'তার চোখে সাগরের নীল, বাদামি চুলে নামছে ধূসর ছায়া, কণ্ঠ যেন মধুমাখা মিষ্টতার ধীরতা, অনন্য করে তুলেছে তাকে তার রমণীয় গুণাবলি ও বুদ্ধিমত্তা ।' - এলমিরাকে নিয়ে এক বন্ধু এমনটাই বললেন এডগার অ্যালান পো- কে।
এই রিচমন্ডে, এলমিরার কাছে প্রায় ২৩ বছর পর ফিরলেন পো।
হারিয়ে ফেলা প্রথম ভালোবাসাকে নিয়ে আবারও স্বপ্ন দেখতে থাকলেন তিনি।
১৮৪৮ সালের কথা। বহুদিন পর এডগার অ্যালান পো এসেছেন রিচমন্ডে। এই সেই রিচমন্ড যেখানে খুঁজে পেয়েছিলেন জীবনের প্রথম প্রেমকে। সেও বহুদিন আগের কথা। ১৮২৫ সাল। পো তখন কেবল ষোল বছরের এক কিশোর। আর তার প্রথম প্রেম - এলমিরা; সে তখন পনের বছরের কিশোরী।
প্রায় দুই যুগ পর রিচমন্ড ফিরে এক বন্ধুর মুখে শুনলেন এলমিরার কথা। ২৩ বছর পেরিয়ে এলমিরা এখন আটত্রিশ বছরে। বিধবা, দুইসন্তান আছে। আর দুই সন্তান কৈশোর পেরোতেই মারা গেছে। কিন্তু তার চোখ দুটো এখনো রয়েছে সেই সাগরের মতই গভীর নীল, ঘন কালো চুলে হালকা পাক ধরেছে।
পো তখন খ্যাতিমান কবি, লেখক, সমালোচক। রিচমন্ডে এসেছেন একটা লেকচারে বক্তব্য দিতে। আমেরিকান কবিতা নিয়ে তখন বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বক্তব্য দিতেন তিনি। বড় হলঘরে টিকেটের বিনিময়ে শ্রোতারা সেই বক্তব্য শুনতেন।
পো-র স্ত্রী ভার্জিনিয়া ততদিনে প্রয়াত। পো তখন অনেকের কাছে মদ্যপ উদ্ভ্রান্ত এক মানুষ। হ্যাঁ, খ্যাতিমান কবি তিনি- কিন্তু ব্যক্তিজীবন তখন এলোমেলো। তাছাড়া হরর লেখক হিসেবে চমকপ্রদ যেমন, তেমনি আবার কারো কারো কাছে স্রেফ একজন উদ্ভট লেখক।
পো রিচমন্ড এলেন। এলমিরার সাথেও দেখা হলো। পো-র ফুফু ও শাশুড়ি মারিয়া ক্লেমকে এক চিঠিতে পো লিখলেন, 'আমি আবারো ফিরে পেয়েছি আমার হারানো ভালোবাসাকে, জীবন সম্পর্কে আবারো আশাবাদী হয়ে উঠছি।'
এলমিরা বিধবা হয়েছেন চার বছর হয়। পো বছরখানেক হলো বিপত্নীক। পো আবারো বিয়ের প্রস্তাব করেন তাকে। ২৩ বছর আগে গোপনে বাগদান সেরেছিলেন তারা, এলমিরার পিতার অমতেই। তারপর পো ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলেন, তারপর কিছুদিন ছিলেন সেনাবাহিনীতে। এরপর তো পত্রিকা সম্পাদনা, লেখালেখি, সাহিত্য সমালোচনা - এসবই।
এলমিরার সাথে শুরুতে তিনি যোগাযোগ রাখতেন। কিন্তু তার বাবা ব্যাপারটি টের পেয়ে যান। তারা অভিজাত পরিবার ছিলেন। অনাথ পো বড় হয়েছেন পালিত বাবা-মার ঘরে। তাই এই সম্পর্ক মেনে নেয়ার মত মানসিকতা তার বাবার ছিল না। তিনি মেয়ের কাছে লেখা পো-র সব চিঠি পুড়িয়ে ফেলেন। দুই বছর পর প্রখ্যাত পরিবহন ব্যবসায়ী আলেক্সান্ডার ব্যারেট শেলটন এর সাথে এলমিরার বিয়ে হয়। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান ১৮৪৪ সালে।
