যিশুখ্রিস্টের জন্ম হয়েছে তারও ১৮ শ বছর আগের কথা, টাইগ্রিস নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল এক বাণিজ্যিক শহর; নাম জাখিকু। জার্মানির চুবিঙগেন মতান্তরে ট্যুয়োবিঙগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ববিদ পিটার ফাজনার খনন করে এই প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করেন।
জার্মান প্রত্নতাত্ত্বিক পিটার ফাজনার। সূত্র: ইউটিউব
প্রশ্ন হলো, এতোদিন পানির গভীরে থাকা এই শহর কী করে সবার সামনে এলো? এই প্রশ্নের উত্তর বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে একদিকে উত্তরের বরফ যেমন গলছে একইসাথে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর নদীতীরবর্তী অঞ্চল শুকিয়ে যাচ্ছে। দেখা দিচ্ছে খরা। এই খরার কারণেই পানির গর্ভ থেকে ভেসে উঠেছে হাজার বছর আগের সভ্যতা জাখিকু যা বর্তমান ইরাকের উত্তরে কুরদিশ অঞ্চলে টাইগ্রিস নদীর তীরে অবস্থিত। এটি কেমুনে নামক একটি প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত।
কেমন ছিল এই শহর? কী করতো এর বাসিন্দারা? কীভাবেই বিলীন হয়ে গেলো এর অস্তিত্ব?
জাখিকুর জন্ম
খ্রিস্টপূর্ব ১৮ শ বছর আগে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৩ হাজার ৮ শ থেকে ৪ শ বছর আগে প্রাচীন ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যের মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের অন্তর্গত একটি ছোট্ট রাজ্য জাখিকু।
পানি ও মাটি দুই মাধ্যমেই শহরটি ছিল সেসময়ের বাণিজ্যিক রাস্তা। কেননা অন্যান্য রাস্তায় দস্যুদের হামলার শিকার হবার ভালো সম্ভাবনা ছিল। কাজেই মেসোপটেমিয়া, ইরাক, সিরিয়া ও তুরকিয়েসহ উত্তরাঞ্চলের মানুষজন গাছের গুড়ি ও কাঠের ব্যবসার জন্য টাইগ্রিস নদী দিয়ে তাদের মালপত্র এই শহরে নিয়ে আসতো। উদ্দেশ্য ছিল এগুলো মজুদ করা এবং পরবর্তী গন্তব্যে পৌঁছে দেয়া।
জাখিকুর খনন কাজ, সূত্র: চুবিঙগেন বিশ্ববিদ্যালয়
শুধু গাছের গুড়ি নয় বিভিন্ন মূল্যবান ধাতব পদার্থ যেমন তামা, রূপা ও স্বর্ণ এসবের বাণিজ্যের জন্যেও ইরান ও তুর্কির পার্বত্য অঞ্চলের বণিকেরা এই শহর ব্যবহার করতেন।
যা জানা গেল
সাড়ে তিন হাজার বছর আগে জাখিকু শহরটি ইন্দো-ইউরোপীয় গোষ্ঠী "হিত্তিত"রা দখল করে। তবে শহরটি আবাদ করায় মনোযোগী হয়নি এজাতি, পরবর্তীতে উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার মিত্তানি সাম্রাজ্যের অধীনে আসে এই রাজ্য এবং তারাই এটিকে পুরোদস্তুর শহরের রূপ দেয়।
প্রত্নতাত্ত্বিক ফাজনারের অনুসন্ধান বলে, শহরে কয়েক তলবিশিষ্ট বাড়ি ছিল। রাজ্যপ্রধানের জন্য একটি প্রাসাদ এবং নিরাপত্তার জন্য উঁচু দেয়ালে সুসজ্জিত ছিল এই নগরী। কাদামাটিকে পুড়িয়ে শক্তভীত তৈরি করে নির্মাণ করা হয়েছিল এর ঘরবাড়ি। রাজ্যপ্রধানের প্রাসাদ তুলনামূলকভাবে বিশাল এবং তিনিই মূল সাম্রাজ্যের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখতেন। এছাড়াও পণ্য মজুদের জন্য গুদাম ঘরও পাওয়া যায় জাখিকুতে।
মিত্তানি সভ্যতার ইতিকথা
কথায় আছে নদী শুকিয়ে গেলেও এর রেক (পথ) শুকায় না। কথাটি ফলে যায় মিত্তানি সভ্যতার নগরী জাখিকুর ক্ষেত্রেও।
খননের পর সেখানে ১৫×১৫ সেন্টিমিটারের টেবলেট আকারের কিছু লেখা পাওয়া যায়। ফাজনারের মতে গুদামে নতুন পণ্য আসলে এই টেবলেটগুলোতে লেখা হতো, পরে রোদের শুকিয়ে রাখা হতো। এছাড়া এই নগরীতে ২০ থেকে ২৬ ফুটের বিশাল কক্ষ পাওয়া গিয়েছে যেগুলো গুদাম ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হতো বলে ধারণা করা হয়।
এসিরীয় আমলের টেবলেট আকৃতির পাথরে পোড়া মাটিতে লিখিত নিদর্শন, সূত্র: চুবিঙগেন বিশ্ববিদ্যালয়
জাখিকুদের ভাষা হারিয়ান তবে তাদের অঞ্চলের বাইরে ভাষাটি অপ্রচলিত ছিল। তাই প্রাসাদ ও নগরজুড়ে বাণিজ্যিক সুবিধার জন্য আকাডিয়ান ভাষায় লেখা হতো। গুদামের নোটগুলোও এই ভাষায় লেখা।
যেভাবে বিলীন হলো জাখিকু
খ্রিস্টপূর্ব ১৪ শ থেকে ১৩ শ সালের মধ্যে শক্তিশালী ভূমিকম্পের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নগরী। জাখিকুর দেয়াল ভূমিকম্পের ধাক্কা নিতে পারেনি ফলে ভেঙ্গে পড়ে বেশিরভাগ বাড়ি ও গুদাম ঘর। ফলে এর অবশিষ্ট বাসিন্দারা নগরী ছেড়ে উত্তরে পাড়ি দেয়। শহরটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। তবে এসিরীয়রা এই ধ্বংসস্তূপের মাঝে নিজেদের বসতি গড়ে তুলে। তবে এই নিগরীতে তারা ৫০ বছরের বেশি বসবাস করেনি।
জাখিকু অঞ্চলের তাপমাত্রা গ্রীষ্মকালে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসও ছাড়ায়। ফলে তীব্র খরা দেখা দেয় এবং চাষাবাদের জন্য অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে এই এলাকার জমি। খরা সমস্যা নিরসন ও পানি সেচের জন্য ১৯৮০ সালে সেসময়ের রাষ্ট্রপ্রধান সাদ্দাম হোসেন বাঁধ নির্মাণ করেন। এতে বন্যা হয় ফলে সমগ্র প্রাচীন নগরী নদী গর্ভে তলিয়ে যায়।
২০১৮ সালে খরার কারণে আবারো ভেসে ওঠে এই নগরীর ধ্বংসাবশেষ। তখন জার্মান প্রত্নতাত্ত্বিক দল আরো খনন করে উদ্ধার করে ৩ হাজার ৮ শ বছর আগের জাখিকু নামের এই বাণিজ্যিক নগরী।
মো: ইমরান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যয়নরত।