ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘুরে ডেঙ্গু আক্রান্ত ভাইকে নিয়ে এসেছেন রাজধানীর হলি ফ্যামিলি রেডক্রিসেন্ট হাসপাতালে। মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি পিরোজপুরের শাহাদাত হোসেনের অবস্থা তুলে ধরে তার ভাই শাখাওয়াত হোসেন জানান, দ্রুত প্লাটিলেট কমতে থাকায় গত শনিবার ঢাকায় সরাসরি হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
ভাইকে নিয়ে চিন্তিত সাখাওয়াত বলেন, “পরীক্ষায় দেখি প্লাটিলেট কমে ৪৫ হাজার হইয়া গেছে, একপর্যায়ে তা ৮ হাজারে নেমে যায়। প্রথমে ঢাকা মেডিকেলে নিছিলাম, খুব ভিড়। সিট পাওয়া যায় না, তাই এই হাসপাতালে চলে আসছি।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, সম্প্রতি ঢাকায় এসেছিলেন শাহাদাত। বাড়ি ফিরে জ্বরাক্রান্ত হলে পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়ে। পরে অবস্থা খারাপ হতে থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শে দ্রুত ঢাকায় নিয়ে আসেন।
শুধু শাহাদাত নয়, এবারের ডেঙ্গু প্রকোপের মধ্যে আক্রান্ত ছোট বড় সব বয়সী রোগীদের অনেকের প্লাটিলেট (রক্তকণিকার সবচেয়ে ছোট কণিকা হল প্লাটিলেট বা অনুচক্রিকা, যা রক্ত জমাট বাঁধতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে) দ্রুত কমে যাচ্ছে বলে দেখতে পাচ্ছেন চিকিৎসকরা। অনেক সময় রোগী বা পরিবারের সদস্যরা বুঝতেও পারছেন না এমনটি ঘটছে।
এ কারণে ডেঙ্গু রোগীদের অনেকের অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটছে। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের বড় অংশের রক্ত লাগছে এবং কেউ কেউ শকে চলে যাচ্ছেন-যাদের কাউকে কাউকে আর ফেরানো যাচ্ছে না, যা মৃত্যু বাড়াচ্ছে বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এইডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর জন্য বন্ধুদের রক্ত চেয়ে আহ্বানও চোখে পড়ছে হরহামেশা। পোস্টগুলোর বেশির ভাগই বলছে প্লাটিলেট কমে যাওয়ায় জরুরিভিত্তিতে রক্ত লাগছে একাধিক ব্যাগ। ফেইসবুকভিত্তিক ‘ব্লাগ গ্রুপ’গুলোতেও ডেঙ্গু রোগীর জন্য রক্ত চেয়ে পোস্ট বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্লাটিলেট দ্রুত কমছে, কিন্তু সেই গতিতে বাড়ছে না, ফলে হাসপাতালে অবস্থান করতে হচ্ছে বেশি দিন। রোগীর নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দিচ্ছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেই দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, রোববার সকাল আটটা পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় ৩৭ হাজার ১৫১ জনকে। এ বছর এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ১৩৬ জনের।
হলিফ্যামিলি হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, প্লাটিলেট দ্রুত কমে যাচ্ছে এ ধরনের রোগী এবার বেশি পাওয়া যাচ্ছে।
“দেখা যাচ্ছে প্লাটিলেট কমে ১০-১৫ হাজারে চলে আসছে, এবার এই হার খুব বেশি। রোগীকে প্লাটিলেট দেওয়ার পরও তা আগের অবস্থায় ফিরতে তুলনামূলকভাবে সময় বেশি লাগছে, রোগীকেও হাসপাতালে বেশি দিন থাকতে হচ্ছে।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্লাটিলেট কমে গেলে রক্তক্ষরণসহ নানা ঝুঁকি তৈরি হয়।
“দাঁতের গোড়ায়, বমির সঙ্গে, পায়খানার সঙ্গে বা শরীরের যে কোনো অঙ্গে রক্তরক্ষণ হয়। পেটে, বুকে পানি জমে যায়। ফলে রোগী শকে চলে যেতে পারে, মৃত্যুও হতে পারে।”
তার পরামর্শ, ঝুঁকি এড়াতে প্লাটিলেট এক লাখের নিচে নামলেই রোগীকে হাসপাতালে নেওয়া উচিত।
জনস হপকিন্স মেডিসিনের তথ্য অনুযায়ী, একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের শরীরের প্রতি মাইক্রোলিটার রক্তে প্লাটিলেটের মাত্রা দেড় লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ পর্যন্ত।
প্লাটিলেটের মূল কাজ রক্ত জমাটে সহায়তা করা, কোনো জায়গায় ক্ষত হলে তা পূরণ করা। এই রক্তকণিকা কমে গেলে রক্তক্ষরণসহ নানা জটিলতা দেখা দেয়। এর পরিমাণ দেড় লাখের কম হলেই তা ঝুঁকি তৈরি করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের মত।
হাসপাতালের চিত্র
মহাখালীর বাসিন্দা শামসুল মিয়ার ছেলে আল আমিনের জ্বর হলে মহাখালীর ডিএনসিসি হাসপাতালে নিয়ে আসেন। ছেলের শরীরে প্লাটিলেট যে এত কমে গেছে তা জানতেন না।
“জ্বরের সঙ্গে বমি, পাতলা পায়খানা হচ্ছিল। মঙ্গলবার বাসার পাশের একটি চেম্বারে একজন ডাক্তারকে দেখাই। তিনি রক্ত পরীক্ষা দেন, পরীক্ষায় বুধবার দেখি প্লাটিলেট নেমে গেছে ২২ হাজারে। ওইদিনই হাসপাতালে ভর্তি হই। হাসপাতালে ভর্তি হয়ে পরেরদিন আবার পরীক্ষা করে দেখি তা আরও কমে ১০ হাজার হয়ে গেছে। ডাক্তার বলেছে রক্ত রেডি রাখতে,” বলেন ছেলের স্বাস্থ্য নিয়ে শঙ্কিত এ পিতা।
একই হাসপাতালে ভর্তি বাড্ডার বাসিন্দা আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, ছয় দিন ধরে জ্বরে আক্রান্ত তিনি। সোমবার চিকিৎসকের কাছে গেলে রক্ত পরীক্ষা করতে দেন। মঙ্গলবার পরীক্ষায় দেখা যায় প্লাটিলেট কমে ২৩ হাজারে নেমেছে।
“যেই হাসপাতালে পরীক্ষা করাইছি তারাই দেইখা কয় তাড়াতাড়ি হাসপাতালে ভর্তি হইতে। পরে এইখানে আইসা ভর্তি হইছি। বুধবার আবার পরীক্ষা কইরা দেখি ৬ হাজার হইয়া গেছে। ডাক্তার ওষুধ দিছে, খাচ্ছি। এখনও রক্তের কথা কয় নাই।”
খিলগাঁওয়ের খিদমাহ হাসপাতাল ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হয়েছেন শনির আখড়ার বাসিন্দা আহমেদ হোসেন। ওই হাসপাতালেই এ রোগে আক্রান্ত তার স্ত্রীও ভর্তি হয়েছেন।
এ দম্পতির মেয়ে নুরুন্নাহার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, রোববার তার বাবার রক্তের নমুনা পরীক্ষায় প্লাটিলেট পাওয়া যায় ১ লাখ ৪০ হাজার। সোমবার তা নেমে আসে ৬৮ হাজারে। পরদিন আরও কমে ৪০ হাজারে নেমে যায়।
“আব্বার বমি হচ্ছিল, দম বন্ধ হয়ে আসছে। মাথা ব্যাথা, শরীর ব্যাথাও রয়েছে। আব্বা বলছে, তার খুব খারাপ লাগছে,” যোগ করেন তিনি।
রাজধানীর একটি কলেজের ছাত্র মো. নজরুল ইসলাম ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত রোববার যখন খিদমাহ হাসপাতালে ভর্তি হন তখন তার প্লাটিলেট নেমে গিয়েছিল ১৮ হাজারে।
তার মা আনোয়ারা বেগম বলেন, তিন দিন আগে জ্বর আসলে বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। তবে অবস্থা খারাপ হলে হাসপাতালে আসেন, পরীক্ষায় দেখেন প্লাটিলেট কমে যাওয়ার বিষয়টি।
“প্লাটিলেট এত কমে গেছে ধারণাই করতে পারি নাই। শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল, এলার্জির সমস্যা হচ্ছিল দেখে হাসপাতালে আনি। ডাক্তার দেখে দ্রুত ভর্তি করতে বলেন। এখন পর্যন্ত তিন ব্যাগ রক্ত দেওয়ার পর কিছুটা বেড়েছে। আজ (সোমবার) সকালে পরীক্ষায় দেখা গেছে ২০ হাজার হয়েছে।”
কারণ কোভিড?
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ও রক্ত পরিসঞ্চালন বিশেষজ্ঞ ডা. আশরাফুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বোনম্যারো প্লাটিলেট তৈরি করে। কোনো কারণে প্লাটিলেট কমে গেলে বোনম্যারো তা আট ঘণ্টার মধ্যে পূরণ করে দেয়। কিন্তু এবার প্লাটিলেট দ্রুত কমছে, বোনম্যারো তা পূরণ করতে পারছে না।
“এবার খুব দ্রুত হচ্ছে (প্লাটিলেট কমে যাওয়া)। অনেকের ক্ষেত্রে লক্ষণ বুঝে উঠার আগেই বিপদসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। কিন্তু বোনম্যারো সেটা রিপ্লেস করতে পারছে না। কনসিকোয়েন্স হিসেবে আমরা ধারণা করছি এটা করোনার পরবর্তী ইফ্যাক্ট। আমরা আক্রান্ত হয়েছি, ওষুধ খেয়েছি, বিভিন্ন কারণে এই মেকানিজমটা স্বাভাবিক নাই।”
ডা. আশরাফুল বলেন, “করোনাভাইরাস মহামারীর সময় অনেকেই আক্রান্ত হয়ে রক্ত তরল রাখতে নানা ধরনের ওষুধ খেয়েছেন। এ কারণে রক্তের প্লাটিলেট তৈরির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকতে পারে। বিষয়টি নিয়ে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।”
তার মতে, শরীরে প্লাটিলেটের মাত্রা ১০ হাজারের নিচে নামলে তা ঝুঁকিপূর্ণ। এসময় শরীরের যে কোনো জায়গা থেকে রক্তপাত হওয়ার সর্বোচ্চ ঝুঁকি থাকে। কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রে ২০ হাজারের নিচে নামলেই বিপদ হতে পারে।
এখনকার রোগীদের মধ্যে অনেকের ফুসফুসে পানি আসছে, পেটে পানি আসছে, এটা স্বাভাবিক হলেও খুব দ্রুত আসছে জানিয়ে তিনি বলেন, সেটা অন্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি।
করণীয় কী
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবদুল্লাহ বলেন, “যেহেতু প্লাটিলেট কমে যাওয়ার বিষয়টি অনেকেক্ষেত্রে রোগী বুঝতেই পারছেন না, সেজন্য জ্বর হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।”
“এজন্যই আমরা বারবার বলছি, এখন যেহেতু ডেঙ্গুর প্রকোপ চলছে। যে কারও জ্বর হলে কোনোভাবেই অবহেলা করা যাবে না। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ডেঙ্গু টেস্ট এবং প্লাটিলেট কাউন্ট অবশ্যই করিয়ে নেবেন। প্লাটিলেট কমেছে কী না তা পরীক্ষা না করে জানা সম্ভব না। শুরু থেকেই সতর্ক থাকলে ঝুঁকিগুলো এড়ানো যায়।”