সভাপতিকে কেন্দ্র করেই চলে একটি রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম, যেভাবে সৌর পরিবারে সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে পৃথিবীসহ গ্রহগুলো। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
ভারতবর্ষের সবচেয়ে প্রাচীন রাজনৈতিক দল কংগ্রেসে এমন সূর্য হয়ে ছিলেন মহাত্মা গান্ধী, সরোজিনী নাইডু, নেতাজী সুভাষ বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মতো মহারথীরা। জহরলাল নেহেরুর পর মূলত তার পরিবার থেকেই আসছিলেন সভাপতিরা।
তাতে আবার ছেদ ঘটার প্রস্তুতি পর্বে পথ খুলেছে শশী থারুরের; উপমহাদেশের সর্বপ্রাচীন রাজনৈতিক দলটিতে নেতৃত্বে আসার।
সার্বক্ষণিক রাজনীতিতে মাত্র এক যুগ ধরে থাকলেও কূটনীতিক, লেখক, বক্তা, সোশাল মিডিয়া সেলিব্রিটি হিসেবে শশী থারুর অচেনা কোনো ব্যক্তি নন। তবে তার পরিচিতি অনেকটা বুদ্ধিজীবীর মতো।
কংগ্রেসের চরম দুর্দশার মধ্যেও কেরালা থেকে নির্বাচিত হয়ে লোকসভায় দলের প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি।
এই পরিস্থিতিতে গান্ধী পরিবার নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোয় আগামী ১৯ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচন। আর সেখানে দলের নেতাদের নেক নজরে থাকা কর্ণাটকের নেতা মল্লিকার্জুন খড়গের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে তাকে।
শশী ইতোমধ্যে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি দলের মধ্যে ভোটের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত তো বটেই, সেইসঙ্গে মোটেও কারও তল্পীবাহক নন।
এনডিটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শশী বলেছেন, সভাপতি হতে তিনি কতটা আশাবাদী, আর তার প্রস্তুতিইবা কতটা।
কংগ্রেসের নেতৃত্বের কাছে ‘সংস্কারপন্থি’ ও ‘বিদ্রোহী’ শিবিরের লোক হিসেবে তকমা পাওয়া শশী আশা করছেন, অভ্যন্তরীণ এই ভোটে সোনিয়া গান্ধী নিরপেক্ষ অবস্থানেই থাকবেন।
রাহুল গান্ধী ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর সঙ্গে কথা বলেও প্রভাবশালী এই পরিবারের নিরপেক্ষ থাকার ধারণাই পেয়েছেন তিনি।
এই লড়াইয়ে যোদ্ধা হওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে টুইটে উর্দু কবি মাজরুহ সুলতানপুরীর শায়েরের কয়েকটি পঙক্তি পোস্ট করেছেন শশী।
“আমি আমার একার যাত্রা শুরু করেছি, লোকেরা তাতে যোগ দেয় এবং বাড়তে থাকে কাফেলা,” আশার সুর ফুটেছে শশীর কণ্ঠে।
‘স্বাধীনচেতা ও স্পষ্টবাদী’
জাতিসংঘে আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন, রাজনীতিতে এসে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলে, একজন বেস্টসেলার লেখক, সোশ্যাল মিডিয়ায় পৌনে এক কোটি ফলোয়ার যার, সেই শশী থারুরকে স্বাধীনচেতা ব্যক্তি হিসেবেই মেলে ধরছে ভারতের সংবাদ মাধ্যম।
৬৬ বছর বয়সী শশী থারুর চলেন নিজস্ব রীতি ও নীতি মেনে।
তিনি আলোচিত জি-২৩ গ্রুপ অর্থাৎ ২৩ নেতার একজন, যারা ২০২০ সালে কংগ্রেসকে খোলনলচে বদলে দিতে সোনিয়া গান্ধীর কাছে চিঠি লিখেছিলেন। দেশের রাজনীতিতে দলের কোণঠাসা হয়ে পড়ার জন্য দলের ‘নিষ্ক্রিয়তাকে’ দায়ী করা নেতাদের একজন শশী। ওই ঘটনার পর তার ‘বিদ্রোহী’ শিবিরের নেতার তকমা জোটে।
সভাপতি হিসেবে সোনিয়া গান্ধী টানা ১৯ বছর কংগ্রেসের হাল ধরেছিলেন, ২০১৭ সালে যে দায়িত্ব তিনি ছাড়েন ছেলে রাহুলের হাতে। জাতীয় নির্বাচনে দুই বারের হারের পর রাহুল ২০১৯ সালে পদত্যাগ করেন এবং অন্তর্বর্তী সভাপতির দায়িত্ব নেন সোনিয়া। তবে সেই নেতৃত্ব রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পৌঁছানোর পথে নতুন কোনো ঝলক আনতে ব্যর্থই হয়। এরপর একের পর এক রাজ্যসভা নির্বাচনে দলটির হারের পর দাবি ওঠে দলের নেতৃত্ব পরিবর্তনের।
দীর্ঘ ২২ বছর পর দলের নেতৃত্ব খোঁজার নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হলে শুরু হয় প্রার্থীর নাম নিয়ে জল্পনা। সেই জল্পনার মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লড়তে নিজের আগ্রহের কথা জানান শশী।
পিটিআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্টবাদী এই নেতা বলেছিলেন, “কংগ্রেস তার দলের লোকজনকে একত্রিত করতে যত বেশি সময় নেবে, ভোটব্যাংক ক্ষয়ের ঝুঁকি তত বাড়বে।”
শশী আত্মবিশ্বাসী যে কংগ্রেসের নতুন কাণ্ডারী হতে সামর্থ্যবান। তিনি এমন একজন নেতা যিনি দলের বর্তমান অবস্থান তিনি হতাশ হয়ে যাননি। দলকে শক্তিশালী করার ক্ষমতা রাখেন এবং ভোটারদের কছে দেশের জন্য কংগ্রেসের গুরুত্ব তুলে ধরতে পারেন।
শশী থারুর সম্পর্কে বলা হয়, তিনি একজন বিস্ময়কর ব্যক্তিত্বও বটে। রাশি রাশি প্রতিকূলতার মধ্যেও নিরুৎসাহিত না হয়ে লড়াইয়ে প্রস্তুতি তার থাকে।
কূটনীতি থেকে রাজনীতিতে, বক্তা থেকে লেখক
শশী থারুরের জন্ম লন্ডনে ১৯৫৬ সালে। দুই বছর বয়সে বাবা-মার সঙ্গে ভারতে ফিরে আসার পর তার পড়াশোনা হয় বিভিন্ন স্কুলে, এরমধ্যে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলও রয়েছে।
দিল্লির নামকরা স্টিফেন কলেজ থেকে ইতিহাসে স্নাতক ডিগ্রি নেন শশী। ছাত্রজীবনেই নেতা বনে যান তিনি, হন কলেজ ছাত্র সংসদের সভাপতি। যুক্তরাষ্ট্রের মেডফোর্ডের ফ্লেচার স্কুল অব ল অ্যান্ড ডিপ্লোমেসিতে মাস্টার্স করে একই বিশ্ববিদ্যালয় পিএইচডিও করেন তিনি। তখন তার বয়স মাত্র ২২ বছর।
কূটনীতিক হিসেবে শশী পেশাজীবন শুরু করেন ১৯৭৮ সালে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থায় যোগ দিয়ে। জাতিসংঘে শান্তিরক্ষা, যোগাযোগ ও জনতথ্যের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর জাতিসংঘ মহাসচিবের উপদেষ্টার দায়িত্বেও ছিলেন তিনি।
জাতিসংঘের মহাসচিব পদের জন্য ভারত শশীকে প্রার্থীও মনোনীত করেছিল। কিন্তু ২০০৬ সালের ওই প্রার্থী নির্বাচনে সাতজনের মধ্যে তার অবস্থান ঠেকে দ্বিতীয়তে। সেবার মহাসচিব নির্বাচিত হন দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক কূটনীতিক ও রাজনীতিবিদ বান-কি মুন।
এরপর দেশের রাজনীতিতে আনুষ্ঠানিক পা রাখেন শশী, ২০০৯ সালে। সেবার কংগ্রেসের টিকেট নিয়ে লোকসভা নির্বাচনে কেরালার থিরুভনাস্থাপুরম থেকে এমপি নির্বাচিত হন তিনি। সেই যে শুরু, এরপর থেকে এখন পর্যন্ত কেরালায় কংগ্রেসের ভার অনেকটা তারই হাতে।
তবে ওই নির্বাচনে কেরালা কংগ্রেস নেতাদের একাংশের বিরোধিতার মুখেও পড়েছিলেন তিনি। কংগ্রেস নেতাদের অভিযোগ ছিল ‘বহিরাগত’ হিসেবে থারুর মনোনয়ন যৌক্তিক নয়। এরপর ধীরে ধীরে কংগ্রেসের রাজনীতির গভীরে প্রবেশ করেন শশী। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারে তিনি কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীও হন।
বলা হয়, রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে মসৃণভাবে এগিয়ে নিতে সোশ্যাল মিডিয়াকে বড় হাতিয়ার করতে শশী থারুর সিদ্ধহস্ত। ২০১৩ সালে টুইটার ব্যবহারে সমসাময়িক সব রাজনৈতিক নেতা এমনকি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকেও তিনি ছাড়িয়ে যান।
শশী থারুর তার রাজনৈতিক বক্তব্য পেশ করায় স্বল্প কিন্তু তীক্ষ্ণ শব্দের শিরোনাম তৈরিতে পটু। তৈরি করেন নিত্যনতুন শব্দও, যা তার নিজস্ব অভিধানেও যুক্ত হয় পরবর্তীতে।
তিনি নিজেকে বিতর্কের মধ্যে খুঁজে পেতেও পছন্দ করেন। যেমন ২০০৯ সালে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে তিনি ভ্রমণ বিষয়ে ‘ক্যাটল ক্লাস’ (গবাদি পশুর শ্রেণি) মন্তব্য করায় বিপাকে পড়েন। পরবর্তীতে ক্ষমা চেয়ে ছাড় পান তিনি।
সরকারের প্রতিমন্ত্রী থাকার সময়ে কেরালার কোচি শহরের ক্রিকেট দলের প্রতি তার প্রশ্নবিদ্ধ আগ্রহের অভিযোগ ওঠে। এরপর ২০১০ সালে তিনি পদত্যাগ করে মন্ত্রিত্ব ছাড়েন।
ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও বিতর্কিত হয়েছেন শশী থারুর। স্ত্রীকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে শশী জড়িয়ে পড়ে মামলায়।
২০১৪ সালে নয়া দিল্লির একটি অভিজাত হোটেল থেকে শশীর স্ত্রী সুনন্দা পুস্করের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। মারা যাওয়ার মাত্র কয়েকদিন আগে জনসম্মুখে পাকিস্তানের এক নারী সাংবাদিকের সঙ্গে শশীর প্রণয়ের অভিযোগ করেছিলেন সুনন্দা।
সুনন্দা ছিলেন শশীর তৃতীয় স্ত্রী। তার প্রথম স্ত্রী ছিলেন একজন বাঙালি; যার সঙ্গে তার কলেজ থেকে ছিল প্রেম। দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন একজন কানাডিয়ান।
স্ত্রী সুনন্দার মৃত্যুর চার বছর পর পুলিশ এ মামলার অভিযোগপত্র জমা দেয়। তিন হাজার পাতার ওই অভিযোগপত্রে শুধু শশীর নাম থাকলেও কোনো অভিযোগ তার বিরুদ্ধে ছিল না বলে জানায় ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম। শেষমেশ গত বছর দিল্লির একটি আদালত তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়।
স্ত্রীর মৃত্যুর বছরে শশী লোকসভা নির্বাচনে কেরালার সেই আসনে দ্বিতীয় বার জয় পান। ওই বিজয় সহজ ছিল না, কারণ নরেন্দ্র মোদীর জয়জয়কারে ভারত তখন উত্তাল। সেই জয়ের ধারা অব্যাহত থাকে ২০১৯ সালেও। ওই নির্বাচনে শশী তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপি-এনডিও জোট প্রার্থী কুম্মানাম রাজশেখরনককে ৯৯ হাজার ৯৮৯ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে তৃতীয়বারের মতো আসনটি ধরে রাখেন।
টানা ১৩ বছর ধরে কেরালায় জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করে ২০২০ সালের জুলাই মাসে শশী থারুর কংগ্রেসের নেতা এ চার্লসের রেকর্ড ভাঙেন। চার্লস ১৯৮৪ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত সাত বছর একটি রাজ্যের এমপি ছিলেন।
শশী থারুর ভারতের লোকসভার পররাষ্ট্র বিষয়ক স্থায়ী কমিটির চেয়ারপারসন ছিলেন। বর্তমানে তিনি তথ্য প্রযুক্তি ও যোগাযোগ প্যানেলের চেয়ারম্যান।
সুবক্তা হিসেবে সুপরিচিত শশীর থারুরের লেখা ২৩টি বইয়ের মধ্যে ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান নভেল’, ‘অ্যান এরা অব ডার্কনেস’, ‘হোয়াই আই এম এ হিন্দু’, ‘দ্য প্যারাডক্সিকাল প্রাইম মিনিস্টার’ উল্লেখযোগ্য।
লেখার প্রাপ্তিও পেয়েছেন এই লেখক। ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান নভেল’ উপন্যাসটি ইউরেশীয় অঞ্চলে বছরের সেরা বই নির্বাচিত হয় এবং এজন্য তিনি কমনওয়েলথ লেখক পুরস্কার জিতে নেন।
এছাড়া সাহিত্যে বিশেষ অবদান রাখায় স্পেনের রাজার তরফেও তিনি ‘স্পেন’স কমান্ডার অব দ্য অর্ডার অব চার্লস থ্রি’র মতো মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার পান। ‘অ্যান এরা অব ডার্কনেস’ বইটির জন্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারের পাশপাশি ফ্রান্সের ‘শেভালিয়ার দে লা লিজিয়ঁ দ্য ’অনার’ও পান তিনি।