গাস্ত-ই-এরশাদ: ইরানের কুখ্যাত মোরাল পুলিশের উত্থান-পতন


ফাইয়াজ আহনাফ সামিন | Published: January 05, 2023 17:36:09 | Updated: January 06, 2023 12:50:21


গাস্ত-ই-এরশাদ: ইরানের কুখ্যাত মোরাল পুলিশের উত্থান-পতন

১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২। ইরানের কুর্দিস্তান থেকে সপরিবারে রাজধানী তেহরানের দিকে আসছিলো ২২ বছরের তরুণী মাশা আমিনিদের গাড়ি। সন্ধ্যায় তাদের গাড়ি থামায় মোরালিটি পুলিশ বাহিনী। তাদের মতে মাশা আমিনি তার মাথার হিজাব যথাযথভাবে পরেনি। তারা মাহসাকে গ্রেফতার করে। এরপর পুলিশি নির্যাতনের স্বীকার হয়ে ১৬ সেপ্টেম্বর মারা যান মাহসা আমিনি।

আমিনির এই হত্যা মেনে নিতে পারেনি ইরানের সাধারণ জনগণ। দেশব্যাপী শুরু হয় তুমুল আন্দোলন। আন্দোলন শুধু মোরালিটি পুলিশের নির্যাতনের বিরুদ্ধেই থেমে থাকে না। ইরানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে রূপ নেয় এটি। বছরের পর বছর ধরে ইরানের স্বাধীনচেতা জনগণের ওপর জোরপূর্বক ইসলামী শরীয়াহ আইন কায়েম করা হচ্ছে। নারীদেরকে কোণঠাসা করে স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়েছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। এ সবকিছুর বিরুদ্ধে যে ক্ষোভের আগুন চাপা ছিলো,মাহসা আমিনির হত্যার পর তা বিস্ফোরিত হয়ে দেশব্যাপী ছড়িয়ে যায় আন্দোলন। আন্দোলনে সরকারী বাহিনীর সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত নিহত হয় ৪৮০ জন সাধারণ নাগরিক। এছাড়াও জেলে নেয়া হয় হাজার হাজার আন্দোলনকারীকে।

ইরানের এই মোরালিটি পুলিশ গাস্ত-ই-এরশাদ নামে পরিচিত। এদের একমাত্র কাজ হলো রাষ্ট্রের সকল প্রাপ্তবয়স্ক নারী ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী যথাযথভাবে পর্দা করছে কিনা তা নজরদারি করা। তারা নারীদের গ্রেফতার করার ক্ষমতা রাখে। তবে এরা কোনো নির্দিষ্ট নিয়মের আওতায় বাহিনীর কর্মকান্ড পরিচালনা করে না। তারা শুধুমাত্র নারীদের ওপরই ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী পোশাক পরিধানের জন্য বলপূর্বক আইন প্রয়োগ করে থাকে। পুরুষদের ক্ষেত্রে এমন কিছু করা হয় না।

ইরানের অবস্থা সবসময় এমন ছিল না। ৭০ এর দশকেও ইরান ছিল বিশ্বের অন্যতম প্রগতিশীল একটি দেশ। তখন ইরানের শাসক ছিলেন শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভী। তিনি পশ্চিমা প্রভাবের আওতায় ছিলেন।

১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব হয়। ইরানের অবস্থা পালটে যায়। ইসলামী বিপ্লবের প্রধান নেতা আয়াতুল্লা রুহুল্লাহ খোমেনী ১৯৭৯ সালের ৭ মার্চ ডিক্রি (নির্দেশনামা) জারি করেন যে, নারীদেরকে কর্মক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক হিজাব পড়তে হবে। নির্দেশনামায় আরো ছিল যে, যেসব নারী হিজাব পড়বে না তাদেরকে নগ্ন হিসেবে গণ্য করা হবে।

এরপর ১৯৮১ সালে ইসলামী রীতি অনুযায়ী নারীদের আব্রু রক্ষা করা বাধ্যতামূলক করার আইন জারি করা হয়। এর অর্থ হলো মাথা থেকে পা পর্যন্ত পুরো শরীর ঢিলা পোশাক দিয়ে ঢাকতে হবে। ১৯৮৩ সালে সংসদে সিদ্ধান্ত হয় যে যেসব নারী এসব আইন মানবে না, তাদেরকে ৭৪ বার বেত্রাঘাত করা হবে। সম্প্রতি এ সাজার সাথে ৭ দিন কারাভোগও যোগ করা হয়।

২০০৪ সালে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন রহমত আহমদ-ইন-এজাদ। তিনি গঠন করেন গাস্ত-ই-এরশাদ। এর অর্থ হলো ‘নির্দেশ পালনকারী টহলদার’। গত বছরের ১৫ আগস্ট কট্টরপন্থী প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ক্ষমতায় আসেন। তিনি নতুন আইন জারি করেন যে নারীদের পোশাক পর্যবেক্ষণের জন্য সব জায়গায় সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হবে। আইন ভঙ্গ করলে নারীদের জরিমানা করা হবে। আর পুলিশ স্টেশনে ‘শিক্ষা’ দেয়া হবে কিভাবে যথাযথভাবে আইন মেনে চলতে হয়।

