Loading...
The Financial Express

গুরুদুয়ারা নানকশাহীতে একদিন

| Updated: November 04, 2022 09:49:39


গুরুদুয়ারা নানকশাহীতে একদিন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার এই নীলক্ষেত রোডে প্রায়শই যাতায়াত। কারণটা বইয়ের দোকানে ঢুঁ মারা। কিন্তু আসা যাওয়ার পথে সাদা গম্বুজে মাথা তোলা দরগাটিকে ঠিক কোনো মসজিদ বা মাজার বলে মনে হচ্ছিল না। এর সাথে যখন প্রথম পরিচিতি তখন জানা গেল এটা নাকি শিখেদের মন্দির। খুব তাজ্জবে ধরা বিষয়, কারণ সাধারণে জানে এদেশ শুধু মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানের দেশ। এখানে শিখদের বাস আছে! ভারী কৌতুহলোদ্দীপক।

নীলক্ষেত রোডে আধুনিক ভাষা শিক্ষা ইনস্টিটিউটের পাশে , রোকেয়া হলের ঠিক উল্টো দিকেই রয়েছে গুরুদুয়ারার নানকশাহী। এটাই বাংলাদেশের প্রধান এবং সবচেয়ে বড় গুরুদুয়ারা। শিখেরা তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে গুরুদুয়ারা বলে- গুরুর ঘর। ধর্মগ্রন্থ গুরু গ্রন্থসাহেবকে এখানে সেবিত হয়। সব ধর্মের মানুষের জন্য এই স্থানটি উন্মুক্ত।

এক বন্ধুর থেকে শোনা, প্রতি শুক্রবার এখানে কিছু বিশেষ আয়োজন হয়। ওর সাথেই বেরিয়ে গেলাম এক শুক্রবার।

সময়টা তখন ১০টা। আশপাশটা চুপচাপ, বেশ শান্ত পরিবেশ। ধীরে ধীরে বাইরের শ্বেত তোরণ পেরিয়ে ভেতরটায় প্রবেশ করলাম। সামনেটা জুড়ে খুব সুন্দর যত্নে গোছানো বাগান। তার মাঝে দুটো বাঁধানো পথ। একটা সোজা গিয়ে পড়েছে গুরুদুয়ারার সামনে। আরেকটা ফটক ঘেঁষে একটা ছোট ঘরে। সকল অভ্যাগতদের এখানেই জুতো রেখে যেতে হয়। শিখদের মধ্যে এই অতিথিদের জুতো যদি নিজে হাতে পরিষ্কার করে দেওয়া হয়, তাহলে বহু পুণ্যফল সঞ্চিত হয়।


আমরা সেই ঘরটা ছেড়ে সামনে এগিয়ে এলাম।একটি গোল চত্বর। তাতে শিখদের পবিত্র গুরমুখী ভাষায় লেখা একটি প্রতীক শব্দ বসানো- যার অর্থ ঈশ্বর এক। একেই তারা 'সৎনাম' বলে জানান। এর চারপাশে রকমারি ফুলের গাছ। হাস্নাহেনার ঝাড়গুলি রোজ রোজ এখানে সুগন্ধের পসরা বসায়।


ঢাকার এই গুরুদুয়ারাটি ১৫০৪ সালে গুরু নানকদেবের পদযাত্রায় স্মৃতিধন্য স্থান। এখানে তিনি তার কিছু শিষ্যকে সর্বব্যাপী ঈশ্বরের একত্বতা আর বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধের উপদেশ দিয়েছিলেন। এই জায়গাটির পবিত্রতা স্মরণ করে শিখদের ৬ষ্ঠ গুরুর সময়কালে ভাইনাথ বলে একজন এই গুরুদুয়ারাটি প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় এখানে অনেক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। যেটি দেশ স্বাধীনের পর কিছুটা সারিয়ে নেবার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এদেশি কিছু নানকপন্থী ও অবস্থানরত কিছু ভিনদেশি শিখ ধর্মানুসারীদের কথা চিন্তা করে, এটি ১৯৮৮ এর দিকে আবার নব আঙ্গিকে সাজানো হয়। এটি সাধিত হয়েছিল ঢাকার আন্তর্জাতিক পাট সংস্থার প্রধান সর্দার হারবানস সিংয়ের তৎপরতায়। মূল উপাসনালয় ছাড়া এখানে আছে অতিথিভবন, লঙ্গরখানা আর শিখ গবেষণা কেন্দ্র।


উপাসনালয়ে প্রবেশের আগে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে মাথায় এক টুকরো কাপড় বাঁধতে হয়। তবে মেয়েরা চাইলে নিজেরাই ঘোমটা দিতে পারে।


প্রবেশের পথে পা ডোবানো যায় এমনই একখানা ছোট চৌবাচ্চার মতো। নিয়ম হলো যেই মন্দিরে প্রবেশ করুক না কেন, তিনি যেন এই শীতল জলে তার পা ধৌত করে নেন। শিখেরা সর্বতভাবেই পাক-পবিত্রতা নিয়ে সচেতন। তাই এখানের প্রতিটি কোণ শ্বেত-শুভ্র চকচকে রাখা হয়।


সদরের দুপাশে মন্দির গাত্রের আলোক কুঠুরিগুলি ঠিকরে ভেতরে জমছে বিন্দু বিন্দু আলো। দেয়ালে মানচিত্র আর শিখদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, কিছু বোধগম্য হচ্ছিল না কারণ ভাষাটা বাংলা নয়, গুরমুখী পঞ্জাবি। সামনে এগোতেই মধ্যখানে আবার একখানা ঘর। তার ঠিক মাঝেই মঞ্জিসাহেব নামে এক আসনে বিশাল রুমালে জড়িয়ে রাখা পবিত্র গ্রন্থসাহেব। উপরটা চাঁদোয়ায় মুড়িয়ে দেয়া। একজন ভক্ত তাকে চামর দিয়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছে।


সিলিংয়ে ঝাড়বাতি ঝুলছে। গ্রন্থসাহেবের আসনের পাশে চূড়া করে আরেক আসন। এইখানে একজন গ্রন্থী বসে পাঠ করেন গ্রন্থসাহেব। সাথে করেন ভজন আর জনসাধারণকে ধর্মবাণী শোনান সহজ ভাষায়। এই মাঝের ঘরটিকে ঘিরেই ভক্ত-দর্শনাথীরা মাথায় কাপড় বেঁধে বসে থাকেন, মন্দিরে থাকতে হলে যা একটুও সরানো যাবে না। এটা হলো গ্রন্থসাহেবের প্রতি বিনম্রতা প্রকাশের বিশেষ রীতি। যারা প্রকৃত শিখধর্মাবলম্বী তাদের অনেকেই পাগড়ি পরিধান করেন আর মহিলারা ওড়না বা শাড়ির আঁচলে ঘোমটা করেন। এই ঘরটার পাশে পিছনের দিকটায় একটি কাঁচ বাক্সে পবিত্র পাদুকা সংরক্ষিত আর দেওয়াল শেলফে কিছু ধর্মীয় বই রাখা।


ঠিক বারোটা বাজতেই শুরু হয়ে যায় পবিত্র গ্রন্থ পাঠ। অতঃপর তবলা হারমোনিয়ামের সাথে ভজন গান - পাঞ্জাবি ভাষায় গুরু গ্রন্থসাহেব আর নানকের জয়গান। একটু বাদে বাদেই ধ্বনি শোনা যায়- 'বাহে গুরু কি খালসা, বাহে গুরু কি ফতেহ।' অর্থাৎ পবিত্রকারী ঈশ্বর এক, তার জয় হউক।

কিছু সময় বসে থাকলে মনে হতে পারে যে, এখন বসে আছেন অমৃতসরে। গানগুলি বিভিন্ন রাগের সুরে গাওয়া, না চাইতেও যেন মনে লাগে। শুনে যাচ্ছিলাম মন দিয়ে যদিও বুঝতে পারছিলাম না কিছুই। ভজন-পূজন শেষে সবার মাঝে পরিবেশিত হল বাদামী রঙের ময়দার গরম হালুয়া।


এরপরে আসে লঙ্গরখানার ডাক। সে এক বিশাল লাইন। রোজ শুক্রবার এই ভোজ খেতে হাজারো দর্শনার্থীর আগমন ঘটে এখানে যার সিংহভাগ থাকে আশেপাশের ছাত্রাবাসে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।


বাংলাদেশে সেইভাবে জন্মগত শিখ এখন নেই। যারা আছেন তারা হয় ধর্মান্তরিত, নয় তো বাংলাদেশে কর্মরত কোনো পাঞ্জাবি। ধর্মস্থলটির দেখভাল করা স্বেচ্ছাসেবকরা প্রায়শই হিন্দু। তারা মন থেকে শ্রদ্ধা সহকারে এখানে আসেন।


প্রথম বৈঠকে ঠাঁই হলো না আমাদের। দ্বিতীয় পর্বে ঢোকা হলো। হলঘর খানি বিশাল। দেয়ালে শিখগুরুদের ছবি। মোটামুটি পাঁচশো এর মত মানুষের জায়গা হয়। মেঝেতে সারি সারি করে বসার জায়গা। খোপ করা স্টিলের থালায় ভোজন পরিবেশন করা হয়। খাবারের মান সাধারণ, নিরামিষ আহার। সাধারণ মানের ডাল, আলুর দম, একটি ভাজি তরকারির সাথে ভাত আর পায়েস। শেষ পাতে কখনো সখনো জিলাপি পরে।


গুরু নানকের পদধূলিতে ধন্য এই বঙ্গভূমে এককালে ১৮টির মতো গুরু দুয়ারা ছিল। এখন মোটে পাঁচটি। দেশভাগের সময় থেকেই এদেশে শিখেরা নিষ্প্রভ হয়ে যান। বাংলাদেশে বর্তমানে হাতে গোনা কয়েক হাজার শিখ আছেন। ঢাকার এই গুরু দুয়ারাটি ছাড়া পুরান ঢাকায় সংগতটোলা নামে এক গুরুদুয়ারা আছে, যেটি একাত্তরের ক্ষয়ক্ষতির পরে আর তেমনি ব্যবহৃত হয় না। এছাড়া চট্টগ্রামে দুটি আর ময়মনসিংহ একটি গুরুদুয়ারা আছে, যেখানে শিখ ধর্মাবলম্বীরা নিয়মিত প্রার্থনায় যান।


সুস্মিতা রায় বর্তমানে শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজে ৪র্থ বর্ষে পড়াশোনা করছেন।
[email protected]

Share if you like

Filter By Topic