমার) ইংরেজদের বিরুদ্ধে তাদের সংগঠিত করে। বামপন্থী এক পার্টির নির্দেশে কমরেড অমল আসেন তাকে সাহায্য করতে। কিন্তু তিনি সংকটের সময় তাদের জন্য আর ঝাঁপিয়ে পড়েন না। পার্টির নির্দেশে নির্লিপ্ত থাকতে দেখা যায় অমলকে। এখানেই কর্তৃত্বের বিপরীতে প্রশ্ন তোলেন তপন সিনহা। তিনি বিশ্বাস করতেন সামষ্টিক এই কর্তৃত্ব ব্যক্তির নিজস্ব বিবেক ও সংবেদনশীলতা নষ্ট করে।

তবে মানুষের সামর্থ্য নিয়ে বরাবরই আশাবাদী ছিলেন তিনি। তপন সিনহা বিশ্বাস করতেন, মানুষের ভেতরের আশাবাদ যতদিন থাকে, ততদিন পর্যন্ত নতুন সম্ভাবনা তার জীবনে ধরা দিতে পারে। ১৯৮০ সালে করা তার বিখ্যাত সিনেমা 'বাঞ্ছারামের বাগান' - এ এই ব্যাপারটিই তুলে ধরেন। মূল লেখাটি ছিলো মনোজ মিত্রের একটি নাটক। সেটিকে চলচ্চিত্রে রূপ দেন তিনি।  

এখানে দেখা যায় অশীতিপর বৃদ্ধ বাঞ্ছারামকে, তার জীবনের অবলম্বন ও বেঁচে থাকার মধ্যকার সম্পর্ককে। যখন তার নাতি তাকে ছেড়ে চলে যায়, তখন সে আস্তে আস্তে মৃত্যুর দিকে আগাচ্ছিলো। তার বিশাল বাগানের ওপর জমিদারের নজর ছিলোই। কিন্তু বান্ছা পরে ঘটনাচক্রে তার নাতি, নাত বৌ ও তাদের ছেলেকে পেয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখে।

 

    বান্ছারামের বাগান (১৯৮০) সিনেমার পোস্টার, ছবি: টাইমস অভ ইন্ডিয়া

এদিকে জমিদারের ঘুম না হওয়ার ব্যাপারটি দিয়ে সাফল্য আর স্বাচ্ছন্দ্য যে এক নয় তাও বুঝিয়েছেন। মানুষ যতদিন পর্যন্ত জীবন নিয়ে আশাবাদ রাখে, ততদিন সে মরতে পারেনা- এমন  বার্তাই ছিলো এই সিনেমায়।

নারী চরিত্রগুলোকে লড়াকু হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন তিনি। 'আদালত ও একটি মেয়ে' (১৯৮২) সিনেমায় শিক্ষিকা উর্মিলা (তনুজা) যখন ধর্ষিত হয়, তখন প্রভাবশালী বিরোধীপক্ষের উকিল তাকে বারবার অপদস্ত করেন। উর্মিলা তাতে হার মেনে নেয়না। কিন্তু ভেঙে পড়ার ব্যাপারটা ঘটে। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দেয়া উর্মিলার প্রতি তার বাবাকে বলতে শুনি- ' লড়াই করতে হলে বাঁচতে হবে, বাঁচতে হলে খেতেও হবে।'

অফিসের সহকর্মীদের বিব্রতকর প্রশ্নে চপেটাঘাত হিসেবে তিনি নিজের টেবিলে বড় করে কাগজ সাঁটিয়ে রাখেন। সেখানে লেখা- 'আমার ধর্ষিতা কন্যা ভালো আছে।'

এখানে প্রথাগত ফর্মুলা ফিল্মের মত কোনো নায়ক এসে শিক্ষিকাকে বাঁচায় না। তার চাকরিও চলে যায়- কারণ প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেতে চায়না, তাদের 'সম্মান' এতে ক্ষুণ্ণ হয়।

কিন্তু শেষপর্যন্ত নিম্ন আদালতে উর্মিলা তার পক্ষে রায় পান। সহকর্মীদের সহায়তায় প্রতিষ্ঠানের চাকরিও ফিরে পান।

তবে এখানেও তপন বাস্তবতার কাছাকাছি থেকেছেন। অনেকসময় প্রভাবশালী আসামীরা উচ্চ আদালত থেকে খালাস পান, বারবার মামলার তদন্ত প্রতিবেদন পেছায়- এও অজানা নয়। তাই উচ্চ আদালতে কী হলো তা আর আমরা জানতে পারিনা। আসলে কী হতে পারে সেটার ভাবনা তিনি ছেড়ে দিয়েছেন দর্শকদের হাতেই।

          
আদালত ও একটি মেয়ে (১৯৮২) সিনেমার পোস্টার, ছবি: স্ক্রল.ইন

তবে সত্যের জয় যে সবসময় হয়না, হলেও চড়া মূল্য চুকোতে হয়, তাও দেখিয়েছেন 'আতঙ্ক' (১৯৮৬) সিনেমায়। এক নিরীহ স্কুলশিক্ষক (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) ঝুম বৃষ্টির এক রাতে একটি হত্যাকাণ্ড দেখে ফেলেন। তিনি চুপ থাকেন নি। ফলে তার মেয়ের (শতাব্দী রায়) মুখ এসিড মেরে ঝলসে দেয় সেই অপরাধীরাই। শেষপর্যন্ত নিহতের পরিবার বিচার পেলেও শিক্ষকের মেয়ের মুখ ঝলসে যায় চিরকালের মতো।

কোনোরকম সম্পর্ক বা স্বার্থ না থাকলেও শুধু যে মানুষ হয়েই মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায় তার প্রমাণ তিনি রেখেছেন আরো কিছু চলচ্চিত্রে।

তপন সিনহা শংকরের 'এক যে ছিলো দেশ', সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'সবুজ দ্বীপের রাজা' (কাকাবাবু সিরিজ) ও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ' আজব গাঁয়ের আজব কথা'- কে চলচ্চিত্রের রূপ দেন। এগুলো কিশোরতোষ চলচ্চিত্র, তবে গভীর ম্যাসেজ আছে। আছে ফ্যান্টাসির ভেতর বাস্তবতা দেখার প্রবণতা। যেমন- 'এক যে ছিলো দেশ ' -এ একজন বিজ্ঞানী এমন এক যন্ত্র আবিষ্কার করেন যা মানুষের মনের নেতিবাচক ইচ্ছাগুলো প্রকাশ করে ফেলে। এই আবিষ্কার তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।

              খলচরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে ধারা ভেঙেছিলেন 'ঝিন্দের বন্দী'-তে, ছবি: আইএমডিবি

তপন সিনহাকে নিয়ে আরো অনেক কিছু লেখা বা বলা যায়। তবে তার চলচ্চিত্রের একেবারে কোর যে জায়গা- সেটি হলো মানুষের মানবিকতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যর বিকাশ। আর এই স্বাতন্ত্র‍্য নিয়ে সহাবস্থান। সমষ্টির চাপে ব্যক্তিত্ব হারানো নয়, বরং স্বীয় স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব নিয়েই সবাই সবার জন্য হাত বাড়ানো।

কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার কবিতায় (কোথাও মানুষ ভালো র'য়ে গেছে ব'লে) তে লিখেছিলেন - "তথাপি মানুষ আজও শিশুকে দেখলে নম্র হয়, জননীর কোলে মাথা রাখে, উপোসেও রমণীকে বুকে টানে- কারো সাধ্য নেই একেবারে নষ্ট করে তাকে।"

কবিতার এই কথাগুলোর মত করে মানুষের নিজস্ব সংবেদনশীলতা ও মানবিকতার প্রতি সুদৃঢ় বিশ্বাস নিয়েই নির্মিত তপন সিংহের চলচ্চিত্র।

 

মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী

[email protected]

Share if you like

Filter By Topic