ইব্রাহিম রাইসি আরো আইন করেন যে অনলাইনে বা সোশাল মিডিয়ায় কোনো নারী যদি হিজাববিরোধী কথা বলে, তবে তার কারাদন্ড হবে। নারীদের হাই হিল জুতা ও পা এ স্টকিং পড়াও নিষেধ করা হয়। গলা ও কাঁধ ঢেকে রাখার আইন করা হয়।

ইরানের যে ইসলামী বিপ্লব হয়েছিল, তাতে কিন্তু ইরানের নারীরাও স্বতঃস্ফুর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। কারণ তাদের বলা হয়েছিল যে শাহ রেজা পাহলভীর শাসন থেকে বের হয়ে ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী দেশ শাসন করা হবে এবং নারীদেরকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হবে। তারা আগের মতো প্রগতিশীল ও স্বাধীন জীবন যাপন করতে পারবেন ইসলামী আইনের আওতায়।

কিন্তু যখন নারী-পুরুষের সম্মিলিত আন্দোলনের মাধ্যমে ইসলামী বিপ্লব সফল হয়, তখনই পুরুষরা নারীদের বলে এখন আর নারীদের প্রয়োজন নেই। তারা যেন ঘরে ফিরে যায় এবং পর্দার আড়ালে থাকে। শুরু হয় নারীদের ওপর কাঠামোবদ্ধ পুরুষতান্ত্রিক স্বৈরশাসন। নারীদের সাথে এই বিশ্বাসঘাতকতার নাম দেয়া হয় ‘ইরানের পুরুষতান্ত্রিক বিশ্বাসঘাতকতা’। কারণ নারীরা তো আরো পিছিয়ে যাওয়ার জন্য আন্দোলন করেনি। করেছিল স্বাধীনতার জন্য।

ইসলামী শাসন শুরু হওয়ার প্রথম থেকেই ইরানের নারীরা তাদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যত আইন জারি হয়েছে, তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আন্দোলন করেছে। এবং সবসময়ই তাদের বিরুদ্ধে পুলিশি হামলা-মামলা ও নির্যাতনের খড়্গ নেমে এসেছে। কিন্তু মাহসা আমিনির মৃত্যু যেন ইরানের কট্টর নারী বিদ্বেষী শাসন পন্থার বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভকে তুঙ্গে নিয়ে যায়। নারীরা রীতিমত নিজেদের চুল কেটে ও হিজাব আগুনে পুড়িয়ে প্রতিবাদ শুরু করে।

আন্দোলনে নারীরা ।   ছবি: রয়টার্স 

গত কয়েক মাসে চলমান এই আন্দোলনের জন্য বিশ্বব্যাপী ইরানের মুক্তিকামী জনগণরা আলোচনায় এসেছে বারবার। একই সাথে তুমুল সমালোচনার সম্মুখীন হয় ইরান সরকার ও তাদের মোরালিটি পুলিশ বাহিনী। ১ ডিসেম্বর ইরানের সংসদে নারীদের পর্দাপ্রথার আইন নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩ ডিসেম্বর এক প্রেস কনফারেন্সে ইরানের অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ জাফর মোনতাজরিকে মোরালিটি পুলিশ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন যে, “মোরালিটি পুলিশ বিলুপ্ত করা হয়েছে। এটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে চলতো। বিচার বিভাগের সাথে এর সম্পর্ক নেই। আমরা আগের মতোই সমাজে চলাচলের নিয়মকানুন জারি করার জন্য কাজ করে যাবো।”

পরে ইরান সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য ভুলভাবে প্রচার করা হয়েছে। ইরানে এখনো চরম পর্দাপ্রথা বিদ্যমান থাকবে বলে দাবি করে সরকার। আন্দোলনকারীদের সাথে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম যোগাযোগ করার পর তারা জানায় শুধু মোরালিটি পুলিশের বিলুপ্ত হলেই সন্তুষ্ট হবে না তারা। ইরানের শাসন পদ্ধতিতেও পরিবর্তন চায় তারা। তারা আরো জানায় যে মোরালিটি পুলিশ বিলুপ্ত করার কথা ইরান আগেও বলেছিল ২০১৪ সালে। যখন বাধ্যতামূলক পর্দার বিরুদ্ধে ‘হোয়াইট ওয়েডনেসডে’ আন্দোলন করেছিল ইরানবাসীরা। কিন্তু বিলুপ্তির কথা বলা হয়েছিল শুধুই আন্দোলন স্তিমিত করার জন্য।

মোরালিটি পুলিশ থাকুক বা না থাকুক, ইরানের জনগণের মনে তাদের গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে। স্বৈরশাসকের চোখ রাঙানিকে অবজ্ঞা করে নারীদের স্বাধীনতার পথ মসৃণ করে নেবে হয়ত তারাই।

 

ফাইয়াজ আহনাফ সামিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।

faiyazahnaf678@gmail.com

Share if you like