প্যারিসে ডিসেম্বর আসলেই ঝুপ করে ঠাণ্ডা নেমে যায়। দিনের বেলায় একটু আরামদায়ক উষ্ণতা দেয়। সোনালী রোদ থাকলেও মূলত শীতেরই সময়। ১৯৭১ এর এমনই এক সময়ে তেসরা ডিসেম্বরে এক টগবগে ফরাসি যুবক প্যারিসে বিমান ছিনতাই করে রীতিমত শোরগোল ফেলে দিলেন। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, হাইজ্যাকিং এর ঘটনা পুরোটাই সুদূর বাংলাদেশের মানুষের জন্যে, যারা রক্ত আর চোখের পানিতে কিনতে চলেছে স্বাধীনতা। বাংলাদেশের সেই ফরাসি বন্ধুর নাম জ্যঁ ক্যুয়ে।
৩ ডিসেম্বর, অর্লি বিমানবন্দর, প্যারিস। আর দশটা দিনের মতোই ঝকঝকে সেদিনের সকাল। রাষ্ট্রীয় সফরে আসার কথা রয়েছে জার্মান ভাইস চ্যান্সেলরের। ভিআইপি লাউঞ্জেও তাই বেশ তৎপরতা। সাফ-সুতরো করার কাজ চলছেই। এর বাইরে আছে বিমানবন্দরের স্বাভাবিক ব্যস্ততা। এরই মধ্যে ট্যাক্সি থেকে নেমে দাঁড়ালেন আঠাশ বছরের দীর্ঘকায় এক যুবক।
পরনে নীল জ্যাকেট, পিঠে ঝোলানো ব্যাকপ্যাক। গড়পরতার ফরাসি চেহারায় শিশুসুলভ আচরণ যেন লেগেই আছে মুখে, তার সাথে চোখের কোণায় একটুখানি ধুর্ততার ছায়া। ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে হেঁটে গেলেন ইমিগ্রেশনের দিকে। সিকিউরিটি চেকের সময় যখন মেটাল ডিটেক্টরের চোখ ফাঁকি দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে রাখা পিস্তলের অংশগুলো নির্ঝঞ্ঝাটে তাঁর সাথে পালানোর সুযোগ পেলো, জ্যঁ ক্যুয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন যেন। প্রথম ধাপ তো উৎরে যাওয়া গেছেই, বাকিটা আর এমন কী কঠিন!
এগারোটা নাগাদ আস্তে আস্তে যখন সোনা রোদ ছড়িয়ে পড়ছে অর্লি বিমানবন্দরে, রানওয়েতে তখন পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারওয়েজের (পি আই এ) একখানা বোয়িং ৭২০ বিমান দাঁড়ানো, নাম পি আই এ - ৭১১। গোটা ত্রিশেক যাত্রী নিয়ে একটু পরেই উড়ে যাবে পাকিস্তানের দিকে। হঠাৎই দেখা গেলো গল্পের যুবক জ্যঁ ক্যুয়ে বিমানের সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলেন। একটু পর বিমানের ককপিটে গিয়ে পাইলটের গায়ে ঠেকালেন ৯ এম এম পিস্তল, হাতে থাকা বাক্স দেখিয়ে বললেন সেটি বোমা।
সেদিনের পিআইএ-৭১১ (ছবি: পিআইএ ওয়েবসাইট)
সময়টা সাড়ে এগারোটা ছুঁই ছুঁই। রানওয়েতে দাঁড়ানো পি আই এ – ৭১১ থেকে রেডিওবার্তায় অর্লি বিমানবন্দরকে জানানো হলো, ‘এই বিমানটি আমি ছিনতাই করেছি, আমার কথা না শুনলে পুরো বিমান উড়িয়ে দেব। আমার কাছে বোমা আছে।’ রেডিও অপারেটরের কাছে মেসেজ পোঁছাতেই রেড অ্যালার্ট জারি করা হলো পুরো অর্লি বিমানবন্দরে।
সাইরেন বাজিয়ে বিমানের পাশে চলে আসলো পুলিশ আর দমকলের গাড়ি। ফরাসি সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা ঘিরে ফেললো চারপাশ। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা যোগাযোগ করলেন জ্যঁ ক্যুয়ের সাথে, জানতে চাইলেন কী তাঁর দাবী। জানা গেলো দাবী একটাই। পাকিস্তানের এক অংশের মানুষ স্বাধীন হওয়ার জন্য লড়াই করছে, সেই মানুষগুলো ভালো নেই। ওই মানুষগুলোর জন্যে ২০ টন ঔষধ বিমানে তুলে দিলে তবেই জ্যঁ ক্যুয়ে সবাইকে মুক্তি দিবে।
পশ্চিম জার্মানির ভাইস চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ডট তখন জার্মানিতে, এসেছেন দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনায়। কিন্তু সবকিছু ভেস্তে গেলো আকস্মিক এই ঘটনায়। সবকিছু ছাপিয়ে টিভিতে সরাসরি দেখানো হচ্ছে বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা। দাবী মেনে নিতে চাইছে না ফরাসি সরকার, কিন্তু নিজের অবস্থানে অটল জ্যঁ ক্যুয়ে। হাতের বাক্স থেকে তার বেরিয়ে আছে, স্বভাবতই হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সরকার, কারণ ধরেই নেয়া হচ্ছে ভয়ংকর কোনো বোমা ওই বাক্সের ভেতর।
টিভির পর্দায় জ্যঁ ক্যুয়ে (ছবি: আইএনএ)
অবশেষে বিকেল পাঁচটার পর সবকিছু মেনে নেয়ার কথা বললো ফ্রান্স সরকার। বিমানে থাকা দেশী-বিদেশী যাত্রীদের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে সরকার জানালো ২০ টন ঔষধ পাঠাতে তাদের আপত্তি নেই। প্রথম ধাপে অর্ধেক ঔষধের কার্গো এলো, সেখান থেকে তোলা হলো বিমানে। শর্তানুযায়ী জ্যঁ ক্যুয়ে ছেড়ে দিলেন ৮ জন জিম্মিকে। এরপর দ্বিতীয় কার্গোটিও চলে আসলো। সবকিছু জ্যঁ ক্যুয়ের পরিকল্পনা মাফিক আগাচ্ছে, এমনটা ভাবার সময়েই বিমানের মেকানিকের ছদ্মবেশে থাকা কমান্ডোরা আচমকা হামলা করে কাবু করে ফেললেন তাঁকে।
পুলিশের কাছে গ্রেফতার হওয়ার পর জ্যঁ ক্যুয়ে (ছবি: এএফপি)
জ্যঁ ক্যুয়ে পেশাদার কোনো হাইজ্যাকার নন। তাঁর বোমার বাক্সে আদতে ছিল শুধুই বাইবেল, শেভিং রেজর আর কিছু তার। গ্রেফতার করে গোয়েন্দা কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদের সময় অকপটেই জানালেন - বিশ্বের বুকে নতুন দেশের জন্ম হচ্ছে, সেই দেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা কমাতেই এতো কাণ্ড ঘটিয়েছেন তিনি। বিমান ছিনতাইয়ের অভিযোগ প্রমাণিত হলো, জেল হলো ৫ বছরের। যদিও পরবর্তীতে ১৯৭৩ এ তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়।
জ্যঁ ক্যুয়ের এই চাঞ্চল্যকর ঘটনা কিন্তু একেবারে বৃথা যায়নি। পরদিন ইউরোপজুড়ে সংবাদপত্রের শিরোনামে উঠে আসলো তার নাম। এই ঘটনার পর ফরাসি সরকার ও তাদের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে আনে পরিবর্তন। বাংলাদেশের মানুষের জন্য ঠিকই ‘অঁদ্রে দ্য মলতে’ নামের একটি সাহায্যকারী সংস্থার মাধ্যমে এসেছিল সেই খাদ্রসামগ্রী ও ওষুধ। পরবর্তীতে জাতিসংঘের পাকিস্তানের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবেও বন্ধুরাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন না করে ভোটদান থেকে বিরত থাকে ফ্রান্স।
পত্রিকার পাতায় জ্যঁ ক্যুয়ে (ছবি: গ্যাজেট আপডেট)
জ্যঁ ক্যুয়ে আগে কখনো বাংলাদেশে আসেননি। শুধু পত্র-পত্রিকায় মানুষের কষ্টের খবর শুনেই ৮ হাজার মাইল দূরের বাংলাদেশের মানুষের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখে হাইজ্যাক করেছিলেন বিদেশী বিমান। এই অকৃত্রিম বন্ধুর স্মৃতি যাতে মানুষের কাছ থেকে হারিয়ে না যায়, সেই লক্ষ্যে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র ‘জে কে ১৯৭১।’ ২০২৩ এর ২১তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব শুরু হবে বাংলাদেশের সিনেমা ‘জেকে ১৯৭১’ দিয়ে। এই সিনেমায় কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন সৌরভ শুভ্র দাশ।
জে কে ১৯৭১ সিনেমার পোস্টার (ছবি: দ্যা ডেইলি সান)
১৯৪৩ এ জন্ম হওয়া জ্যঁ ক্যুয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন ২০১২ তে। সারা জীবনই করে গেছেন মানবতার জন্য লড়াই। তাঁর সফল না হওয়া বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা সারা পৃথিবী ভুলে গেলেও ভুলতে পারবে না বাংলাদেশের মানুষ। কারণ রণাঙ্গন এবং রণাঙ্গনের বাইরে থেকে এইরকম পরার্থে সবকিছু বিলিয়ে দেয়া মানুষগুলোর অবদানেই এসেছে বিশ্বের বুকে এই লাল সবুজের পতাকা আর মানচিত্র।
সিরাজুল আরিফিন বর্তমানে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত।