‘লন্ডন ব্রিজ ইজ ডাউন’ - রানী গতকাল তার স্কটিশ এস্টেট বালমোরালে মারা যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীকে টেলিফোন লাইনে এই কোড বাক্যাংশের মাধ্যমে ঘটনাটি সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছিল।
এর পরে, যোগাযোগের একটি দীর্ঘ সুতিকাগার রচনা করে ক্যাবিনেট সচিব এবং সিনিয়র মন্ত্রীদের তখন অবহিত করা হয় - এবং তথ্য গোপন রাখার জন্য অনুরোধ করা হয় বাকিংহামের পক্ষ থেকে।
রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ছিলেন ব্রিটিশ ইতিহাসের দীর্ঘতম সময় রাজত্বকারী ব্যক্তি। তিনি ১৯৫২ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং ৭০ বছর রাজত্ব করেন, বৃহস্পতিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ তারিখে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। তার বয়স হয়েছিলো ৯৬ বছর।
তার মৃত্যুর পর কমপক্ষে ১২ দিনের জন্য ব্রিটেন স্থবির হয়ে পড়বে, যার ফলে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে কোটি কোটি টাকার উপার্জন আয় ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।
তবে শুধু অর্থনীতি নয়। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে রাজা তৃতীয় চার্লস সিংহাসন আরোহণ করবেন এর মধ্যেই এবং একই সাথে ব্রিটেনের জাতীয় সংগীতের শব্দে পরিবর্তন করা হবে।
এছাড়াও পুরো ব্রিটেনজুড়েই আরো বেশকিছু পরিবর্তন আসবে।
প্রাসাদের কর্মীদের ছুটিতে পাঠানো হবে
প্রাসাদে অবস্থিত রাজকীয় আদালতে যেকোন ক্ষেত্রে কর্মীদের সংবাদ এবং নির্দেশাবলী বিতরণের জন্য একটি স্টাফ হটলাইন রয়েছে।
প্রাসাদ এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ কর্মী সদস্যকে এই ঘোষণার পরে অবিলম্বে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
পার্লামেন্টের সব কার্যক্রম স্থগিত করা হবে
সিলেক্ট কমিটি এবং সর্বদলীয় সংসদীয় দলের নির্ধারিত বৈঠকসহ ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২২ এর পরে স্থগিত করা হবে। এরপর যেহেতু কর্তৃত্ব রাজ্যাভিষেকের উপর নয়, প্রিন্স অব ওয়েলস, প্রিন্স চার্লস, ‘রানীর মৃত্যুর সময় স্বয়ংক্রিয়ভাবে রাজা হয়ে উঠবেন,’ ডঃ ক্যারোলিন হ্যারিস কানাডাভিত্তিক একজন ইতিহাসবিদ, লেখক এবং রাজকার্য বিষয়ক গবেষক এ ব্যাখ্যা করেছেন।
এবং একজন নতুন রাজা
প্রিন্স চার্লসকে আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন রাজা হিসেবে ঘোষণা করা হবে। চার্লসের সিংহাসনের নাম 'অপারেশন স্প্রিং টাইড'। নতুন রাজা তারপর প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভা সঙ্গে তার প্রথম বৈঠক আয়োজন করবেন।
পতাকা অর্ধনমিত থাকবে
বৃহস্পতিবার রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর উইন্ডসর ক্যাসেলে পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক মহাসাগরের ওপারে, ক্যাপিটালগুলোকে পতাকা অর্ধনমিত রেখে ওড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ব্রিটেনের হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি এ টুইট করেছেন।
যুক্তরাজ্যে, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পরের দিন সকাল ৮টা পর্যন্ত পতাকা একইভাবে ওড়ানো হবে, গ্রেটার লন্ডন লিউটেন্যান্সির দিকনির্দেশনা অনুসারে, গির্জাগুলোও রানীর মৃত্যুর দিন থেকে তার পরের দিনগুলোতে পরবর্তী ঘোষণা না আসা পর্যন্ত তাদের ঘন্টাগুলো বাজানো বন্ধ রাখবে।
একইসাথে রানীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। কিছুই আর সেদিন চলবে না বলে জানা যায়।
যুক্তরাজ্যের অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
১৯৯৭ সালে প্রিন্সেস ডায়ানার মৃত্যুর পর দ্য গার্ডিয়ান লিখেছিলো, অনেক ব্রিটিশ নাগরিক “অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দিন তাদের দোকান বন্ধ করতে বা খেলার সূচিগুলো বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিলো।” এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সম্প্রতি ইংল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকার টেস্ট ক্রিকেট ম্যাচ বাতিল হয়ে গেছে।
রানীর মর্যাদা এবং আধুনিক ব্রিটেনের প্রতিটি কাজ এবং অংশের মধ্যে তিনি কতটা অন্তর্নিহিতভাবে জড়িয়ে ছিলেন তা বিবেচনা করে, তার মৃত্যুর জন্য আরও বেশিদিন ধরে এসকল নিষেধাজ্ঞা থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সরকারী-বেসরকারি সংস্থাগুলো যে প্রোটোকলগুলো অনুসরণ করবে তা সংস্কৃতি, মিডিয়া এবং ক্রীড়া বিভাগ থেকে নির্দেশনা অনুযায়ী হবে (যদিও এর বেশ কিছু বাকিংহামের প্রাসাদ থেকে আসতে পারে)।
রানীর শেষকৃত্য ও কবর
এ ব্যাপারে কোনো তথ্য এখনও ব্রিটেনের পক্ষ থেকে খোলসা করা হয়নি। তবে সমাধি কোথায় হতে পারে তা নিয়ে ধারণা দিয়েছে একাধিক গণমাধ্যম। স্কটল্যান্ডের বালমোরাল অথবা স্যান্ডিংহামে রানীর নিজস্ব সম্পত্তিতে এ ক্রিয়া সম্পন্নের পর সমাহিত করার সম্ভবনায় বেশি। এ জায়গা দুটির সাথে রাজ পরিবারের সম্পত্তির কোনো সম্পর্ক নেই।
আবার একইসাথে তার বাবা ষষ্ঠ জর্জের মতো তার শেষশয্যা সেইন্ট জর্জ চ্যাপেলেও হতে পারে।
মুদ্রা এবং সংগীতের পরিবর্তন
গ্রেট ব্রিটেনের মুদ্রায় এখন রানীর ছবি শোভা পায়। তবে রানীর মৃত্যুর কারণে বাজার থেকে সব কাগুজে মুদ্রা তুলে নিয়ে সেখানে রাজা চার্লসের ছবি বসানো হবে। এরপর জাতীয় সংগীতে রানীর বন্দনা করে যেসব লাইন গাওয়া হয় সেখানে রাজার নাম বসিয়ে পরিবর্তন করা হবে।
এসকল পরিবর্তন একেবারেই সহজ কথা নয়। তবুও কালক্রমানুসারে করতে হবে। নিয়মের ব্যত্যয় সম্ভব নয়। পরিবর্তন আসবে ডাকটিকেটেও।
বন্ধ থাকবে কমেডি শো
বিবিসি সাংবাদিকেরা এধরণের পরিস্থিতির জন্য নিজেদের প্রস্তুত রাখেন সর্বদায়। ১৯৫২ সালে এলিজাবেথের বাবা মারা যাবার সংবাদ সম্প্রচারের সময় সাংবাদিকের গলায় লাল টাই থাকায় তা সমালোচিত হয়। এরপর থেকে অফিসে সবসময় কালো টাই কালো স্যুট রাখা হয়।
সে সময়ে টানা ৪০ দিনের মত বিবিসিতে কমেডি শো বন্ধ ছিলো। এবারই একইভাবে বিবিসি তাদের সব কমেডি শোয়ের সম্প্রচার বন্ধ রাখতে চলেছে।
কমনওয়েলথের ভবিষ্যত
মূলত রাজনৈতিকভাবে এ মৃত্যুর প্রভাব এতই বেশি যে ভেঙে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে কমনওয়েলথের মতো সংগঠন। ধারণা করা হয় রানীর প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকেই ১৬টি দেশের জনগণ রিপাবলিকের সমর্থন জানায়নি। তবে এবারে জানাতে পারে।
১৬টি দেশ, যাদের দেশের প্রধান কাগজে-কলমে এখনও ব্রিটিশ রাজপরিবার। এই ১৬টি দেশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেশগুলো হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, বারবাডোজ, নিউজিল্যান্ড, জ্যামাইকা প্রভৃতি। এমনকী ব্রিটেনও রিপাবলিক হয়ে ওঠার সম্ভবনা তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশেও ব্রিটেনের রানীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে।
মোজাক্কির রিফাত বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত।