Loading...
The Financial Express

চাঁদপুরে পুলিশের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ‘নিরুদ্দেশ’ কয়েক তরুণের 

| Updated: September 09, 2022 18:17:04


চাঁদপুরে পুলিশের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ‘নিরুদ্দেশ’ কয়েক তরুণের 

দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে নিখোঁজ সাত কলেজছাত্রের অন্তত কয়েকজন কুমিল্লা থেকে গিয়েছিলেন চাঁদপুরে; রাস্তায় বসে থাকতে দেখে পুলিশ তাদের তুলে দিয়েছিল এক হোটেলে। 

পরদিন সকালে বাড়ি ফেরার কথা বলে ওই হোটেল ছাড়েন তারা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সন্দেহ, ‘জঙ্গিবাদে জড়িয়েই’ তারা লাপাত্তা হয়েছে। 

১৬ দিনেও তাদের সন্ধান না মেলায় দিশেহারা অবস্থা তাদের পরিবারের সদস্যদের। সন্তানদের খোঁজে তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন দপ্তরে দপ্তরে ঘুরছেন। র‌্যাব, পুলিশের পাশাপাশি পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের সদস্যরাও তাদের খোঁজে মাঠে নেমেছে। 

অভিভাবকরা জানিয়েছেন, কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একটি দল বুধবার কুমিল্লায় গিয়ে তাদের সঙ্গে চার ঘণ্টা বৈঠক করেছেন। তারা যা যা জানেন, তা বলেছেন। কিন্তু তাদের ছেলেরা জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে, এটা তাদের বিশ্বাস হতে চাইছে না। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যানাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান আসাদুজ্জামান বলেন, “তারা বাসা থেকে বের হওয়ার সময় একেক পরিবারকে একেক রকম কথা বলে গেছে। তাদের পরিবারের সাথে আমাদের কথা হয়েছে, তারাও জানেন না কোথায় গেছে ছেলেরা। আমরা এ নিয়ে কাজ করছি।” 

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “তারা জেএমবি, নব্য জেএমবি, আনসারুল্লাহ নাকি আল কায়েদার সদস্য হয়েছে- সেটা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ না করে বলা যাবে না। তাদের বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েই সিটিটিসি কাজ করছে।” 

সন্দেহের কেন্দ্রে এক তরুণ 

কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) মো. আফজাল হোসেন বলেন, এই সাত শিক্ষার্থী নিখোঁজের ঘটনায় কুমিল্লা কোতোয়ালি থানায় পাঁচটি এবং ঢাকায় একটি জিডি হয়েছে। 

এর মধ্যে কুমিল্লা কোতয়ালি মডেল থানায় অভিভাবকদের করা সাধারণ ডায়েরিতে বলা হয়েছে, গত ২৩ অগাস্ট বাসা থেকে বের হয়ে তারা আর ফেরেনি। 

নিখোঁজ শিক্ষার্থীরা হলেন- কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষার্থী ইমরান বিন রহমান ওরফে শিথিল (১৭), একই কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী মোহাম্মদ আস সামি (১৮), কুমিল্লা সরকারি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী হাসিবুল ইসলাম (১৮), একই কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী নিহাল আবদুল্লাহ (১৭), ভিক্টোরিয়া কলেজের স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের ইমতিয়াজ আহমেদ রিফাত (১৯), একই কলেজের স্নাতক (সম্মান) ৩য় বর্ষের আমিনুল ইসলাম আলামিন (২৩) ও ঢাকা ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতক (সম্মান) সম্পন্ন করা সরতাজ ইসলাম ওরফে নিলয় (২৫)। 

র‍্যাব ও পুলিশের দুই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এইচএসসি থেকে স্নাতক পড়ুয়া ওই তরুণরা নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন ‘আনসার আল ইসলামের মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে’ বাড়ি ছেড়েছে বলে গত কয়েক দিনের তদন্তে তারা জানতে পেরেছেন। 

এর আগে সিলেট অঞ্চল থেকেও বেশ কয়েক তরুণ ওই জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িয়ে বাড়ি ছেড়েছিল বলে জানান ওই দুই কর্মকর্তা। 

নিরুদ্দেশ হওয়া সাত শিক্ষার্থীর মধ্যে ছয়জন কুমিল্লার হলেও একজন এসেছিলেন ঢাকা থেকে। রাজধানীর ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সরতাজ ইসলাম নিলয় নিখোঁজ আরেক শিক্ষার্থী নিহাল আবদুল্লাহর খালাতো ভাই। কুমিল্লা নগরীর রানীরবাজারের পাশে অশোকতলা এলাকায় নিলয়ের খালা ফৌজিয়া ইয়াসমিনের বাসা। 

নিলয় ওই তরুণদের মধ্যে বয়সে সবার বড়, যে কারণে তাকে ঘিরেই সন্দেহ নিখোঁজ শিক্ষার্থীদের পরিবারগুলোর। 

নিহালের বাবা সাইফুল ইসলাম বলেন, “নিলয় আমার ভায়রার ছেলে। গত ২৩ অগাস্ট সে আমাদের বাসায় আসার কথা বলে ঢাকার বাসা থেকে বের হয়। আমরা তাকে (নিলয়) খুবই ভালো ছেলে বলেই জানি। 

“নিহাল আর নিলয় দুজনই ধর্মভীরু। ধর্মকর্ম করে, বিভিন্ন মসজিদে গিয়ে বয়ান শোনে। কিন্তু নিলয় আমাদের বাসায় আসেনি।” 

নিহাল বা নিলয় জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে- এমনটা এখনও বিশ্বাস করতে চান না সাইফুল। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তেই সব বেরিয়ে আসবে। 

অন্য শিক্ষার্থীদের পরিবারও জানিয়েছে, নিহাল ও নিলয়ের মতো বাকি পাঁচজনও ধর্মভীরু; ধর্ম-কর্ম করার পাশাপাশি মসজিদে গিয়ে বয়ান শোনে তারা। 

ওই পাঁচজনের মধ্যে চারজনের পরিবারের সন্দেহ, নিলয়ই হয়ত বাকিদের নিয়ে গেছে। ঢাকা থেকে প্রায়ই কুমিল্লায় যাতায়াত ছিল নিলয়ের। নিজের বাসা থেকে ‘মিথ্যে বলে’ এসে নিলয়ই হয়ত বাকিদের নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছে। 

জানতে চাইলে কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) মো. আফজাল হোসেন বলেন, নিখোঁজদের উদ্ধার ও ঘটনার তদন্তে মাঠে কাজ করছে ঢাকা ও কুমিল্লার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক দল। আশা করছি, দ্রুত আমরা সব কিছু জানাতে পারব। 

আর র‍্যাব-১১ সিপিসি ২, কুমিল্লার কোম্পানি কমান্ডার মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন বলেন, “আমরা গত কয়েকদিন ধরেই বিষয়টি নিয়ে খুবই তৎপর। আমাদের বেশ কয়েকটি টিম মাঠে কাজ করছে। বাকিটা পরবর্তীতে জানানো হবে।” 

চাঁদপুরের হোটেলে 

নিখোঁজ শিক্ষার্থী নিহালের বাবা সাইফুল ইসলাম বলেন, ২৩ অগাস্ট তার ছেলে বাসায় কিছু না জানিয়ে নিরুদ্দেশ হওয়ার পরদিন ভোরে চাঁদপুর শহরের রেলস্টেশন সংলগ্ন চাঁদপুর হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট থেকে সফিকুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি তাকে ফোন করেন। 

“নিজেকে ম্যানেজার পরিচয় দিয়ে ওই ব্যক্তি জানান, আমার ছেলেসহ তার বন্ধুদের পুলিশ ওই হোটেলে দিয়ে গেছে। আমরা যেন গিয়ে তাদের নিয়ে আসি।” 

সাইফুল জানান, ওই সময় তিনি ম্যানেজারের ফোন থেকে নিলয়ের সাথে কথাও বলেন। নিলয় তাকে ওই হোটেলে যেতে নিষেধ করে এবং তখুনি ফেরার জন্য রওনা হবে বলে জানায়। কিন্তু তারা আর ফেরেনি। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চাঁদপুর হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার সফিকুল ইসলাম বলেন, ২৩ অগাস্ট রাত পৌনে ২টা থেকে ২টার দিকে সদর থানার নতুন বাজার পুলিশ ফাঁড়ির এসআই খায়রুল ইসলাম পাঁচ তরুণকে নিয়ে ওই হোটেলে যান। 

“খায়রুল তখন বলেছিলেন, তারা বাড়ি থেকে অভিমান করে চলে এসেছে। একটু তাদের অভিভাবকদের ফোন দিয়ে যেন আমরা জানিয়ে দিই, যাতে সকালে তারা এসে নিয়ে যায়।” 

পরদিন সকাল ৬টায় শিফট শেষ হলে আরেক ম্যানেজার হেদায়েত উল্লাহকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে যাওয়ার কথা জানান সফিকুল। 

তিনি বলেন, “পরে শুনেছি, আমি যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ওই তরুণরা হেদায়েত উল্লাহকে বলেছে, আমাদের অভিভাবক এসেছে, এজন্য চলে যাচ্ছি। হেদায়েত উল্লাহ মনে করেছে, সত্যি সত্যি তাদের অভিভাবক এসেছে। এজন্য সে তাদের চলে যেতে বলেছে। পরে বিভিন্ন বাহিনীর লোকজন এসে আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।” 

সফিকুল বলেন, “আমরাতো হোটেল চালাই। পুলিশ যদি হোটেলে না রেখে থানায় নিয়ে যেত, তাহলে তো আর এই সমস্যা হত না। আমরাতো জানি না- ছেলেগুলো ভালো নাকি খারাপ।” 

সেই রাতে কী ঘটেছিল জানতে চাইলে এসআই খায়রুল ইসলাম বলেন, “আমাদের ফাঁড়ির ইনচার্জ মিন্টু দত্ত স্যারসহ আমরা একটা অভিযানে যাচ্ছিলাম। তখন দেখি, চাঁদপুর কালিবাড়ির সামনে এই ছেলেগুলো যার যার ব্যাগ নিয়ে বসে আছে। 

“স্যার জানতে চাইলে কেউ বলে বাসা কুমিল্লা; আবার কেউ বলে বাসা ঢাকা। বন্ধুর বাসায় এসেছিল, এখন গাড়ি নেই তাই বসে আছি। তখন আমরা ওই তরুণদের হোটেলে উঠিয়ে দিয়ে অভিযানে যাই। বলে যাই সকালে অভিভাবকদের ফোন করে যাতে ছেড়ে দেয়।” 

নিরুদ্দেশ আল-আমিনের বাবা নুরুল ইসলাম ও শিথিলের বাবা মো. মুজিবুর রহমান বলেন, হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজ দেখে নিহাল ও নিলয়কে তারা চিনতে পেরেছেন, কিন্তু বাকিদের চিনতে পারেননি। সে কারণে তাদের ধারণা, নিরুদ্দেশ হওয়া তরুণদের তালিকা আরও দীর্ঘ হতে পারে। 

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে কুমিল্লার কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি মুহাম্মদ সহিদুর রহমান বলেন, “বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। তদন্তের পরই সকল বিষয় পরিষ্কার হবে।” 

অভিভাবকদের সঙ্গে বৈঠক 

নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের প্রভাবে ওই তরুণরা ঘর ছেড়েছে- এমন তথ্যে তৎপর হয়েছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটও। 

বুধবার ওই ইউনিটের একটি দল কুমিল্লা যায়। তরুণদের অভিভাবকদের জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে ডাকা হয়। সেখানে তারা বেলা ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত অভিভাবকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। 

আল-আমিনের বাবা কুমিল্লা নগরীর ঝাউতলা এলাকার বাসিন্দা মো. নুরুল ইসলাম বলেন, “আমাদের কাছ থেকে তারা ঘটনার বিস্তারিত শুনেছেন। একে একে সবাই কথা বলেছেন। আমরা যা জানি সব বলে দিয়েছি। 

“আমি বলেছি, আল আমিন আমার বড় ছেলে। সে আগে তাবলিগের চিল্লায় গেছে অনেকবার। পড়াশোনার পাশাপাশি কান্দিরপাড়ে আমার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে সময় দে। ছেলের চলাফেরায় কখনও মনে হয়নি সে জঙ্গিবাদের মতো ঘটনায় জড়াতে পারে।” 

ইমরান বিন রহমানের বাবা মো. মুজিবুর রহমান কুমিল্লা পুলিশ লাইনস এলাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। 

তিনি বলেন, “আমাদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ বৈঠক করেছেন ঢাকা থেকে আসা পুলিশ কর্মকর্তারা। আমি ছেলের সম্পর্কে যা জানি সবই বলেছি। আমার ছেলে পড়াশোনা, কলেজ, কোচিং সেন্টার আর মসজিদ ছাড়া কোথাও যায় না।” 

মুজিবুর রহমানের ভাষ্য, ২৩ অগাস্ট দুপুরে ছেলে তাকে বলেছিল, কোচিং থেকে রেলস্টেশন মসজিদে বয়ান শুনতে যাবে বলে তার বাসায় ফিরতে দেরি হবে। 

“কিন্তু ওইদিন সে কোচিংয়ে যায়নি। আমি ছেলেকে ফেরত পেতে তাদের (কাউন্টার টেররিজম ইউনিট) সহযোগিতা চেয়েছি।”  

মুজিবুর বলেন, “আমার ছেলে একটি মুরগি জবাই দেখলেও ভয় পায়। সে কীভাবে জঙ্গিবাদে জড়াবে! যদি তেমনটা হয়, তাহলে আমার ছেলেকে তারা প্রশিক্ষণ দিতে নিয়ে গেছে। নিলয় নামের ছেলেটি মিথ্যা কথা বলে ঢাকা থেকে আসা আমাদের কাছে সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। এ ঘটনার পেছনে তার হাত থাকতে পারে।” 

Share if you like

Filter By Topic