সঙ্গীতবোদ্ধাদের একটা বড় অংশের কাছেই জিমি হেন্ড্রিক্স সর্বকালের সেরা গিটারিস্ট। সবার সেরা যদি নাও মানা হয়, তবে সেরাদের একজন হিসেবে তাঁকে মেনে নিতে আপত্তি হবে না কারোর-ই। মার্কিন এই সঙ্গীতশিল্পীকে রক মিউজিকের জগতে অমর করে রেখেছে তাঁর কিংবদন্তীতুল্য ইলেক্ট্রিক গিটার বাজানোর দক্ষতা। অল্পদিনের জীবনে সৃষ্টি করে গেছেন অমর কিছু সুরের ঝংকার যা আজো মানুষকে দোলা দিয়ে যায়, ছন্দে মাতায়।
জিমি জেন্ড্রিক্সের জন্ম ২৭ নভেম্বর, ১৯৪২। সিয়াটলে জন্ম নেয়া জিমির ছোটবেলা থেকেই রক অ্যান্ড রোলের প্রতি টান ছিল। সঙ্গীতে প্রথম হাতেখড়ি হয় বাবার কাছ থেকে পাওয়া হারমোনিকার মাধ্যমে, ১৩ বছর বয়সে। এরপর ১৫ তে হাতে পান জীবনের প্রথম অ্যাকুইস্টিক গিটার, বাবাই উপহার দিয়েছিলেন। সিয়াটলের গিটারিস্টদের কাছ থেকে প্রথম প্রথম কর্ড চিনলেও, প্রথাগত উপায়ে গিটার শেখা কখনোই হয়ে ওঠেনি জিমি হেন্ড্রিক্সের। তাঁর অসামান্য গিটার বাজানোর যে দক্ষতা, পুরোটাই নিজে নিজে শেখা বলেই দাবী করতেন তিনি।
স্কুলে থাকতেই জিমি বাজাতে শুরু করেছিলেন ইলেক্ট্রিক গিটার। তখন মূলত রেডিওতে গান শুনে সেই সুর নিজে বাজানোর চেষ্টা করতেন। এই যে শুধু শুনেই সেটা বাজানোর চেষ্টা, এটাই জিমিকে অন্য গিটারবাদকের চেয়ে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল। হাইস্কুল শেষে সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেও ২২ বছর বয়সে নিউইয়র্কে আসার পর থেকেই জিমি রক মিউজিকের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। প্রথম প্রথম বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও ব্যান্ডের সাথে বাজানোর চেষ্টা করতে থাকেন। পরবর্তীতে গড়ে তুলেছিলেন নিজেরই ব্যান্ডদল।
জিমি হেন্ড্রিক্সের প্রথম অ্যালবাম - আর ইউ এক্সপেরিয়েন্সডের কভার (ছবি: ভিনাইল রাইটারস)
রক, ব্লুজ, জ্যাজ – সবকিছুর সংমিশ্রণে নতুন আঙ্গিকে সুর সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন জিমি হেন্ড্রিক্স। ১৯৬৬ সালে নিউ ইয়র্কের গ্রিনউইচ ভিলেজের কনসার্ট তাঁকে এনে দেয়ে অবিশ্বাস্য রকমের খ্যাতি। সর্বসাকুল্য চার বছরের আনুষ্ঠানিক সঙ্গীতজীবন ছিল হেন্ড্রিক্সের। ম্যানেজার চাজ চ্যান্ডলার তাঁকে নিয়ে যান লন্ডনে। সেখানেই ১৯৬৭ তে নোয়েল রেডিং আর মিচ মিচেলের সাথে গড়ে ওঠা ‘দ্যা জিমি হেন্ড্রিক্স এক্সপেরিয়েন্সের’ প্রথম অ্যালবাম ‘আর ইউ এক্সপেরিয়েন্সড’ বাজারে আসে। মুক্তির পরপরই শিল্পী ও সমালোচকদের নজরে আসেন হেন্ড্রিক্স এবং প্রায় ৮ মাস ধরে চার্টের শীর্ষে ছিল আর ইউ এক্সপেরিয়েন্সড।
জীবনে বেশ কয়েকবার কনসার্টের স্টেজেই গিটার ভেঙেছেন জিমি হেন্ড্রিক্স। এমনকি তিনবার আগুনে পুড়িয়েও দিয়েছেন। এর পেছনের যুক্তিটাও একটু অদ্ভুত। জিমির ভাষ্যমতে, ‘আমার গিটার পোড়ানোটা আসলে বিসর্জন। যদি তুমি কোনো কিছুকে ভালোবাসো, তাহলে সেটিকে বিসর্জন দিতে হবে। আমি গিটার ভালোবাসি।’ এমন অবাক করা ভালোবাসার নমুনা সচরাচর দেখা না গেলেও, গিটার পুড়িয়ে যদি ভালো কিছু হয় , তবে তা পোড়ানোই ভালো।
উল্টা করে গিটার বাজানো জিমি হেন্ড্রিক্সকে করেছে সবার থেকে আলাদা (ছবি: গিটারস ডট কম)
এখানে একটা বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। জিমি হেন্ড্রিক্স ছিলেন বাঁ হাতি। কিন্তু তাঁর জানা ছিল না যে বাম হাতিদের জন্য আলাদা গিটার পাওয়া যায়। এটি না জানার কারণে জিমি ডান হাতিদের গিটারই উলটা করে বাজাতে শিখেছিলেন এবং এভাবেই বাজিয়েছেন পুরো জীবন। এর বাইরেও দাঁত দিয়ে, মাথার পিছনে রেখে, পায়ের ভেতর আটকে গিটার বাজাতে পারতেন জিমি হেন্ড্রিক্স। মঞ্চে ওঠা একজন রক অ্যান্ড রোল গিটারিস্টের পক্ষে যতো কারিশমা দেখানো সম্ভব, সেই সীমানা-ই বলতে গেলে নিজের ‘শোম্যানশিপের’ কল্যাণে পাল্টে দিয়েছিলেন জিমি হেন্ড্রিক্স।
প্রথাগত নিয়মের বাইরে গিয়ে একের পর এক গিটার বাজিয়েছেন জিমি হেন্ড্রিক্স (ছবিসূত্র: দ্যা জিমি হেন্ড্রিক্স কালেকশন)
জিমি হেন্ড্রিক্সের জীবনের সুর কেটে যায় মাদকের কালো থাবায়। মাত্র ২৭ বছর বয়সে ১৯৯০ সালে লন্ডনের এক হোটেলে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। মৃত্যুর কারণ হিসেবে দায়ী করা হয় মাদকের প্রভাবে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাওয়াকে। তবে কেউ কেউ দাবী করেন, অতিরিক্ত পরিমাণে ঘুমের ওষুধ সেবনের কারণেও জিমির মৃত্যু হতে পারে। কাকতালীয়ভাবে হলেও, এভাবেই রক মিউজিকের ‘দ্যা টুয়েন্টি সেভেন ক্লাবের’ অংশ হয়ে যান জিমি।
প্রতিভা, সৃজনশীলতা আর জীবনীশক্তির এক অপূর্ব মিশেল ছিলেন জিমি হেন্ড্রিক্স। প্রতিভার প্রতি সুবিচার তিনি করেছিলেনও। নিজে নিজে গিটার বাজাতে শিখে হয়েছেন সর্বকালের অন্যতম সেরা ইলেক্ট্রিক গিটারিস্ট। পরবর্তীতে যাঁরা রক মিউজিকের জগতে সুনাম কুড়িয়েছেন গিটারিস্ট হিসেবে, তাঁদের একটি বড় অংশেরই অনুপ্রেরণা ছিলেন জিমি। রক অ্যান্ড রোলের সুর যতোদিন আছে, ততোদিন জিমি হেন্ড্রিক্সের নামও অমর হয়েই থাকবে। গঁৎবাঁধা যান্ত্রিক জীবন হাঁপিয়ে উঠলে গিটারের ঝংকারে বেজে ওঠা ‘ভুডু চাইল্ড’ বা ‘হেই জো’র সুর আবার মানুষকে অন্ধকারে আলো জ্বালিয়ে পথ দেখাবে।
সিরাজুল আরিফিন বর্তমানে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত।