কিছুদিন আগেও যে সময়ে সে স্কুলে যেত এখন তারও আগে ঘুম থেকে উঠে লেগে যেতে হয় কাজে। আনন্দের সেই দিনগুলো ফুরিয়ে গেছে হঠাৎ করেই। ১৩ বছর বয়সেই নেমে পড়তে হয়েছে উপাজর্নের কঠিন পথে। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
খুব সকালে শুরু হওয়া কর্মঘণ্টা শেষ হতে হতে প্রায়ই রাত ১১টা বেজে যায়। পরিবারের জন্য এমন কষ্ট নিরুপায় হয়েই মেনে নিতে হয়েছে এই শিশু বয়সে।
এমন দিনলিপি শুধু ওই একটি শিশুর নয়, জীবনের নানা দুর্বিপাকে পড়ে কাজে লেগে যাওয়া তার মত কয়েকশ শিশুর; যারা শ্রম বিক্রি করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯টি আবাসিক হলের ক্যান্টিন, মুদি ও চায়ের দোকানগুলোতে।
এদের সবারই বয়স ১৪ বছরের কম। পরিবারকে একটু আর্থিক স্বস্তি দিতে বয়সভেদে মাসে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত পারিশ্রমিকে কাজ করছেন তারা দিনের পর দিন।
তাদেরই একজন সেই ১৩ বছরের শিশুটি কাজ করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হকের ক্যান্টিনে। ক্যান্টিন বয় হিসেবে দিনে দীর্ঘ ১৪-১৫ ঘণ্টা খাটুনির পর দৈনিক পারিশ্রমিক মেলে একশ ঢাকা। এ কয়টি টাকাও তার পরিবারের কাছে অনেক কিছু।
যে কারণে স্কুলে যাওয়া বন্ধ রেখে চাঁদপুর থেকে তাকে ক্যান্টিনে কাজ করতে পাঠাতে বাধ্য হয়েছে পরিবারটি।
অথচ বাবা বেঁচে থাকার সময় সব কিছুই ভালোই চলছিল; নিয়মিত স্কুলে যেত, পড়ালেখা ও খেলাধুলা করেই সময় কাটত। সব কিছু ওলটপালট হয়ে যায় চাঁদপুরের পঞ্চম শ্রেণির এ শিশু শিক্ষার্থীর হঠাৎ করেই।
এবছর নতুন ক্লাসে ওঠার পর আকস্মিকভাবে মৃত্যু হয় তার বাবার। এরপর থেকে তার ঠিকানা এখন শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হকের ক্যান্টিন।
উচ্চ শিক্ষারত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য পরিচালিত ক্যান্টিনগুলোতে সহায়তা করে ও ফুট ফরমায়েশ খেটে কেটে যায় তাদের দিনগুলো। জ্ঞানের আলো ছড়ানো শতবর্ষী এ বিদ্যাপীঠে তারাই বঞ্চিত শিক্ষা থেকে। জাতির এ বাতিঘরের আলোর মধ্যে বছরের পর ব্ছর চলে আসা এই ‘শিশুশ্রম’ যেন এক ‘অন্ধকার’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান দীর্ঘদিন থেকে চলে শিশুদের কাজ বন্ধ করার ব্যবস্থা চাইলেই করা যাবে না বলে মনে করেন। তিনি ছাত্রসহ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে তাদের পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে পরামর্শ দেন এবং প্রয়োজনে সহায়তা করার কথাও বলেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনগুলোতে ঐতিহাসিকভাবেই ছোট ছেলে মেয়েরা কাজ করতে আসছে; যারা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কাজেও নিয়োজিত আছে।
পারিবারিক অনাটন ও বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় এসব শিশুদের ‘তাড়িয়ে দেওয়া’ যায় না মন্তব্য করে উপাচার্য বলেন, সভ্য বা উন্নত দেশে এগুলো নাই। আমাদের দেশে ওই পর্যায়ে পৌঁছাতে হয়ত আরেকটু সময় লাগবে। যখন কোনো শিশুই এ ধরনের কোনো কাজরে সঙ্গে আসবে না। সেটির জন্য হয়ত আরও পাঁচ থেকে ১০ বছর সময় লাগবে।
“এখন এগুলো দেখে খুবই খারাপ লাগে, মাঝে মাঝে খুবই কষ্ট লাগে, এই শিশুটাতো এখন বাবা মায়ের আদরে থাকার কথা, স্কুলে থাকার কথা। সেটা রেখে এখন ক্যান্টিনে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে, এটা খুবই দুঃখজনক, বেদনাতুর।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে গত কয়েকদিন ঘুরে দেখা যায়, হলের প্রতিটি ক্যান্টিনে ৪-৫ জন শিশু শ্রমিক রয়েছে। তারা ক্যান্টিনে ও দোকানগুলোতে খাবার বিতরণ শুরু করে টেবিল পরিষ্কার, পানি আনাসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করছে। এছাড়া ক্যাম্পাসে অনেক শিশুকে ফুল বিক্রি করতেও দেখা যায়।
পারিবারিক অনটন ও পেটের দায়েই বাধ্য হয়ে তারা পড়ালেখা ছেড়ে কাজে নেমেছেন। তবে সুযোগ পেলে আবার স্কুলে ফেরার ইচ্ছার কথাও মাঝেমধ্যেই উঁকি দেয় তাদের মধ্যে।
“ইচ্ছে করে ক্যান্টিনে কাজ করতে আসিনি। আমার ইচ্ছা ছিল পড়ালেখা করার। কিন্তু সবার ভাগ্যে পড়ালেখা জুটে না। গরিব হওয়ার জন্যই আমাকে এখানে আসতে হয়েছে,” হতাশ কণ্ঠে বলছিল চাঁদপুরের পঞ্চম শ্রেণির শিশুটি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সে জানায়, বাবার মৃত্যুর ছয় মাস পর তাদের পরিবার আর চলছিল না। দুই বছরের বড় এ ভাই থাকলেও সেও তেমন আয়-উপার্জন করতে পারছে না। এ কারণে তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়।
আরেক ক্যান্টিন বয় জানায়, সে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু পরিবার তার পড়ালেখার খরচ চালাতে পারছিল না।
“পরিবারের অব্স্থা দেখে আর আর ভালো লাগছিল না পড়ালেখা করতে। তাই বাধ্য হয়ে ক্যান্টিনে কাজ নিয়েছি।”
শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ক্যান্টিন পরিচালক জাহাঙ্গীর হোসেন বেশির ভাগ শিশুদের আসার কারণ পরিবারের দারিদ্রতা বলে জানান।
তিনি বলেন, আমরা ওদের নিতে চাইনি। ওরা আমাদের এলাকারই। পারিবারিক দুর্দশা দেখে ওদের এখানে নিয়ে এসেছি।
“বাড়িতে খেয়ে-পরে তাদের বেঁচে থাকা কঠিন। এখানে ওরা ভালো-মন্দ খেয়ে বাঁচতে পারছে, কিছু পারিশ্রমিকও পাচ্ছে, যা তাদের পরিবারের জন্য পাঠাতে পারছে।”
পড়ালেখা থেকে বঞ্চিত হওয়ার প্রশ্নে জাহাঙ্গীর বলেন, পেট বাঁচলে তো পড়ালেখা।
আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সংগঠন ক্যান্টিন বয়দের পড়ালেখার ব্যবস্থা করত, ক্লাস নিত। তবে কোভিড মহামারীর পর এখন আর কেউ তেমন নিচ্ছে না। চাইলে ক্যান্টিনের কাজের ফাঁকে তারা কয়েক ঘণ্টা পড়ালেখা করতে পারে বলে ওই ক্যান্টিন ব্যবস্থাপক জানান।
নামমাত্র টাকায় ক্যান্টিন বা দোকানে দীর্ঘ সময় পরিশ্রম করার পরও বকাঝকা ও খারাপ আচরণেরও শিকার হতে এসব শিশু শ্রমিকদের। মারধর-মানসিক নির্যাতনের মুখেও পড়তে হয় কাউকে কাউকে। মাঝে মাঝে ছাত্রনেতারাও ক্যান্টিন বয়দের দিয়ে রুমে খাবার নিয়ে যান, একটু এদিক সেদিক হলে হজম করতে হয় তাদের ধমক ও চোখ রাঙানি।
হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলের এক ক্যন্টিন বয় জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষিত হলেও কেউ কেউ আমাদের সাথে খারাপ আচরণ করে, রুমে খাবার নিয়ে যেতে হুকুম দেয়। সময়মত না গেলে ধমক খেতে হয়। এছাড়া ক্যান্টিন মালিকের শাসানি তো আছেই।
শিশুদের কাজে লাগানোর কারণ হিসেবে সামনে এসেছে খরচ কমানোর বিষয়টি। খাবারের দাম শিক্ষার্থীদের নাগালে রাখতে কম পারিশ্রমিকে তাদের কাজে নেওয়া হয় বলে জানান বেশ কয়েকটি হলের ক্যান্টিন পরিচালক ও দোকান মালিক।
তারা জানান, কম টাকায় ভালো খাবার দিতে হয়। তা না হলে নানা ধরনের চাপ আসে। বেশি বেতনে প্রাপ্ত বয়স্ক শ্রমিক রেখে খাবার সরবরাহ করা হলে দামও বেশি পড়বে।
তবে এসব শিশু শ্রমিকরা যাতে ন্যূনতম পড়ালেখা করতে পারে, সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন অনেকেই।
বাংলাদেশের শিশু আইন, ২০১৩ অনুসারে, অনুর্ধ্ব ১৮ (আঠার) বছর বয়স পর্যন্ত সবাই শিশু হিসেবে গণ্য হবে।
আর বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এ বলা হয়েছে, শিশুদের ন্যূনতম বয়স ১৪ বছর। এর কম বয়সীদের কাজে নিয়োগ করা যাবে না। শিশুর অভিভাবক কাজ করানোর জন্য কারও সঙ্গে কোনো প্রকার চুক্তি করতে পারবেন না।
তবে দেশের অনেক জায়গার মত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিন ও দোকানগুলোতে এ আইনের প্রয়োগ দেখা যায় না; কখনও চেষ্টা হয়েছে তেমনটাও শোনা যায়নি।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্যান্টিনগুলোতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিলে শিশু শ্রমিক থাকবে না বলে মনে করেন ডাকসুর সাবেক সদস্য তানভীর হাসান সৈকত, যিনি সুবিধা-বঞ্চিত শিশুদের অধিকার নিয়েও কাজ করেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু মেসগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেখানে কিন্তু শিশুশ্রম নাই। ক্যান্টিনগুলোতে কেন আছে? এর কারণ সেখানে বরাদ্দ থাকে না এবং কম টাকায় শিক্ষার্থীদের খাওয়াতে চাপ দেওয়া হয়। ফলে ক্যান্টিন মালিকরা কম মজুরিতে শিশু শ্রমিক রাখে।“
নিতান্ত বাধ্য হলে তাদের স্কুলে ভর্তি করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পাঠদানের ব্যবস্থা করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
আলোর পথ দেখাবে কে?
করোনাভাইরাস মহামারীর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পরিচালিত বিভিন্ন ভ্রাম্যমাণ স্কুল ক্যাম্পাসের ক্যান্টিন বয়সহ সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের সপ্তাহে দুয়েকদিন পাঠদান করত। টিএসসি, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তাদের পড়ানো হত। মহামারী পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর সেই চিত্র আর তেমন দেখা যায় না।
তেমনই একটি উদ্যোগ ‘ঘাসফুল স্কুল’ এর সাধারণ সম্পাদক মো. আজিমুল হক জানান, মহামারীতে কর্মী কমে যাওয়ায় স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর টিএসসিতে পথশিশুদেরটা চালু হলেও ক্যান্টিন বয়দেরটা আপাতত বন্ধ।
এটি আবার চালু করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ক্যান্টিন বয়রা কর্মক্ষেত্রে স্থায়ী না হওয়ায় তাদের পাঠদান করানো চ্যালেঞ্জিং।
“নতুন স্টুডেন্ট আসে, ওদেরকে পড়াই, ওরা আবার চলে যায়। যাদের লংটাইম পাচ্ছি, তাদের নীলক্ষেত প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিচ্ছি। তাদের বই খাতা থেকে শুরু করে পাঠদানে বিভিন্ন সহায়তা করা হচ্ছে,” যোগ করেন তিনি।
‘সেভ দ্য ফিউচার’ নামে আরেকটি সংগঠন দেশে বর্তমানে ১৭টি ভ্রাম্যমাণ স্কুল পরিচালনা করছে। হাইকোর্ট মাজার গেইটে তাদের স্কুলটা চালু আছে। সংগঠনের সহকারী নির্বাহী পরিচালক হীরন তালুকদার হলের ক্যান্টিন বয় বা চায়ের দোকানের শিশুশ্রমিকদের নিয়ে পরিচালিত টিএসসির স্কুলটা কিছু দিনের মধ্যে চালু করার কথা জানান।
শিশুদের পড়ালেখার বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান জানান, কিছু শিক্ষার্থী ভ্রাম্যমাণ স্কুলের মাধ্যমে তাদের পড়িয়ে থাকে। তিনি ছাত্র থাকাকালেও এমন উদ্যোগ ছিল। শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় সহায়তা করতে নৈশ স্কুল ছিল। বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হত। এখন শিক্ষার্থীদের কিছু কিছু সংগঠন আছে, যারা চেষ্টা করছে।
তিনি বলেন, আমার কাছে সেদিনও বেশ কয়েকটা সংগঠনের ওরা আসছে, ওদেরকে আমি পরামর্শ দিয়েছি, ওই শিশুদের জন্য কাজ করতে।
“বিশেষায়িত উদ্যোগ নিতে বলেছি, ওপেন ইউনিভার্সিটির সঙ্গে সমন্বয় করে আমাদের যে ভেন্যু আছে, সেগুলো ব্যবহার করে উদ্যোগ নিতে বলেছি।”