কথাসাহিত্যিক শংকরের সুবিখ্যাত উপন্যাস চৌরঙ্গীর ষাট বছর পূর্ণ হলো এ বছর। ষাটে নাকি মানুষ বৃদ্ধ হয়, কিন্তু মুজতবা আলী যেমন বলেছিলেন- 'বইখানা অনন্তযৌবনা, যদি তেমন বই হয়'- সেই কথাকে সত্য প্রমাণ করেই ১৯৬২ তে প্রকাশিত চৌরঙ্গী এই ২০২২ এ এসেও পাঠক হৃদয়ে রেখে যাচ্ছে চিরন্তন ছাপ।
এসপ্লানেড বলে কোলকাতার যে জায়গাটাকে আমরা চিনি, তারই আদিনাম চৌরঙ্গী। এখানকার শাজাহান হোটেলে ঘটনাচক্রে কাজ পেয়ে গিয়েছিলেন শংকর।
তার ভাষায় 'সারাটা দিন ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত শরীরটা যখন আর চলছিল না, তখন সেখানেই আশ্রয় মিললো।' এই আশ্রয়ের জায়গাটা সেই শাজাহান হোটেল, যেটি চৌরঙ্গীর ভেতর কার্জন পার্কে ঝলমলে চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এই শাজাহান হোটেলে কাজ পাবার ঘটনাটাও চমকপ্রদ। তার বন্ধুবর বায়রন সাহেব তাকে নিয়ে গেলেন ম্যানেজার মার্কো পোলোর কাছে। ম্যানেজারের সেক্রেটারি রোজী এক বিশিষ্ট লোক ব্যানার্জি বাবুর সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ায় সেই পদে শংকরের চাকরি হয়ে যায়।
এর আগে তিনি ছিলেন ব্যরিস্টার নোয়েল ফ্রেডরিক বারওয়েল সাহেবের বাবু৷ সেই আখ্যান লিখেছেন 'কত অজানারে' বইতে। তারই সিক্যুয়েল হলো চৌরঙ্গী।
নোয়েল সায়েবের মৃত্যুর পর নিউজপেপার বিক্রি কিংবা সেলসম্যান হয়ে ঝুঁড়ি বিক্রির কাজও করেছেন তিনি। সে সময়ে দেখেছেন মানুষের সুবিধাবাদ। এর ভেতরও এক দারোয়ানজীর উপকারের কথা আলাদাভাবে লিখতে ভোলেননি।
শংকরের প্রথম বইয়ের সাত বছর পর এসেছিল এটি। ততদিনে কেউ কেউ তাকে বলতে শুরু করেছেন 'ওয়ান বুক অথর।' চৌরঙ্গী বেরনোর পরও দেশ পত্রিকায় এক লেখিকা অভিযোগ করেছিলেন, ' যে ছেলে 'ব্রেড & ব্রেকফাস্ট' এর সাথে 'বেড& ব্রেকফাস্ট' কে এক করে ফেলে সে লিখেছে হোটেল নিয়ে উপন্যাস! তবে এসবে কিছু যায় আসে নি। চৌরঙ্গী প্রকাশের পরই প্রবল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এর ব্যক্তিক্রমী কনটেন্টের জন্য।
শংকর মূলত তার জীবনে শহরকে দেখেছেন। তাই শহরের গল্পই বলতে চেয়েছেন। এই বইয়ে সুপরিচিত শাহজাহান হোটেলে এর বিভিন্ন মানুষদের জীবনকে দেখেছেন। প্রদীপে নিচে থাকা অন্ধকারের কথাও বলেছেন। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তার মার পরামর্শ ছিলো যে কাজ পাবে, করবে। এক কর্ম থেকে অন্য কর্মের উৎপত্তি – এমনটি নকি তার জন্মের সময় তৈরি করা কুষ্ঠিতে বলা ছিলো।
নানারকম চরিত্রের সমাহার আছে এই উপন্যাসে, তাদের আছে একেকরকম গল্প।
মার্কো পোলোর যেমন আছে ভূমিকম্পে মা-বাবা হারিয়ে তারপর বহু উত্থান-পতনের মাধ্যমে এই হোটেলের ম্যানেজার হওয়া। জন্ম তার মধ্যপ্রাচ্যে, বড় হওয়া চার্চের অনাথাশ্রমে। তারপর এসেছে প্রেম ভালোবাসা। মার্কো ঘর বেঁধেছিলেন, কিন্তু স্থির হতে পারলেন না। ভালোবাসার বিপরীতে প্রতারণা পেয়ে তারপর ঘটনাক্রমে এখানে।
বইটির লেখক মণিশংকর মুখোপাধ্যায়, শংকর নামেই সমধিক পরিচিত। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস।
আবার দুজন মানুষের ভালোবাসাকে নষ্ট করে কীভাবে তাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় এই শাহজাহান হোটেলের মতো হোটেলগুলো, তাও তুলে এনেছেন শংকর। রবার্ট ওরফে রবি ও জেনের জীবনকে স্থিতিশীল হতে দেয়না এই মান্যগন্যরা। ভাগ্যের ফেরে এখানে এসে বারবনিতা হওয়া জেনকে বিয়ে করে সুস্থ জীবন দেবার 'অপরাধে' রবিকে চাকরিচ্যুত হতে হয়। কোলকাতার কোথাও তার চাকরি হয়না। এরপর লেখকের ভাষায় 'তখন বুঝিনি চোখের জলের কেবল শুরু- বর্ষা তখনো নামেনি।'
এর বাইরে আছে জিমি, গুড়বেড়িয়া, নিত্যহরি, গোমেজ, সরাবজীর মতো চরিত্রগুলোর সমাহার। আর সবার চেয়ে বেশি আছেন শংকরের প্রিয় স্যাটা বোস বা সত্যসুন্দর বসু।
সত্যসুন্দর বসু ওখানে রিসিপশনিস্টের কাজ করতেন। তার সহায়তা শংকরকে সেখানে টিকিয়ে রেখেছিলো। কাজগুলো শিখে উঠতে সক্ষম করেছিলো। তার জীবনদর্শনকেও প্রভাবিত করেছিলেন তিনি। স্যাটা বোসের ব্যক্তিত্বটি এমন যাকে দেখলে মনে হয় পাড়ার আপন দাদা কিংবা অফিসের আন্তরিক কলিগ, যে আপনাকে নিজ উদ্যোগে সব বিপদ থেকে বাঁচিয়ে নেবে।
এই উপন্যাসে এসেছে বার ড্যান্সার কনি ও তার দাদা (বড় ভাই) হ্যারির কথা। নিত্যহরি বাবু তাদের বিষয়ে ইতিবাচক নন। এই ভদ্রলোক মূল্যবোধ নিয়ে চিন্তিত, কিন্তু সমস্যাটা যে সিস্টেটেমেটিক, তা বিচারের মতো গভীর বুদ্ধি তার নেই। তিনি মূলত শোবার ঘরে বালিশ সাপ্লাই দেন। কেউ কারো শয্যাসঙ্গী হলে তাকে সেজন্য অনুতাপ করে হাত ধুতে দেখা যায়। বালিশ সাপ্লাইয়ের 'পাপ' তিনি এভাবে মোছার চেষ্টা করেন!
কনির পরিচয় সে একজন বিখ্যাত বারড্যান্সার। কিন্তু এরপর বেরিয়ে আসে তার জীবনের নেপথ্য সত্য। লেখক শংকর এক রাতে তার ভেতর সেই বারগার্ল এর বাইরে একজন 'সিস্টার' কেও দেখতে পান। তারা হোটেল ছেড়ে গেলে সেখানে আসে নতুন বেলি ড্যান্সার। কনি বা হ্যারির কথা কারও মনে থাকেনা।
বইয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র করবী গুহ। এই নারী মি. আগারওয়াল নামে এক ধনাঢ্য শিল্পপতির হোস্টেস হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হন। কিন্তু তারও ছিলো একটি সংবেদনশীল মন। জীবনানন্দ দাশ কিংবা সমর সেনের কবিতাকে ভালোবাসা এই নারীর জীবনে ভালোবাসা আসে ধনাঢ্য মাধব পাকড়াশির ছেলে অনিন্দ্য পাকড়াশির হাত ধরে। সে ক্ষেত্রে বেশ সহায়তা ছিলো শংকর বাবুর। কিন্তু এরপর এই ভালোবাসা কি করবীকে মুক্তি দিতে পারে? নাকি এগিয়ে নিয়ে যায় ধ্বংসের দিকেই?
শংকরের লেখাতে হিউমার ও আইরনি আছে বেশ। মিসেস পাকড়াশি যখন করবীকে টাকা অফার করে বলছেন, 'তুমি কি মেয়েমানুষ নও? তোমার কি হৃদয় নেই?'- তখন তীব্র আইরনির সাথে ক্ষমতাবানদের টাকা দিয়ে সব কিনে ফেলতে চাওয়ার মানসিকতারই প্রতিফলন ঘটে।
আবার গুড়বেড়িয়া যখন সিম্পসন সাহেবের ভূত দেখেন তখন সেই কাহিনী বর্ণনার ভঙ্গিমায় ও সংলাপে কোনোরকম ভাড়ামি ছাড়াই চমৎকার হিউমার ফুটে ওঠে।
চৌরঙ্গী, স্বাধীনতাত্তোর কালে পরিচিত এসপ্লানেড নামে। ছবি: ফ্লিকর।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে সেই দাদা সত্যসুন্দর তথা স্যাটা বোস রয়ে গেছেন অমর এক চরিত্র হয়ে।
এটি এমন এক চরিত্র যার সমর্থন সবাইকে চলার পথে প্রেরণা দেয়। শংকর এই চরিত্রটি নিয়ে তিনি আনন্দবাজার পত্রিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, "ইস্টার্ন রেলওয়েতে এক ভদ্রলোক ছিলেন। তাঁর নাম ছিল সত্যসুন্দর বসু। আমি তখন ওখানে চাকরি করি। তিনি সাহেবদের সঙ্গে খুব মিশতেন। স্কাউটিং করতেন। স্মার্ট লোক ছিলেন। কায়দা করে ইংরেজি বলতেন। সব সময় বলতেন আমার নাম স্যাটা বোস। খুব পপ্যুলার ফিগার ছিলেন। আমি অবশ্য দূর থেকে দেখেছি। অতটা আলাপ ছিল না। আবার স্পেনসেস হোটেলে একজনকে পেয়েছিলাম, যিনি পরে গ্রেট ইস্টার্নে চলে যান। তাঁর মধ্যে একটা অভিভাবক সুলভ ব্যাপার ছিল। তাঁরও ধারণা ছিল ওঁকে ভিত্তি করে লিখেছি।”
উল্লেখ্য যে, শংকর এখানে যে নামগুলো ব্যবহার করেছেন তারা বাস্তব নন, তবে চরিত্রগুলো বাস্তবিকই ছিলো। যে ধরনের ঘটনাগুলো তিনি তুলে ধরেছেন তা শাহজাহান হোটেল বা এমন বড় হোটেলগুলোয় ঘটতো। যেমন- সাহিত্যিক নগেন পালের চরিত্রটি মুখে অনেক বড় কথা বললেও করবীর প্রতি তার লাম্প্যট্য গোপনে প্রকাশ পায়। করবীকে উপহার দেয়া জুতার বিষয়ে যেমন করবী বলেন, " সবাই যাকে মাথায় করে রাখে, তাকে অন্তত পায়ের নিচে রাখতে পারছি। গতরাতে মদ্যপ অবস্থায় উনি আমার পা জড়িয়ে ধরেছিলেন।"
কিংবা ফোকলা নামের চরিত্রটি। ডাকসাইটে বক্সার, বেহেড মাতাল, ক্যাডার। বড় শিল্পপতিরাও (যেমন- আগরওয়াল) তাকে সমঝে চলে। শংকর এদের নিয়ে বলেছেন- ' মিসেস পাকড়াশি, আগারওয়াল বা ফোকলার মতো চরিত্রের বিচরণ সব জায়গাতেই আছে। তাই পাঠকের উচিত তাদের সম্পর্কে জানা।"
তবে এই অন্ধকারের ভিড়ে যে চরিত্রগুলোর ভেতর আলো ছিলো, স্যাটা বোস তাদের একজন। পরার্থপরতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ সত্যসুন্দর ভালোবেসেছিলেন এয়ার হোস্টেস সুজাতা মিত্রকে। কথা ছিলো বিয়ে হবে। হয়েছিল কি? তা এখানে অপ্রকাশই থাক।
তবে স্যাটা বোসের বলা কথার মতই একসময় তিনি, মার্কো পোলো, শংকরসহ প্রায় সবাই-ই সেই চৌরঙ্গী থেকে বেরিয়ে এসেছেন/ আসতে বাধ্য হয়েছেন।
আর এতসব কিছুর সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চৌরঙ্গী। শংকর শেষ করেছেন এভাবে- 'শেষবারের মতো পেছন ফিরে আমার প্রিয় পান্থশালার দিকে তাকালাম। শাজাহানের ক্লান্তিহীন লাল আলো তখনও জ্বলছে আর নিভছে। আমি এগিয়ে চললাম।"
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী।