২০০১ সালের কথা। বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেল একুশে টেলিভিশন তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। মিশুক মুনীর ও সায়মন ড্রিংয়ের প্রচেষ্টায় সংবাদপাঠ, টিভি রিপোর্ট ও টিভি নাটক নির্মাণে নতুন ধারা নিয়ে এসেছেন তারা। এর সাথে আরো যেসব নাম জড়িয়ে ছিল তার একটি প্রয়াত আহীর আলমের।
আহীর আলম- নামটি হয়তো এ প্রজন্মের অনেকের কাছেই অপরিচিত। তবে সম্প্রতি ইউটিউবের কল্যাণে ও আরএনএআর চ্যানেলের রাশেদুজ্জামান রাকিবের ‘প্রেত’ নাটকের রিভিউ আহীরের নামকে নতুনভাবে সামনে এনেছে। মুহম্মদ জাফর ইকবালের উপন্যাস থেকে চিত্রনাট্য করেছিলেন দেওয়ান শামসুর রকিব। এই নাটকটির নির্দেশনা দেন আহীর আলম৷
সে সময়ই একুশে টিভিতে প্রচারিত হয়ে নাটকটি তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ভৌতিক ধারাকে এভাবে এর আগে কেউ বাংলা নাটকে তুলে আনতে পারেননি। তার সাথে যুক্ত হয়েছিল আহীরের অসাধারণ ক্যামেরার কাজ। নাটকটির সিকোয়েন্সগুলো ছিল তুলনামূলক দ্রুত। একটি দৃশ্য থেকে আরেকটি দৃশ্যে যাওয়ার যে ধারাবাহিকতা, সেটি বেশ চমৎকারভাবে রক্ষা করেছিলেন তিনি। এছাড়া শট বিভাজনের কথা বলতে গেলে সেসব ছিল অত্যন্ত পরিমিতভাবে গৃহীত।
স্বল্পবাজেটেও হরর আবহ ফুটিয়ে তোলার জন্য লাইটের ব্যবহারে চমৎকারিত্ব দেখান তিনি। খলচরিত্রে অভিনয়কারী হুমায়ূন ফরীদি যখন প্রেত সাধনা করছেন, তখন লালচে লাইটের সেই ব্যবহার, কিংবা আহমেদ রুবেল যখন স্বপ্নে দেখেন একটি সাপ তাকে জড়িয়ে রয়েছে- সে জায়গায় নীলচে আলোর ব্যবহার যেন নীল দংশন কথাটিকেই মনে করিয়ে দেয়। এই নাটকে একটি পার্শ্বচরিত্রে অভিনয়ও করেন তিনি।
প্রেত নাটকটির পাশাপাশি সে সময়ে আরো কিছু নাটক নির্মাণ ও অনুষ্ঠান প্রযোজনা করেন তিনি। যেমন - দেবাশীষ বিশ্বাসের উপস্থাপনায় তুমুল জনপ্রিয় অনুষ্ঠান 'পথের প্যাঁচালী' প্রযোজনা করেছিলেন তিনি।
আনিসুল হকের রচনায় কমেডি নাটক 'বারোটা বাজার আগে' জনপ্রিয় হয়। এছাড়া তার রচনায় 'ফাল্গুনের রাতের আঁধারে' নাটকটিও পরিচালনা করেন আহীর আলম। এই নাটকটির কাহিনী আবর্তিত হয়েছে একজন প্রভাবশালী নেতার জমি দখলকে কেন্দ্র করে। আহীরের ক্যামেরা টেকনিক এটিকে অনেকটা সিনেম্যাটিক রূপ দিয়েছে। বাংলাভাষার বক্তব্যধর্মী নাটকগুলোর ভেতর উল্লেখযোগ্য একটি কাজ হয়ে থাকবে এটি।
এছাড়াও আহীর নাটক লিখেছেন ও প্রযোজনা করেছেন। মুহম্মদ জাফর ইকবালের 'হাতকাটা রবিন' অবলম্বনে করা ধারাবাহিক নাটক 'হাকারবিন' প্রযোজনা করেন তিনি। এছাড়াও ভ্রমণ বিষয়ক একটি অনুষ্ঠান (যেটির উপস্থাপনায় ছিলেন মৌটুসী বিশ্বাস) প্রযোজনা করেছেন। আফজাল হোসেনের পরিচালিত নাটক 'মন ময়ূরী' লিখেছিলেন তিনি। এটিও সে সময় বেশ আলোচিত হয়। মূল দুটি চরিত্রে ছিলেন আফজাল হোসেন ও শমী কায়সার।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড নিয়েও একটি তথ্যচিত্র করতে চেয়েছিলেন। এজন্য সায়মন জাকারিয়া, নাসিরউদ্দীন ইউসুফ-প্রমুখের সাথেও আলোচনা করেছিলেন। কিন্তু তার আকস্মিক প্রয়াণ সেটি আর হতে দেয়নি।
একুশ বছর আগে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন আহীর আলম। সেটা ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের কথা। একুশে টিভিতে প্রচারিতব্য 'নকশিপাড়ের মানুষেরা' ধারাবাহিক নাটকের লোকেশন দেখার জন্য গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ি থানায় আরো কয়েকজনসহ গিয়েছিলেন তিনি।
একটি গাড়িতে তার সাথে ছিলেন সায়মন জাকারিয়া ও মনির নামে একজন সহকারী পরিচালক। আরেকটি গাড়িতে সেলিম আল দীন ও নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। তখন বেশ রাত হয়ে এসেছে। রাস্তা ছিল খানা-খন্দে ভরপুর। গাড়িটিকে একটি নিয়ন্ত্রণহীন ট্রাক ধাক্কা দেয়। দুর্ঘটনায় আহীর আলম ঘটনাস্থলেই মারা যান।
অভিনয়শিল্পী সাবেরী আলম তার বড় বোন। সাবেরী তখন চট্টগ্রামে ছিলেন। তিনি দুর্ঘটনার কথা জেনে সে রাতেই ঢাকা রওনা করেন। পরদিন সকালে তিনি ঢাকা পৌঁছান। আহীর আলমের লাশ দেখতে পান সেদিন দুপুরে।
আহীর আলমের মৃত্যুর সময় প্রেত নাটকের সম্প্রচার চলছিল। তার মৃত্যুর পর একসপ্তাহ সম্প্রচার বন্ধ ছিল। এছাড়া আরেকটি ভৌতিক নাটক পরিচালনার পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। শিমুল শরীফের রচনায় সেটি পরে পরিচালনা করেন এহসান আহমেদ।
সাবেরী আলম গণমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমি বিয়ের পর কাজ থেকে দূরে ছিলাম। আহীর আমাকে অভিনয়ে ফিরতে উৎসাহিত করতো। কিন্তু যখন আবার ফিরলাম, ততদিনে ও আর নেই। বর্তমানে যারা কাজ করছেন তারাও অনেকে ওর কথা বলেন, ওর কাজ থেকে অণুপ্রাণিত হয়েছেন তরুণ পরিচালকদের অনেকেই। তারা অনেকে (যেমন- মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী) আমাকে আহীরের বোন হিসেবে চিনতেন। ভাইয়ের পরিচয়ে পরিচিত হতে আমার ভালো লাগতো।''
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত।