গ্রামের হাট থেকে কেনা খাবার, হয়তো এক ঠোঙা মুড়ি। খাওয়া শেষে সেই কাগজ ফেলে দেয়া হয়, গাড়ির জানালা দিয়ে উড়ে উড়ে সেই কাগজ ঘুরপাক খায়। কয়েক সেকেন্ডের শট। উঠছে, নামছে– সেই তৈজস কাগজ। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে কাগজ পৌঁছোয় যার কাছে, তিনি এ থেকে গ্রহণ করেন মানুষের চন্দ্রাভিযানের বার্তা। সমগ্র মানবজাতির প্রাপ্তির সাথে যখন ব্যক্তিগত স্বাধীনতা জুড়ে যায়, তখন মনে হয় সব মানুষই বোধহয় কোথাও না কোথাও এক সুতোয় বাঁধা। সেই সুতোতেই দৃশ্যের সাথে দৃশ্যকে ঠিক ছন্দ নয় অথচ ছান্দসিকতায় বুনে বুনে একটা সুন্দর ধাঁধা তৈরি করেন বুদ্ধদেব। পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। কবি বুদ্ধদেবও তো আছেন, যিনি ক্যামেরায়ও কবিতা খুঁজে বেড়ান। নিজের কাছে প্রশ্ন রাখেন, “ক্যামেরার ছোট্ট কাঁচ দিয়ে কী দেখছো তুমি? কী দেখছো আজ?”
‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’ সিনেমার দৃশ্য যখন বেমালুম মিলে যায় তাঁর ‘অন্য গ্রহ’ কবিতার সাথে– ‘বিমলা অমলা কমলা অন্য একটা গ্রহে ঢুকে গেল, নিজেরাই নিজেদের ভালোবাসতে লাগলো’, তখন মনে হয় কবিতাই হয়তো বুদ্ধদেবের চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য।
ভাষার ব্যাকরণ নিয়ে অত ভাবেননি, নিজস্ব ফর্মুলায় গড়ে তুলেছেন একেকটি সৃষ্টি। তাঁর সেই ফর্মুলাও বেশ মজার– 'গ্লাসে একটু জল রাখলাম, তার সাথে একটু বাস্তবতা মেলালাম, তার সাথে একটু স্বপ্ন মেলালাম, তার সাথে একটু কবিতা মেলালাম তারপর যে শেকটা তৈরি হলো সেটাই আমার সিনেমা।' সিনেমার শেকটায় বুদ্ধদেব যে জাদুর ছড়ি ঘোরান, তা তথাকথিত ব্যাকরণ থেকে কিছুটা দূরে। নিরীক্ষামূলক ভাষার প্রয়োগ তার চলচ্চিত্র নির্মাণে বেশ উল্লেখযোগ্য। নাটকের জগৎ থেকে উঠে আসা ব্রেখটিয়ান মেথডকে নিজের মতো করে দৃশ্যায়নে ব্যবহার করেন তিনি। তাঁর প্রথম পরিচালিত সিনেমা ‘দূরত্ব’ থেকেই চলচ্চিত্রে ব্যাকরণীয় এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন তিনি। সিনেমায় ব্যবহৃত ফ্রিজ শটগুলো বা জাম্প কাট দৃশ্য, ফ্ল্যাশব্যাকে অতীতের গলিতে কুশীলবদের ঢুঁ মারা কিংবা একেবারে শেষের দিকে এসে সোজা দর্শকের দিকে তাক করে ছুঁড়ে দেয়া চাহনি; সরল ভঙ্গিতে এগোয়নি কিছুই। নির্মাণের পদ্ধতিতে সক্রিয় রাখতে যেন দর্শককে একটু পীড়া দেয়া, আবার তাতে বুলিয়ে দেয়া কাব্যের উপশম– এমনটাই বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের চলচ্চিত্র নির্মাণের মনস্তত্ত্ব।
নিজেকে, নিজের অতীত ও বর্তমান অস্তিত্বকে যেমনটা অনুভব করেছেন, তেমনটা নিজের তৈরী ইমেজে আনার চেষ্টা করেছেন। ইমেজের পর ইমেজ জুড়ে দিয়ে বুনেছেন একেকটি ক্যামেরার কাব্য। কোনোটাকেই তিনি ‘অটোবায়োগ্রাফিকাল’ বা ‘আত্মজৈবনিক’ লেবেল না জুড়ে দিয়ে বরং ভাবতে ভালোবাসতেন, তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিতেই তিনি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। ঠিক যেমন স্রষ্টাদের থাকা হয়। ‘স্বপ্ন ও জাদুবাস্তবতায় এক মাতাল আড্ডার স্মৃতি’ লেখায় চলচ্চিত্র নির্মাতা রাজীব আহসান স্মরণ করেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সাথে এক আকস্মিক সান্ধ্য সাক্ষাতের, যাতে এ ভাষ্য আরো স্পষ্ট হয়– ‘বুদ্ধদেবদা ফিরে গেলেন তাঁর শৈশবের বর্ণিল দিনগুলোতে। যে শৈশবে মিশে ছিল স্বপ্ন ও ম্যাজিক। যার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই তাঁর প্রায় প্রতিটি সিনেমায়। তাঁর বিখ্যাত ‘লাল দরজা’ সিনেমার দন্ত চিকিৎসক যখন শৈশবে ফিরে গিয়ে বলে– ‘ছোটি মোটি পিঁপড়া বোটি, লাল দরজা খোল দে।’ বুদ্ধদেব দা জানালেন– এটা তারই শৈশব।’
সংখ্যায় খুব বেশি সিনেমা হয়তো তৈরি করেননি তিনি। আসলে চানওনি। নিজেকে অযথা গতিময় করে না তুলে চেয়েছেন যতটা সৃষ্টি করা যায়, ততটা যেন সন্তুষ্টির নয়। সাফল্যের জন্য নিজের মধুর একাকিত্ব থেকে দূরে থাকার সমঝোতা তিনি করেননি।
অনিন্দিতা চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে সম্প্রতি মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন