কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে ছাত্রলীগ নেত্রীর ছাত্রী নির্যাতনের ঘটনায় ভুক্তভোগীর বক্তব্য শুনবে হল প্রশাসন।
এদিকে ভুক্তভোগী ওই ছাত্রীকে ক্যাম্পাসে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর শাহাদত হোসেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে শাহাদত হোসেন বলেন, “হল ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দুই তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। শনিবার সকালে তদন্ত কমিটি ভিকটিম ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে বিধিসম্মত সিদ্ধান্ত নেবেন কর্তৃপক্ষ।”
দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের অতিথি কক্ষে চার ঘণ্টা আটকে রেখে প্রথম বর্ষের এক ছাত্রীকে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে। গত ১২ ফ্রেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১১টা থেকে প্রায় ৩টা পর্যন্ত ওই কক্ষে আটকে রেখে শারীরিক নির্যাতন করা হয় বলে ভুক্তভোগী ছাত্রী অভিযোগ করেন।
অভিযোগে তিনি বলেন, র্যাগিংয়ের নামে ছাত্রলীগ নেত্রীরা তাকে ‘বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ’ করেন। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি ঘটনা কাউকে জানালে ‘জীবননাশের হুমকিও’ দেন তারা। রোববার রাতের ওই ঘটনার পর বিপর্যস্ত ওই ছাত্রী সকালে হল ছেড়ে বাসায় চলে যান। মঙ্গলবার তিনি প্রক্টর ও ছাত্র-উপদেষ্টা দপ্তর বরাবর লিখিত অভিযোগ করলে বিষয়টি জানাজানি হয়।
ভুক্তভোগী ছাত্রী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হল প্রশাসন আমার নিজের মুখ থেকে সরাসরি ঘটনা শোনার জন্য আমাকে ডেকেছে। আমি আমার পরিবারের লোকজনের সঙ্গে নিয়ে তাদের সাথে সঙ্গে দেখা করব।”
এদিকে এ পরিস্থিতিতে দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের গণরুমে অবস্থানকারী ছাত্রীরা আতঙ্কে হল ছেড়ে বেড়িয়ে গেছে বলে রুমানা জান্নাত নামে ইংরেজী প্রথম বর্ষের এক ছাত্রী জানান। বাকিদের সঙ্গে গণরুম ছেড়েছেন তিনিও।
এদিকে অভিযোগ তদন্তে হল কর্তৃপক্ষ চার সদস্যের ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পাঁচ সদস্যের পৃথকভাবে কমিটি গঠন করেছে। তদন্ত কমিটির যাতে প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারে সেজন্য উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মেনে অভিযোগের মুখে থাকা ছাত্রলীগ নেত্রী ও তার সহযোগীদের ক্যাম্পাসের বাইরে থাকার নির্দেশ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
নির্যাতনের বিবরণে ওই ছাত্রী লিখেছেন, “আমার বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী তাবাচ্ছুম নামের এক আপু আমাকে দেখা করতে ডাকেন। কিন্তু আমি অসুস্থ থাকায় যথাসময়ে তার রুমে যেতে পারিনি। এরপর থেকেই তারা আমার উপর চড়াও হতে থাকে এবং তাদের রুমে গেলে আমার সাথে খারাপ আচরণ করেন, ভয়ভীতি প্রদর্শন করতে থাকেন এবং হল থেকে ঘাড় ধরে বের করে দেওয়ার হুমকি দেন।
“তারা অভিযোগ করতে থাকেন, তাদের না জানিয়ে কেন হলে উঠেছি। অথচ আমি আবাসিক শিক্ষার্থী হিসেবে নয়, গেস্ট হিসেবে সাময়িক সময়ের জন্য উঠেছিলাম। এরপর রবিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) রাত ১১টায় অন্তরা আপুসহ তার সাথে থাকা ৭-৮ জন আমাকে গণরুমে নিয়ে গিয়ে এলোপাতাড়ি চড় থাপ্পড় মারতে থাকে।
“আমাকে কেন মারছেন বলতে গেলে তারা আমার মুখ চেপে ধরে থাকেন এবং সজোরে চোয়ালে থাপ্পড় মারেন। আমাকে বলতে থাকেন, ‘আমরা কী করতে পারি জানিস তুই? আমাদের সম্পর্কে তোর কোন আইডিয়া আছে’?”
ভুক্তভোগী ছাত্রী লিখেছেন, “আমি কান্না করে তাদের পা ধরে মাফ চাইতে গেলে তারা আমাকে পা দিয়ে লাথি মারেন। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন, গামছা দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে ধরে রাখেন। একটা ময়লা গ্লাস চেটে পরিষ্কার করিয়ে নেন। আমাকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করেন।
“আমাকে বলতে থাকেন, যাতে এই বিষয়টা কোনোভাবে বাইরে না যায়, আর যদি বলি তাহলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও ভাইরাল করে দেবে। ভিডিওগুলো তাদের সংরক্ষণে আছে। এসময় অন্তরা বলেন,‘যদি তুই প্রশাসনের কাছে কোনো প্রকার অভিযোগ দিস তাহলে মেরে কুত্তা দিয়ে খাওয়াব।’ এরপর আমাকে রাত সাড়ে ৩টায় ছেড়ে দেয়। এ কারণে পরের দিন প্রাণের ভয়ে আমি ক্যাম্পাস ছেড়ে গ্রামের বাড়ি পাবনাতে চলে যাই।”
যার বিরুদ্ধে নির্যাতনে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ, সেই সানজিদা চৌধুরী পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী। অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “আমি যদি তাকে এসব করে থাকি, তাহলে সে প্রমাণ করুক। এ বিষয়ে আমি আর কিছু বলতে চাই না।”
শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি নাসিম আহমেদ জয় বলেন, “ইবি ছাত্রলীগ নেত্রীর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে ওই নেত্রী আমাকে জানিয়েছে। তারপরও ইবি ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। অভিযোগের সত্যতা পেলে অবশ্যই সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তদন্ত কমিটি প্রধান আইন বিভাগের অধ্যাপক রেবা মন্তল বলেন, “তদন্ত চলছে…. তদন্ত শেষ হোক। তবে বিষয়টিকে স্পর্শকাতর বিবেচনায় খুব গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
দেশরত্ন শেখ হাসিনা হল কর্তৃপক্ষের তদন্ত কমিটির প্রধান ফলিত রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আহসানুল হক বলেন, “ঘটনাটি যেহেতু বিশ্ব বিদ্যালয়ের ভাবমূর্তির সঙ্গে জড়িত, সে কারণে নিবির পর্যবেক্ষণসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করেই তদন্ত করা হচ্ছে।”