১৯৬৩ সালের কথা। চট্টগ্রামের কয়েকজন যুবক সেদিনও বসেছেন আড্ডায়। তরুণ এই বন্ধুদের ভেতর একজন শাফাত আলী। তার মাথায় তখন ঘুরছে নানারকম গান নিয়ে কাজ করার চিন্তা। শুধু শাস্ত্রীয় সংগীত নয়, বাংলা গানে পপ, জ্যাজ, রক, ব্লুজ ইত্যাদি ধারা নিয়েও কাজ করতে চাইলেন তিনি।
এজন্য পরিবারের সদস্যদের নিয়েই গঠন করে ফেলেছেন পারিবারিক ব্যান্ড। তবে তখনও নাম ঠিক হয়নি। চট্টগ্রাম মেডিকেলে পড়া তার বন্ধু আহমেদ ফারুক পরামর্শ দিলেন ব্যান্ডের নাম হোক 'জিঙ্গা।'
তবে ব্যান্ড কথাটার সরাসরি ব্যবহার শাফাত করেননি। তিনি এটিকে শিল্পীগোষ্ঠী বলতেই আগ্রহী ছিলেন। জিঙ্গা শব্দটি স্প্যানিশ। এর মূল শব্দ 'জিঙ্গারো', যা দিয়ে মূলত জিপসিদের বোঝানো হয়। শাফাত আলীর নামটি পছন্দ হয়। জিপসিদের যেমন কোনো স্থায়ী ঠিকানা থাকেনা, বিচরণ থাকে গোটা দুনিয়াজুড়ে; তেমনি তিনিও চাইছিলেন বিশ্বের বিভিন্নরকম গানের জঁরা নিয়ে বাংলা ভাষায় কাজ করতে। এক্ষেত্রে প্রাথমিক অণুপ্রেরণা ছিলো সলিল চৌধুরীর গানগুলো।
১৯৬৬ তে তার বোন নাজমা জামানের কণ্ঠে 'তোমারি জীবনে এলো কি আজি বুঝি ' গানটি বিটিভিতে (তৎকালীন পিটিভি) প্রচারিত হলে চারদিকে সাড়া পড়ে যায়৷ শাফাত, নাজমা, শেহলা-এই তিন ভাই-বোনই মূলত জিঙ্গার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য৷ পরবর্তীতে শাফাত আলীর স্ত্রী নিঘাত আলীও এর সাথে যুক্ত হন।
জিঙ্গা সেসময়ই তাদের গানে গিটার, একোর্ডিয়ান, কিবোর্ড, ড্রাম ইত্যাদি ব্যবহার করতে শুরু করে। তাদের মাধ্যমে বাংলা গানে পপ, জ্যাজের দারুণ সূচনা হয়।
সত্তর দশকে জিঙ্গার সাথে যুক্ত ছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী কাদেরী কিবরিয়া (বর্তমানে প্রবাসী), লিনু বিল্লাহ। এছাড়া লাকী আখন্দ, ফোয়াদ নাসের বাবু, শেখ ইশতিয়াকের মতো শিল্পীরাও তাদের সাথে কাজ করেছেন।
সত্তর দশক থেকে জিঙ্গা মূলত তাদের পরিবারের সদস্যদের সমন্বয়েই দলটি এগিয়ে নেয়। এ সময় দূর আলাপনি দ্বারা হইলো নব পরিচয়, কে বলে ঐ যে চাঁদ, আজ কী রান্না করি, সাংবাদিক, জিঙ্গা শিল্পী গোষ্ঠী থিম সং- ইত্যাদি গান তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। এসময় বনি এম, বিগিস, আবার মতো দলের সাথে তাদের তুলনা হতো। ১৯৮০ সালে গণভবনে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় অতিথিদের সম্মানার্থে হওয়া এক অনুষ্ঠানে জিঙ্গা গান পরিবেশন করে। তাদের পরিবেশনা ভূয়সী প্রশংসা পায়।
নাজমা জামানের গায়কীর ভেতর ও শব্দ উচ্চারণে পাশ্চাত্য ধাঁচ ছিলো। উনি পেশায় ছিলেন উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের শিক্ষিকা। তবে গানের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য ধাঁচ থাকলেও উচ্চারণে কোনোরকম বিকৃতি ছিলো না তাদের গানে।
আশির দশকে জিঙ্গা বিভিন্ন ধরণের গান করে নিজেদের শক্ত উপস্থিতি জানান দেয়। ১৯৮২ সালে শাফাত আলীর কথা ও সুরে নাজমা জামান 'ঢাকা' গানটি করেন। ঢাকা শহরকে এত সুন্দরভাবে খুব কম গানই তুলে ধরেছে। সেই ঢাকা আজকের মতো এত জনবহুল, এত দূষণে ভারাক্রান্ত ছিলো না। জাদুর শহর বলে পরিচিত সেই ঢাকা জীবন্ত হয়ে উঠেছিলো জিঙ্গার গানে। নাজমা জামানের পারফরমেন্সের বৈশিষ্ট্য ছিলো তিনি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে গাইতেন না। গানের কথার সাথে সাথে হাত নাড়ানো, বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি, হালকা নাচ - ইত্যাদির মাধ্যমে তার পরিবেশনা হয়ে উঠতো শোনার ও দেখার।
জিঙ্গা এ সময়ে 'মিশ মাহদুম ' নামে আরবি গান করে। এছাড়া শিশুদের জন্য 'আলীবাবা' ও 'ব্যাটম্যান' নিয়েও গান করে। গানগুলোর সজ্জা ও পরিবেশনার ধরন ছিলো সে সময়ের হিসেবে অভিনব।
শাফাত আলী নিজেও এ সময়ে বিভিন্ন গান করেছেন। ১৯৮৩ সালে 'পাখি হয়ে এসেছিলে' গানটি করেন। চমৎকার মেলোডিয়াস এই গানটিতে ছিলো ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল মেলোডির প্রয়োগ। শাফাত আলীর একক গানগুলোর ভেতর এটিই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পায়।
উনি ১৯৮৬ সালে 'নামিবে বাদল' গানে ইলেকট্রিক গিটার ব্যবহার করেন। এছাড়া কথা ও সুরে গাওয়া 'আমার ছোট্ট ভাই' গানটিও বেশ জনপ্রিয় হয়। এটি তিনি করেছিলেন ছোটদের ফুটবল খেলায় আগ্রহ নিয়ে, ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপের সময়ে। এছাড়া স্ত্রী নিঘাত আলীর সাথে ডুয়েট গেয়েছিলেন, 'রূপালি ছোঁয়া লেগেছে' (আশির দশকে) ও 'সঞ্চিত রেখেছি এতদিন ধরে'। (সত্তর দশকে)
শেষোক্ত গানটি ছিলো 'ডোন্ট ক্রাই জনি' গানের সুর থেকে করা বাংলা ভার্সন।
এ সময়ের পপের বাইরে ওয়েস্টার্ন মেলোডিয়াস সুরেও বেশ মনোযোগী হতে দেখা যায় তাকে। নাজমা জামান ও শেহলা জামানের ডুয়েট 'পথিক আমি ফিরি একাকী' মেলোডিয়াস আধুনিক বাংলা গান, সাথে ছিলো রাবিন্দ্রিক ছোঁয়া। নিঘাত আলীর একক গান 'কী করি, ভেবে মরি'-র (১৯৯০) কথা ছিলো অনেকটা সলিল চৌধুরীর গানের মতো ছন্দময়, সুর ছিলো ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল ধাঁচের।
বিভিন্ন দেশে মিউজিক ভিডিও নিয়েও প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় জিঙ্গা। ১৯৯০ সালে লুক্সেমবার্গে বিভিন্ন দেশের ভেতরে হওয়া মিউজিক ভিডিও কনটেস্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে জিঙ্গা। 'তোমারি জীবনে এলো কি আজি ' গানটিই ড্রাম ও গিটারের সমন্বয়ে সে সময়ের ব্যান্ডগুলোর মতো রক ধাঁচে পরিবেশন করে জিঙ্গা। ভিডিও নির্মাণেও শাফাত আলী চমক দেখান। ভিডিওর ভেতর তিনি ক্লিপ মার্জ করে জিঙ্গার অতীত কিছু পরিবেশনার অংশবিশেষও জুড়ে দেন।
শাফাত আলী প্রচণ্ড সফল ছিলেন অডিও প্রযোজক হিসেবেও৷ তার রেকর্ডিং লেবেলের নাম ছিলো 'ইপসা।' এখান থেকে আশির দশকে লাকী আখন্দ, হ্যাপি আখন্দ, কুমার বিশ্বজিৎ - প্রমুখের রেকর্ড বেরিয়েছিলো। এছাড়া বিজ্ঞাপনচিত্রের জিঙ্গেল ও কণ্ঠদানের কাজও হতো ইপসায়-যা ছিলো তার কাকরাইলের বাসাতেই। ১৯৮৯ এ কাওসার আহমেদ চৌধুরীর কথা ও লাকী আখন্দের সুরে নাজমা জামানের 'চেয়েছি চলে যেতে' গানটি প্রযোজনা করে জিঙ্গা।
১৯৯০ সালের পর নাজমা জামান আমেরিকা প্রবাসী হলে জিংগা আগের তুলনায় গতি হারায়৷ এ সময়ে অন্য অনেক ব্যান্ড ও রেকর্ডিং লেবেল উঠে আসতে থাকে। জিঙ্গাকে '৯০ সালের পর আর আগের মতো পাওয়া যায়নি।
১৯৯৭ সালের ২০ জুন শাফাত আলী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে শেষ হয় জিঙ্গার সেই গৌরবময় পথচলার। তার দুই ছেলে, একমাত্র মেয়ে ও স্ত্রী- সবাই বর্তমানে আমেরিকাপ্রবাসী।
বড় ছেলে শায়ান আলী নিউইয়র্কে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে জিঙ্গাকে আবারো সচল করেছেন। তার শিশুকন্যাও এখন তাদের সাথে গাইছেন। 'জিঙ্গা গোষ্ঠী' নামে থাকা তাদের ইউটিউব চ্যানেলে গানগুলো তারা আপলোড করে থাকেন।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশীয় সংগীতে এতগুলো ব্যান্ডের অগ্রদূত যে জিঙ্গা- তাদের নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি কখনোই৷ ১৯৪২ সালের ৩ রা ডিসেম্বর জন্মেছিলেন শাফাত আলী- বেঁচে থাকলে আজ আশি বছর পূর্ণ হতো তার। বোন নাজমা জামান কবির বকুলকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে প্র আক্ষেপ নিয়ে বলেছিলেন, " আমার ভাইয়ের মৃত্যুর পর কোনো জায়গায় , কোনো অনুষ্ঠানে কেউ তাকে নিয়ে একটা কথাও বললেন না। এই দুঃখ আমার কোনোদিনই যাবেনা।''
শাফাত আলী স্বাধীনচেতা মানুষ ছিলেন। নিজের মতো কাজ করেছেন উদার মন নিয়ে। তিনি বিশ্বাস করতেন তাদের গানই জিঙ্গাকে বাঁচিয়ে রাখবে। সুরকার হিসেনে অনন্য শাফাত আলী চমৎকার একোর্ডিয়ান বাজাতেন। গানের মেলোডি ও রিদমের অসাধারণ সমন্বয় ঘটতো তার কম্পোজিশনে। সেসব কাজই তাকে ও জিঙ্গাকে পথিকৃতের মর্যাদা দিয়েছে। যেমন প্রত্যয় নিয়ে নিজের লেখা ও সুর করা এক গানে বলেছিলেন, “ আমার গানেরও সুর হারিয়ে যাবে না/ আমি চলে গেলে দূর, দূর, বহুদূর।''
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী।