একুশের বইমেলা শুরু থেকে বাংলা একাডেমির আয়োজনে হয়ে এলেও এবার সংস্কৃতি সচিব তার মন্ত্রণালয়ের নাম যুক্ত করতে চাওয়ায় দেখা দিয়েছে দ্বন্দ্ব।
বইমেলার নীতিমালা এবং দীর্ঘদিন চর্চিত আচারে বাংলা একাডেমিই ‘প্রাণের’ এই মেলার এই আয়োজক হিসেবে স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান।
এখন সংস্কৃতি বিষয়ক সচিব আয়োজকের ঘরে মন্ত্রণালয়ের নাম বসাতে চাওয়ায় সমালোচনা উঠেছে লেখক-সংস্কৃতিকর্মীদের মধ্য থেকে। একে বাংলা একাডেমির উপর হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছেন তারা।
আয়োজকের ভূমিকায় মন্ত্রণালয়ের নাম ওঠানোর ক্ষেত্রে সংস্কৃতি সচিব যুক্তি দেখিয়েছেন, বাংলা একাডেমি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত একটি প্রতিষ্ঠান।
একুশের বইমেলার শুরুটা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে হয়নি। এর শুরুটা হয় মুক্তধারা প্রকাশনীর মালিক চিত্তরঞ্জন সাহার হাত ধরে।
১৯৭২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির ফটকে চট বিছিয়ে বই বিক্রি শুরু করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৭৭ সালে তার সঙ্গে আরও অনেকে যোগ দেন, তাতে বই বিক্রির এই আয়োজন অনেকটাই মেলার রূপ পায়।
১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক ড. আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে এ বইমেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন। পরের বছর মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি।
১৯৮৩ সালে মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকার সময় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে এ মেলা আয়োজনের প্রস্তুতি নেওয়া হলেও তা করা যায়নি। পরের বছর বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে সূচনা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র।
২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অমর একুশে গ্রন্থমেলা নাম পরিবর্তন করে অমর একুশে বইমেলা নামকরণের কথা বলেন। পরে বাংলা একাডেমির নির্বাহী সভায় মেলার নামকরণ করা হয় অমর একুশে বইমেলা।
সেভাবেই বাংলা একাডেমি এবারও ১ ফেব্রুয়ারি থেকে বইমেলা শুরুর প্রস্তুতি নিয়েছে। গোল বেঁধেছে আমন্ত্রণপত্র ছাপানোর পর।
বইমেলার আমন্ত্রণপত্রে আগে কখনও মন্ত্রণালয়ের নাম ও লগো ব্যবহার করা না হলেও এবার আমন্ত্রণপত্র এবং মূল অনুষ্ঠান মঞ্চের ব্যানারে তা যুক্ত করতে বাংলা একাডেমির কর্মকর্তাদের মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুর। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
সোমবার বইমেলার কাজের অগ্রগতি পরিদর্শন করতে বাংলা একাডেমিতে গিয়েছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ ও সচিব আবুল মনসুর।
তখন তিনি আমন্ত্রণপত্রে আয়োজক হিসেবে শুধু বাংলা একাডেমির লোগো কেন, সে প্রশ্ন করেন বলে উপস্থিত বাংলা একাডেমির কর্মকর্তারা জানান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলা একাডেমির কর্মকর্তারা তাকে (সচিব) বলেছিলেন, মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমি এবং মন্ত্রণালয় এই আয়োজনে সহযোগিতা করছে। তখন সচিব ক্ষেপে গিয়ে বাংলা একাডেমির কর্মকর্তাদের ধমক দেন এবং নতুন করে আমন্ত্রণপত্র ছাপাতে বলেন।”
বাংলা একাডেমির কোনো কর্মকর্তা বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তারা বলছেন, ইতোমধ্যে সব আমন্ত্রণপত্র ও ব্যানার ছাপা হয়ে গেছে। কিন্তু সচিবের মৌখিক নির্দেশের কারণে এখন সমস্ত আমন্ত্রণপত্র ও ব্যানার বাতিল করতে হবে এবং নতুন করে তা ছাপতে হবে; যদিও মেলা শুরু হতে আর এক সপ্তাহও নেই।
এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় লেখক কুলদা রায় ফেইসবুকে লিখেছেন, “হুমকির মুখে একুশে বইমেলা। বইমেলাটি ছিনতাই করে নিতে চাইছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। বাংলা একাডেমি বিধিবদ্ধ একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এখানে মন্ত্রণালয়ের কোনো খবরদারি বা হস্তক্ষেপ অতীতে হয়নি। এরশাদ সরকারও একাডেমির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কখনও হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু এখন হচ্ছে।
“কার্যত এই ধরনের হস্তক্ষেপ সচিব বা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় করতে পারে না বিধি মোতাবেক। শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলা একাডেমি আইন পাস হয়। এই আইন অনুযায়ী এই ধরণের হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণ অবৈধ।”
এই বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব আবুল মনসুর যুক্তি দেখিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলা একাডেমি তো মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত একটি প্রতিষ্ঠানই। বাংলা একাডেমি তো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের বাইরের কিছু না।”
আইন অনুযায়ী বাংলা একাডেমি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং এটি পর্ষদ দ্বারা পরিচালিত হয়।
সে নিয়ে প্রশ্নে সচিব আবুল মনসুর বলেন, “বাংলা একাডেমির বাজেট কোথা থেকে আসে? টাকা তো মন্ত্রণালয় থেকেই যায়। তাহলে মন্ত্রণালয়ের নাম দিতে এত সমস্যা কেন?
“এলোকেশন অব বিজনেস’ অনুযায়ী বাংলা একাডেমি আইনের রক্ষক তো মন্ত্রণালয়। তাহলে মন্ত্রণালয়ের সংস্থা বা দপ্তরের কার্যক্রম তো মন্ত্রণালয়ের অধীনেই।”
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর বাংলা ভাষার অস্তিত্ব রক্ষা ও বিকাশে বাংলা একাডেমির মতো গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়ে ওঠে। পাকিস্তানের যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এলে ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠা পায় বাংলা একাডেমি। দুই বছর পর এটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা পায়।
‘অমর একুশে বইমেলা ২০২৩’ এর নীতিমালায় উল্লেখ আছে, “বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে উদযাপনের অংশ হিসেবে ‘অমর একুশে বইমেলা ২০২৩’ অনুষ্ঠিত হবে এবং বাংলা একাডেমির নির্বাহী পরিষদ কর্তৃক গঠিত ‘অমর একুশে বইমেলা পরিচালনা কমিটি ২০২৩’ বইমেলা পরিচালনা করবে। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
মেলা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদার নেতৃত্বে এবার ৩১ সদস্যের কমিটি কাজ করছে। বাংলা একাডেমির পরিচালক (প্রশাসন, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও পরিকল্পনা বিভাগ) কে এম মুজাহিদুল ইসলাম সদস্য-সচিব হিসেবে আছেন।
এছাড়া সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, গবেষক মফিদুল হকসহ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ বিভিন্ন দপ্তরের প্রতিনিধিরা রয়েছেন পরিচালনা কমিটির সদস্য হিসেবে।
বইমেলার আমন্ত্রণপত্রে মন্ত্রণালয়ের লোগো ব্যবহার করা হয় কি না- জানতে চাইলে রামেন্দু মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অতীতে বইমেলার আমন্ত্রণপত্রে কখনোই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নাম বা লোগো ব্যবহার করা হয়নি। সব সময় আয়োজক হিসেবে বাংলা একাডেমির নাম এবং লোগো ব্যবহার হয়েছে।
“মন্ত্রণালয় যদি আমন্ত্রণপত্রে তাদের নাম-লোগো ব্যবহার করতে চায়, তখন বাংলা একাডেমি যে একটা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, সেটা আর মনে হবে না।”
এই পরিস্থিতিতে বইমেলার আয়োজক হিসেবে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নাম যুক্ত হচ্ছে কি না- জানতে চাইলে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কোনো পরিবর্তন আসছে না।
“সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তো আয়োজকই, মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় তো বইমেলা হয়। আগে যেভাবে ছিল, সেভাবেই সবকিছু হবে। বাংলা একাডেমিই সব দায়িত্ব পালন করবে। নতুন করে কিছু হচ্ছে না।”