গোপন মসলার রেসিপিতে জাদুকরি স্বাদের সেলিম কাবাব ঘর


মাহমুদ নেওয়াজ জয় | Published: November 30, 2022 16:54:22 | Updated: November 30, 2022 19:04:06


গোপন মসলার রেসিপিতে জাদুকরি স্বাদের সেলিম কাবাব ঘর

টিনশেড দেয়া ছোট একটা ঘর। ঘরভর্তি ১৫-১৮ জন মানুষ। একেকটা টেবিলে হয়তো সর্বোচ্চ ৫-৬ জন বসতে পারবেন। একদিকে শিকে গেঁথে পোড়ানো হচ্ছে কাবাব। তার ঘ্রাণ ছড়িয়ে যাচ্ছে আশপাশে। ঠিক বিপরীত দিকেই আরেকটি শাখা। অল্প কিছু চেয়ার টেবিল। গোটা ১০-১২ জন মানুষের বসার ব্যবস্থা। এখানে ভাজা হচ্ছে লুচি, সাথে আছে গরুর চাপ, মগজ ফ্রাই, গরুর বটি কাবাব, চিকেন চাপ, চিকেন বটি কাবাব (ব্রয়লার/ দেশি) ইত্যাদি।


মোহাম্মদপুরের স্থানীয়দের কাছে একনামে পরিচিত এই দোকান - সেলিম কাবাব ঘর৷ দোকানের সাইনবোর্ডে প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত সেলিম খানের একটি ছবি। দোকানটি সলিমুল্লাহ রোডে। ঈদগাহ মাঠ থেকে কিছুটা সামনে এসে বাম দিকে। বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভান্ডারের গলি বললেও চেনা যাবে।

দোকানটির দুই পাশে দুই শাখা। তবে বামপাশে থাকা টিনশেড শাখাটি পুরনো। এদিকটাতেই তাদের বিখ্যাত গরুর শিক কাবাব বিক্রি করা হয়। প্রতি প্লেট শিক কাবাবের দাম এখন ১২০ টাকা করে। চারটি শিক থাকে প্রতি প্লেটে। সাথে প্রতিটি লুচি ৫ টাকা করে। গরুর চাপ, গরুর বটি কাবাব ১১০ টাকা করে। দেশি মুরগির চাপ ১৪০ টাকা, ব্রয়লারটি ১০০ টাকা। গরুর মগজ ফ্রাই ১১০ টাকা।

দোকানটির শুরু আজ থেকে চুয়াল্লিশ বছর আগে, ১৯৭৮ সালে। সেলিম খান ছিলেন ভারতের বিহারের মানুষ৷ নিজের শৈশবে এসেছিলেন ঢাকায়, বিহারি বাবা-মার সাথে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি আবারো ভারতে চলে যান। বিহারে সপরিবার গিয়ে সেখানে রাস্তার ধারে বট (ভুঁড়ি) ও নেহারি বিক্রি করতেন৷ সে সময় একজন কবিরাজ / হেকিম তাকে বলেছিলেন, 'তোমার রান্নার স্বাদ ভালো হচ্ছে না।' হেকিম তাকে মসলা ব্যবহারে নতুন দিক নির্দেশনা দেন। এরপর সেলিম সাহেবের বিক্রি-বাট্টা ভালো চলছিল। পরে তিনি ঠিক করেন বাংলাদেশে ফিরে আসবেন। সে সময় হেকিম তাকে গোপন মসলার একটি স্পেশাল শিক কাবারের রেসিপি শিখিয়ে দেন। এগারো ধরনের জিনিস দিয়ে সেই সিক্রেট মসলা তৈরি করা হতো। এরপর সেলিম দেশে ফেরেন, ছোট একটি টিনশেড ঘরে শুরু করেন কাবাব বিক্রি। শুরুতে শুধু শিক কাবাবই হতো। পরে আরো বিভিন্ন আইটেম যুক্ত হয়েছে।

এসব কিছু জানা গেলো সেলিম খানের পুত্র লিয়াকত খানের কাছ থেকে। লিয়াকত খান কাবাব ও অন্যান্য আইটেমে নিজেই মসলা মাখিয়ে মেরিনেট করেন ও অন্যদের নির্দেশনা দেন। তবে তিনি অসুস্থ। বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারেন না। ২০১০ সালে এক দুর্ঘটনায় মেরুদণ্ডে আঘাত পান, স্ক্রু লাগানো হয়। তাই বেশিক্ষণ বসে থাকতে ও ভারি জিনিস বহন করতে পারেন না।

চলছে তাদের বিখ্যাত শিক কাবাবের প্রস্তুতি


তাকে এই দোকানের ভার নিতে হয় অল্প বয়সেই। সেলিম খানের মৃত্যু ঘটে ১৯৯৩ সালে। লিয়াকত তখন কেবল নয়/দশ বছরের। তখন দোকানের অন্য লোকদের সাথে দেখতেন। তার মা তখন ব্যবসার তদারকি করতেন, তবে দোকানে অন্য কর্মচারিদের ভেতর সিনিয়রেরা বসতেন৷ লিয়াকত কিশোর বয়স থেকে নিজেই দোকান দেখতে শুরু করেন। তার চোখের সামনেই সেলিম কাবাব মোহাম্মদপুর থেকে পুরো ঢাকায় পরিচিতি লাভ করেছে।


তিনি বলেন, " আমরা এখনো মূল রেসিপি মেনেই কাবাব বা অন্যান্য আইটেম বানাই। তবে সেটা আমরা কারো কাছে বলিনা। এটা সিক্রেট। এখানে কোনো কেমিক্যাল নাই। এগারো ধরণের জিনিস দিয়ে এই স্পেশাল কাবাব মসলা তৈরি, যেটা আমার আব্বাকে তার গুরু ( সেই হেকিম/ কবিরাজ) শিখায় দিছলেন।"

তবে সেলিম কাবাব ঘরের সমগ্র ঢাকায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকলেও তারা ফুডপান্ডা বা এমন কোনো অনলাইন মাধ্যমে নেই। এর কারণ হিসেবে বললেন, " লস হয়। অনেক সময় যা বিক্রি হয়, তার উপর কোম্পানি আমাদের না জানায়ে ছাড় দেয়। এতে একবার ৩৫ হাজার টাকার জায়গায় পাইছিলাম ১৭ কি ১৮ হাজার টাকা। তারপর থেকে ওটা বন্ধ করছি।"

সাধারণত শিক কাবাবের ক্ষেত্রে ঢাকায় প্রচলন আছে মাংস কিছুটা থেতানো/ পেষার। কিন্তু তাদের মাংস থাকে গোটা। তবে সেটি বেশ ভালো ভাজা ও নরম।

কাবাব বিষয়ে একটি কথা প্রচলিত আছে এমন, " ভালো কাবাব করতে হলে ঘামতে হয়। কারণ কাবাবের ভেতর হবে নরম, কিন্তু বাইরে থাকবে হালকা পোড়া ও শক্তভাব।"

কাবাব বিষয়ে এই কথাটি সত্য হয়ে ওঠে সেলিমের বেলায়। তাদের কাবাব মুখে দিলে বেশ নরম ও ঝাঁঝালো মসলার একটি আলাদা স্বাদ জিহ্বায় অনুভব করা যায়। কিন্তু মাংস ভালো সিদ্ধ হলেও গলে যায়না, আবার বাইরেটাও পুড়ে তিতকুটে হয়ে ওঠেনা।

তাদের মগজ ফ্রাই, বিফ চাপ/ বটি কাবাব, চিকেন চাপ/ বটি কাবাব- সবগুলো আইটেমের ক্ষেত্রেই এটা সত্য। এছাড়া তাদের আরেকটি আইটেম খুব জনপ্রিয় নাস্তা হিসেবে। মাত্র ২৫ টাকায় পাওয়া যায় তাদের 'কিমাপুরি।'

লিয়াকত জানান তারা ফ্রোজেন মাংস বা মহিষের মাংস ব্যবহার করেন না। তার কথায়, " কাবাবে গরুর মাংসের স্বাদ ফ্রিজের ওই মাংসে পাওয়া যায়না। এদিকে প্রত্যেক দিন গরু জবাই হয়। আমরা দেশি গরুর মাংস আনি। আর মুরগি ব্রয়লার/ দেশি দুটাই আছে। দাম কমের কারণে ব্রয়লার চলে বেশি, তবে দেশি মুরগির চাপের স্বাদ আলাদা।"

লিয়াকত মনে করেন তার বাবার রান্নার কায়দাগুলো ঠিকমত অনুসরণ করতে পেরেছেন বলেই সেলিম খানের ইন্তেকালের প্রায় ত্রিশ বছর পরও দোকানটি তার জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পেরেছে। এখনকার দিনে ফুড ভ্লগিং ও ফেসবুকে খাবার বিষয়ক গ্রুপগুলোর কল্যাণে দূর দূরান্ত থেকে মানুষ খেতে আসে। তবে তাতে করে তারা অনেক বেশি খাবার বানাতে গিয়ে মান নামাননি। যথাযথ মান বজায় রেখে যতটুকু করা যায়, সেভাবেই শিক কাবাব, চাপ, বটি কাবাব ও মগজফ্রাই বানাচ্ছেন।

তার মতে, " অনেক ছোট বয়স থেকে দোকানের সাথে থাকতে থাকতে আজকে এই জায়গায় আসছে দোকান। এর ভিতর বোনদের বিয়ে দিছি, নিজের সংসার-বাচ্চা হইছে। এখন তো খুব বেশি হাঁটা চলা করতে বা কাজ করতে পারিনি। তাও চেষ্টা করি যতটা পারা যায় নিজে সবকিছু তদারকি করতে। কাবাবের যে টেস্ট মানুষ একদম শুরু থেকে পাচ্ছে, সেই টেস্টটা যেন ঠিক থাকে, সেটাই খেয়াল রাখি আমরা সবসময়। "


মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত।

mahmudnewaz939@gmail.com

Share if you like