এরপর দুই সন্তান আর বিপুল সম্পত্তি নিয়ে এলমিরার দিন কেটে যাচ্ছিল। তবে একজন সঙ্গীর প্রয়োজন ছিল তারও। নিঃসঙ্গতা তাকেও গ্রাস করছিল।
মধ্যবয়সে পো ও এলমিরা, ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
পো এর ভেতর একাধিক প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছেন। ফুফাত বোন ভার্জিনিয়া ক্লেমের সাথে বিয়ে হয়েছে। তবে তার সাহিত্য, বিশেষত কবিতাতে বেশ কয়েকবারই উঠে এসেছে এই অনাকাঙ্ক্ষিত বিচ্ছেদের স্মৃতি। তামেরলিন, টু জান্তে, দ্য র্যাভেন, টু হেলেন এর মত কবিতাগুলোতেও বারবার উঠে এসেছে সেসব স্মৃতিবিজড়িত দিন।
পো-র প্রস্তাব পেয়ে তখন এলমিরা বিচলিত হন। সন্তানদের সাথে আলোচনা করে বুঝলেন তারাও রাজি নয়। তাছাড়া বিয়ে করলে সম্পত্তির চার ভাগের তিন ভাগও হারাতে হবে।
তবে সবকিছুর পরও পো-র প্রতি তার অনুরাগ তখনো কমেনি। তিনিও সেটি বুঝতে পারছিলেন। পো ততদিনে মদ্যপ ও জুয়াড়ি। সে নিয়ে তার চিন্তা ছিল। তাই পো-কে একটি খ্রিষ্টধর্মীয় প্রচার সংস্থারও (সনস অভ পিটারসেনস) সভ্য হতে বলেন তিনি।
সে সময় থেকে আবারো পত্র যোগাযোগ গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে। একসময় মারিয়া ক্লেমকে লেখা চিঠিতে তিনি জানান তাকে শাশুড়ি হিসেবে গ্রহণ করতে অর্থাৎ, পো-কে বিয়ে করতে তিনি প্রস্তুত।
১৮৪৯ সালের কথা। সেপ্টেম্বরে পো আবার রিচমন্ড আসেন। সাহিত্য আলোচনায় বক্তা হিসেবে। সে সময় তারা ঠিক করেন পো আরো দুটো আলোচনায় অংশ নিয়ে অক্টোবরের মাঝামাঝি ফিরবেন। তারপর তারা বিয়ে করবেন। বিয়ের দিন ঠিক হয় অক্টোবরের ১৭ তারিখ।
কিন্তু পো আর কখনো রিচমন্ড ফিরতে পারেননি।
১৮৪৯ এর ২৬ সেপ্টেম্বর রাতে পো রিচমন্ড ছেড়ে যান। সেদিনই সন্ধ্যায় এলমিরার সাথে দেখা করতে আসেন। অনেকক্ষণ কথা বলেন। বিগত দিনের স্মৃতিরোমন্থন করতে করতে স্বপ্ন বুনতে থাকেন আগামীর। তবে সে সময় কিছুটা বিষণ্ণ দেখায় পো-কে। কিছুটা অসুস্থও ছিলেন।
সেদিন সন্ধ্যায় পো বিদায় নেবার পর থেকেই এক অজানা উৎকণ্ঠায় সারা রাত কাটে এলমিরার। পরদিন সকালেই তিনি পো-র খোঁজে যান। জানতে পারেন পো জাহাজে চেপে বাল্টিমোরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছেন।
এই বাল্টিমোরেই ১৮৪৯ সালের ৩ রা অক্টোবর গুরুতর আহত ও অসুস্থ অবস্থায় পো-কে হাসপাতালে নেয়া হয়। সে সময় তিনি কিছুই মনে করতে পারছিলেন না। দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক ডা. জন জোসেফ মোরানকে পো বারবার বলছিলেন, "আমার স্ত্রীকে আমি রিচমন্ডে রেখে এসেছি, ওর কাছে আমাকে ফিরতেই হবে।"
পো মারা যান ৭ অক্টোবর, ১৮৪৯ এ। সে সময় তাকে বেশ অনাদরে কবর দেয়া হয় সেখানেই। শেষকৃত্যে অল্প কিছু মানুষ ছিলেন। মৃত্যুর ২৬ বছর পর ১৮৭৫ সালে তার কবর চিহ্নিত করা হয় ও যথাযোগ্য মর্যাদায় শেষকৃত্য করা হয়।
সে বছরই ভাস্কর এডওয়ার্ড ভ্যালেন্টাইনের কাছে সাক্ষাৎকার দেন এলমিরা। পূর্বের ২৬ টি বছর তিনি এ বিষয়ে ছিলেন প্রায় নিরব। এই সাক্ষাৎকারে আসে পো-র জীবনী লেখক ও গবেষক জন এইচ.ইনগ্রামের প্রসঙ্গও। ইনগ্রাম পো-র মৃত্যুর পেছনে এলমিরার ভাইদের হাত আছে বলে মনে করতেন।
এলমিরা তাতে সায় দেননি। অবশ্য সেটিকে অন্য অনেকেই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হিসেবেই দেখতেন। তবে এলমিরা এই সাক্ষাৎকারে অভাবিতভাবে পো-র সাথে তার সম্পর্কের কথা ও বাগদানের কথা অস্বীকার করে যান। তবে পরবর্তীতে ডা. জোসেফ মোরানকে লেখা এক চিঠিতে তিনি পো-র হাসপাতালে কাটানো পাঁচদিনের বিশদ বিবরণ চেয়েছিলেন। তার কাছে তিনি ব্যক্তিগতভাবে স্বীকারও করেছিলেন যে, তাদের বাগদান হয়েছিল।
মারিয়া ক্লেমকে লেখা এক চিঠিতে বলেছিলেন, এই পৃথিবীতে তার সবচেয়ে প্রিয় হলেন পো। তবে কেন এই অস্বীকার? হয়ত পরিবার-পারিপার্শ্বিকতার চাপেই।
১৯২২ সালে পো-র স্মরণে জাদুঘর তৈরি হলে এলমিরার নাতনি সেখানে তার দাদীর কাছে থাকা পো-র একটি অ্যালবুমিন প্রিন্টেড ছবি, দাগেরোটাইপ একটি ছবি, ব্যবহৃত রুমাল হস্তান্তর করেন, যা ১৮৮৮ সালের ১১ অক্টোবর মৃত্যুর আগপর্যন্ত এলমিরা সযত্নে সংরক্ষণ করতেন। তবে তিনিও কখনো জানতে পারেননি তাদের বাগদানের কথা।
১৮৮৮ সালের ১১ অক্টোবর ৭৮ বছর বয়সে এলমিরার মৃত্যু হয়। কিশোর বয়সে একবার হারানো ভালোবাসা আবার মধ্যবয়সে ফিরে এসেছিল, তারপর চিরতরেই হারিয়ে গেল। পো-র মৃত্যুর পর জীবনের অর্ধেকটা কাটিয়েছেন নিঃসঙ্গভাবেই। তার মৃত্যুর পরদিন রিচমন্ডের ম্যাগাজিন 'হুইগ' তাদের ফ্রন্ট পেজে তাকে নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন ছাপায়। যার শিরোনাম ছিল- 'পো-র প্রথম ও শেষ ভালোবাসা।'
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী।