Loading...
The Financial Express

জ্ঞানদানন্দিনী দেবী: এক বাঙালি মেয়ের ফ্যাশন বিপ্লব

| Updated: December 01, 2022 20:55:14


বিভিন্ন বয়েসে জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। ছবি: সংগৃহীত বিভিন্ন বয়েসে জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। ছবি: সংগৃহীত

শাড়ি বঙ্গ ললনার চিরকালীন বসন। আজকের আধুনিকারা দর্জিবাড়িতে ভিড় করে সেই শাড়ির রং-ঢং মিলিয়ে ব্লাউজ গড়িয়ে নিতে। হাতাটা এমনি করে ঝোলানো হবে, গলটা ঐরকম গোল হবে, ওই দিকটা উঁচু হবে, ঝুলটা ওই অব্দি- সব পই পই করে যত্নে বুঝেই দিয়ে আসেন। নিজ পোশাকের নকশাদার আজ আধুনিকা নিজেই। কিন্তু এই অতি সহজ সাবলীলতা, কোনো বঙ্গ নারীর এই দেড়শো বছর আগেও ছিল না। ছিলেন তারা ঘেরাটোপে বন্দী। সেই দশা হতে নব জীবনশৈলীর ছোঁয়াচ লাগলো ঠাকুরবাড়ির অন্তঃপুর হতেই, রবীন্দ্রনাথের মেঝ বৌঠান জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর হাত ধরে।

 বাঙালি নারী ঘর হতে বাইরের জগতে বের হয়ে শিখল নতুন আদবকায়দা। আটপৌরে ভাঁজ হতে বের হয়ে শাড়ি পড়লো কুচি করে, সাথে বরাঙ্গে উঠল বোতাম জোড়া গা ঢাকা ব্লাউজ। কর্মজগতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে বাঙালি নারী পেল মার্জিত পোশাক রীতি। আজ রইল বাঙালির ফ্যাশন রিফর্মার- জ্ঞানদানন্দিনীর জীবনগাঁথা।

জ্ঞানদানন্দিনী নারী জাগরণের ঊষালগ্নের অন্যতম কিরণ। সময়কে অতিক্রম করে যেন তিনি অনেকখানি সামনে দেখতে পেতেন। তিনি যেই জীবন বোধ নিয়ে সেই সময় চলাফেরা করতেন তার প্রত্যেকটি ছিল এক একটা বিপ্লব। সেই সময়ের ঘরের বধূ এই দাপুটে নারী কালাপানি পাড়ি দিয়ে বিলেত গিয়েছিল, যাকে লোকে সেসময় যথারীতি পাপ ভাবতো।

যশোরের নরেন্দ্রপুরের মেয়ে জ্ঞানদানন্দিনী। সমাজের চোখ রাঙানিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মেয়েকে ছেলেদের পাঠশালায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন বাবা। জীবনের বিপ্লবটা যেন তখনই শুরু। কিন্তু সমাজের প্রথায় একটা সময় বাঁধা পড়ে যান। কচি বয়সে মেজ বৌ হয়ে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে পা পড়ে তার। আট বছরের খুকির সতের বছরের বর সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

 সত্যেন্দ্রনাথের চোখেমুখে পাশ্চাত্য শিক্ষার ঝলকানি। তথাকথিত বেড়াজালে স্ত্রীকে কখনোই আটকে থাকতে দেননি বরং দিতেন যথেষ্ট স্বাধীনতা, দিতেন উৎসাহ নতুন কিছু শেখার।

 ১৮৬৪ সালে বিলেত ফেরত আইসিএস সত্যেন্দ্রনাথ পত্নীকে নিয়ে যান নতুন কর্মস্থল বোম্বাইয়ে। এটি ছিল বড় সড়ো রকমের একখানা প্রথা ভাঙা। বাড়ির বউয়ের ঘরের বাইরে প্রথম সূর্যস্নান।

কিন্তু ঘরের বধূর পোশাক অতি সাধারণ স্বচ্ছ শাড়ি, যা তারা পেঁচিয়ে পরে ঘরোয়া পরিবেশে আব্রু রক্ষা করতেন। সেই শাড়ি কোনো মতেই বাইরের জন্যে উপযুক্ত নয়। এর বেশি যদি কিছু ব্যবহৃত হতো, তা ছিল শাড়ির উপরে জড়ানো শাল।

 সত্যেন্দ্রনাথ ছুটলেন ফরাসিদের দোকানে। তারপর তারা যে একখানা হাবড়জাবর বানিয়ে পাঠালো তাতে কোনো মতেই এদেশী আবহাওয়ায় স্বস্তি পাওয়া যায় না।

সত্যেনের জ্ঞেনি খুঁজতে লাগলেন নয়া পদ্ধতি যাতে করে বাঙালি চলতে পারে স্বাচ্ছন্দ্য মতো। এর মধ্যে ইংরেজি ঘরনা হতে এলো পার্টির নেমন্তন্ন কিন্তু সেই উৎসবে যোগ দেয়া হলো না সত্যেন পত্নীর, শুধুমাত্র পোশাকের জন্যে। খালি গায়ে শুধু শাড়ি জড়ানো সাহেব-সুবোদের কাছে বড্ড অভদ্র পোশাক যে!

 বোম্বাইয়ে গিয়ে পার্সি রমণীদের সাথে ভাব হলো জ্ঞানদার। দেখলেন ওদের শাড়ি পরবার কায়দাখানা একদম অন্যরকম, বাঙালির মতো পেঁচিয়ে ঘোমটা করে নয়, ডান কাঁধের উপর আঁচলটা ভাঁজ করে রাখে এরা। তার নিচে ঘাগড়া আর উপরে জামার মতো পরে নেয়া।

 রীতিখানা ভারী চমৎকার লাগলো জ্ঞানদানন্দিনীর। তিনি নিজে একটুখানি অদলবদল করে নিলেন, কর্মঠ নারীর কথা মাথায় রেখে, ডান হাতটাকে হালকা হতে দিয়ে ডান কাঁধের বদলে বা কাঁধে আঁচল জুড়লেন ব্রুচ দিয়ে। শাড়ির সামনে গুজলেন কোমরে পুরুষের ধুতির মতো কুচি করে। যেমনটি রীতি দেখা যেত অন্ধ্রপ্রদেশীদের মধ্যে যাকে বলা হতো 'নীবি পদ্ধতি'।

ইংরেজদের শেমিজ জ্যাকেটের অনুকরণে তিনিও ভারী লেস আর কলার জুড়ে এক নতুন ধাঁচের পোশাক বানালেন বক্ষবাস হিসেবে। সেই হলো আজকের ব্লাউজ। সেকেলে লোকে বলতো মেয়েদের জামা। এমনি করে পার্সি আর ইংরেজি কায়দা মিলে আধুনিক নারীর নতুন পোশাক হলো। আধুনিক বাংলার প্রথম ফ্যাশন বিপ্লব!

কলকাতার বাড়িতে ফেরার পরে মেজ বউকে দেখে বাড়ির অন্য বউরাও উৎসাহিত হলো এই রকম ভাবে শাড়ি পরতে। বাংলার মেয়েরা যাতে এই পদ্ধতি সহজে রপ্ত করতে পারে তাই বামাবোধিনী পত্রিকায় জ্ঞানদানন্দিনী দেবী নতুন শাড়ি পরবার পদ্ধতি নিয়ে বিজ্ঞপ্তি দিলেন। ঠাকুরবাড়ির এই সংস্কৃত বেশপদ্ধতি খুব তাড়াতাড়ি তৎকালীন আধুনিক রুচিসম্পন্ন পরিবারের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। এই বেশ হলো তখন উপযুক্ত ব্রাহ্মিকার বেশ (জিনিসটি ব্রাহ্ম নারীরাই আগে গ্রহণ করেছিলেন)। এইভাবেই শাড়ি পরে মেয়েরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সভা ও সামাজিক উৎসবে যোগ দিতে লাগলো।

আজ ঠাকুর বাড়ির গৃহিণীদের যতগুলি ছবি পাওয়া যায়, তার পেছনেও কৃতিত্ব আছে জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর। বর্ন এন্ড শেপার্ড নামে একটি কোম্পানির কাছে ফটোগ্রাফি শিখেছিলেন তিনি। বধূদের শুদ্ধ-সংস্কৃত রীতিতে শাড়ি পরিয়ে তিনি নিজেই ছবি তুলে তা সংগ্রহ করেছিলেন। এই নারী সত্যিই বঙ্গ রেনেসাঁর ঝলক।

 

সুস্মিতা রায় বর্তমানে শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজে ৪র্থ বর্ষে পড়াশোনা করছেন।

[email protected]

Share if you like

Filter By Topic