বাঙালি কবি ও নাট্যকার, বাংলার নবজাগরণ সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি বিট্রিশ ভারতের যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে যাঁর জন্ম।
"'দাঁড়াও পথিক-বর, জন্ম যদি তব বঙ্গে; তিষ্ঠ ক্ষণকাল!"
বাংলা সাহিত্যে সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক, মাইকেল মধুসূদন দত্তের সমাধিফলকে খোদাই করা রয়েছে এ চরণ কয়েক। ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে সাহিত্যসাধনা শুরু করলেও কবি মধুসূদনের শব্দ সাধনা পূর্ণতা কিন্তু পেয়েছিল মাতৃভাষা বাংলাতেই৷ বাংলা ভাষায় প্রথম মৌলিক নাটক শর্মিষ্ঠা (১৮৫৯) থেকে শুরু করে পদ্মাবতী (১৮৬০), কৃষ্ণকুমারী (
তবে কবিকে অমরত্ব এনে দিয়েছিল তাঁর মেঘনাদবধ কাব্য। "দেবতা নয় মানুষ মূখ্য" ধারায় বিশ্বাসী মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্য বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সংযোজন। যুদ্ধক্ষেত্রে বিজয়ী পক্ষের কথাই ইতিহাসে উঠে আসে বরাবর, লেখা হয় জয়ীদের বীরত্বের জয়গাঁথা। মধুসূদন কিন্তু তা করলেন না। পরাজিত পক্ষের বীর সেনাপতি মেঘনাদের পক্ষালম্বন করে, যুক্তি তর্ক উপস্থাপন করে লিখলেন মেঘনাদবধ কাব্য নামক মহাকাব্য।
নতুন ঘরানা, নতুন ছন্দ
মধুসূদন মানেই অন্যরকম কিছু। শিল্পগুণ বিবর্জিত গৎবাঁধা নাট্যধাঁচকে ভেঙে নাট্যকার মধুসূদন পাশ্চাত্য শৈলীর অনুসরণে প্রথম আধুনিক বাংলা নাটক রচনা করলেন। শুরু হলো নাটকের নতুন যুগ। পদ্মাবতী নাটকে মাইকেল ঘটিয়েছিলেন অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যবহার আর ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অমিত্রাক্ষরে লেখেন 'তিলোত্তমাসম্ভব' কাব্য। এমনকি মাইকেল মধুসূদনই বাংলা কাব্যে প্রথম হোমেরিক স্টাইলের লেখার প্রবর্তন করেন।
মধুর স্মরণে মধুমেলা
কবির জন্মদিন উপলক্ষে প্রতিবছর সাগরদাঁড়িতে বসে মধুমেলা। ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন কলকাতায় মারা যান বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ১৮৯০ সালে কবির ভাইঝি কবি মানকুমারী বসু কবিস্মৃতিতে প্রথম স্মরণসভার আয়োজন করেন বাস্তুভিটা সাগরদাঁড়িতে। তখন থেকেই মূলত শুরু হয় মধুমেলার আনুষ্ঠানিকতার। সেই হিসেবে ১৩১ বছর ধরে চলে আসছে ঐতিহ্যবাহী মধুমেলা। মাঝের দুটো বছর কেড়ে নিয়েছে করোনা মহামারী।
১৯৭৩ সাল থেকে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় যশোর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে কবির জন্মদিন ২৫ জানুয়ারি থেকে শুরু করে সাতদিনব্যাপী মধুমেলার আয়োজন করা হয়। এবারো তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। ২৫-৩১ জানুয়ারি ৭ দিনব্যাপী থাকছে মধুমেলার আয়োজন। কবির বাল্যস্মৃতি বিজড়িত কপোতাক্ষ নদের তীরে শুরু হয় এই মেলা।
মেলা প্রাঙ্গণে বসে কয়েকশ’ স্টল। ঘটে হাজারো দর্শনার্থীর সমাগম। করোনা মহামারীর কারণে বিগত দু'বছর মধুমেলার চিরাচরিতরূপকে ছদ্মবেশ নিতে হয়েছিল। এবারে আবার সেই পুরোনোভাবে ফিরছে জাঁকজমক, মধুপল্লিতে মধুমেলা ফিরছে উৎসবমুখর পরিবেশে।
মেলায় বিভিন্ন স্টলের অনুমোদন দেয়ার কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। মধুপল্লির ভেতরে কবিদের আড্ডা নামের একটি বিশেষ স্টলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কবি-সাহিত্যিকদেরকে নিয়ে চা, কফি আর বইয়ের আড্ডার জন্যে এই স্টল। মুক্তমঞ্চে মধুমেলার সাতদিনই থাকছে যাত্রাপালার আয়োজন।
বিভিন্ন জেলার ৭ টি যাত্রাপালার দল অংশগ্রহণ করবে এ আয়োজনে। কেশবপুরের স্থানীয় শিল্পী, যশোর জেলার শিল্পীদের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশনায় থাকবেন জলের গান ও গান কবি ব্যান্ড। এবারের মেলার বিশেষ আকর্ষণ কৃষি ফল উৎসব। গত ৪/৫ বছর বন্ধ থাকবার পর এবার আবারো শুরু হচ্ছে কৃষি ফল উৎসব। মধুকর স্মরণিকার কাজ প্রায় শেষের দিকে৷ মধুমেলায় প্রতিবছরের মাইকেল মধুসূদন পদক প্রদানের আনুষ্ঠানিকতাও থাকছে।
যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামের মাঝি মহানন্দ হালদার (৫৫) জানান, তিনি ২৫ বছর যাবৎ কপোতাক্ষ নদে নৌকা চালান। কবির পবিত্র জন্মভূমি তারও জন্মভূমি। তিনি জন্ম থেকেই দেখে আসছেন এ মেলা। মধুমেলার সময়ে দেশ-বিদেশের পর্যটকের ভিড় উপচে পড়ে সাগরদাঁড়িতে। মধুমেলার ৭ দিনে নৌকা চালিয়ে দিনপ্রতি ১২০০-১৪০০ টাকা আয় করেন। বছরের অন্য সময়ে যেখানে দিনপ্রতি আয় ২৫০-৩০০ টাকা। তবে মেলায় আগের মতন পুতুলনাচের আসর এখন আর বসে না। এখন বসে ম্যাজিক শো।
কেশবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকতা এম. এম. আরাফাত হোসেন জানান, ২০২১ এবং ২০২২ করোনা মহামারীর কারণে মধুমেলা বসেনি। এবারে কবির ১৯৯তম জন্মদিনকে ঘিরে নতুনভাবে বসছে ঐতিহ্যবাহী মধুমেলা। ২৫ জানুয়ারি সকালে মেলার উদ্বোধন করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। মধুমেলাকে সফল করে তুলতে প্রশাসন থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। গত ১০ জানুয়ারি বিকেলে যশোর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সাগরদাঁড়িতে সপ্তাহব্যাপী মধুমেলা নিয়ে বিশেষ আইন শৃঙ্খলা বিষয়ক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। নিরাপত্তা জোরদার করার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এছাড়া থাকবে মেটাল ডিটেক্টর এবং ৫০ টি সিসি ক্যামেরার ব্যবস্থা।
রেশমি চুড়ি, বিভিন্ন ধরনের শৌখিন সামগ্রী থেকে শুরু করে শিশুদের বিভিন্ন প্রকার খেলনা, মণ্ডা-মিঠাই, ভাজা চানাচুর, মুড়ি-মুড়কি-মোয়া আর মিষ্টি পানের হরেক রকমের দোকান বসবে এ মেলায়। নাগরদোলা, সার্কাস, যাত্রা আর ম্যাজিকশো তো থাকছেই। এছাড়া মধুসূদনের জীবন ও সাহিত্যকর্মের ওপর বিভিন্ন দুর্লভ বই পাওয়া যায় এ মেলায়।
সাগরদাড়ি গ্রামের চা বিক্রেতা মনোতোষ কুমার সাহা (৫০) জানান, জানুয়ারি মাসে মধুমেলার সময়ে দর্শনার্থীদের ভিড় হয় সবচেয়ে বেশি। কেননা জানুয়ারি মাসে এলে মধুপল্লি আর মধুমেলা একসাথে দেখবার একটা সুযোগ থাকে। তাই এক ঢিলে দুই পাখি মারতে বহু পর্যটক ছুটে আসেন এখানে। এসময়ে চায়ের বিক্রিও অনেক বেড়ে যায়। অন্যান্য দোকানগুলোর বিক্রিবাট্টাও বেশ বাড়ে। গত দুবছর মেলা না হওয়ায় সেরকম ভিড় আর দেখা যায়নি। এবারে নতুন করে মেলা বসছে বলে জানতে পেরেছেন। মেলার প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে। তিনি খুবই আনন্দিত।
কবি মধুসূদন দত্তের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে সরকারি উদ্যোগে তার বাড়িটি সংরক্ষণ করা হয়েছে। নাম দেওয়া হয়েছে ‘মধুপল্লি’। ১৯৬৫ সালে ২৬ অক্টোবর তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বাড়িটি পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে।
মধুপল্লিতে রয়েছে সাবেকি আমলের নকশায় তৈরি কবির পৈতৃক কাছারি বাড়ি, বসতবাড়ি, কবির কাকার বাড়ি, বাড়ির পুকুরঘাট। রয়েছে কবির ব্যবহৃত আসবাবপত্র, কলের গানসহ মধুসূদনবিষয়ক বিভিন্ন দুষ্প্রাপ্য দলিল, চিঠিপত্র, পাণ্ডুুলিপি, হাতে আঁকা ছবি -যেগুলোকে রাখা হয়েছে মধুপল্লির মিউজিয়ামে।
মধুপল্লির ঠিক বিপরীত দিকে রাস্তার ওপারে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে উঠেছে কবি খসরু পারভেজের সংগ্রহশালা - মধুসূদন মিউজিয়াম। এখানে কবির দুর্লভ কিছু ছবি, বই আর অনুলিপি দলিল রাখা আছে।
"রেখো, মা, দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে"
বঙ্গভূমির প্রতি কবির এ মিনতি কিন্তু বিফলে যায় নি। দেশ আর দশ কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তকে ভোলে নি। জানুয়ারি মাসের কনকনে ঠাণ্ডায় মধুমেলার ভিড় আর জাঁকজমক বারবার প্রমাণ করে দেয় কীর্তিমানের মৃত্যু নেই। ঐতিহাসিক মধুমেলা এবছরও সফল ও সুন্দর হয়ে উঠুক।আরো একবার মানুষের পদচারণায় মুখরিত হোক মধুপল্লি। নবীনের পূজারী মহাকবি মধুসূদন বেঁচে থাকুক বাঙালির অন্তরে, মধুস্মৃতিতে মধুমেলা চলুক হাজার বছর।
অনুস্কা ব্যানার্জী (শ্রাবস্তী) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশোনা করছেন।