বিশ্বকাপ এলেই বাংলাদেশে লাতিন ফুটবলের প্রতি ভালোবাসার জোয়ার দেখা যায়। আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল - লাতিনের এই দুই পরাশক্তির পাশাপাশি চিলি, উরুগুয়ের মতো লাতিন দলগুলোর জন্যেও বাংলাদেশি সমর্থকদের মনে রয়েছে ভালোবাসা।
তবে নিয়মিত লাতিন ফুটবলের ভক্ত হলে একটি বিষয় অবশ্যই চোখে পড়ার কথা - গায়ের রঙ। ব্রাজিল, চিলি, বলিভিয়া কিংবা ভেনেজুয়েলার মতো লাতিন দেশগুলোয় শ্বেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলারের মিশ্রণ থাকলেও, আর্জেন্টিনা দলের কারো গায়ের রঙই কালো নয়। আর্জেন্টিনা কি কেবলই সাদাদের দেশ? কিন্তু কেন? তার পেছনে রয়েছে শোষণ আর বৈষম্যের এক করুণ ইতিহাস।
কৃষ্ণাঙ্গ আর মিশ্র বর্ণের মানুষের যে সংমিশ্রণ লাতিন দেশগুলোয় দেখা যায়, তা মূলত আফ্রিকান দাসদের কল্যাণে। অপরাপর লাতিন দেশগুলোর মতো আর্জেন্টিনাতেও একসময় আফ্রিকান দাসেরা বসবাস করেছে, প্রজন্মান্তরে তাদের সংখ্যাবৃদ্ধি হয়েছে। তারপর হঠাৎ করেই যেন দেশটির রঙ বদলে যায়, ঠিক যেভাবে একটি বাড়ির রঙ বদলায়।
শুরু থেকে শুরু করা যাক। লাতিনের দেশগুলোয় দাসবাণিজ্য শুরু হয় মধ্যযুগে, নির্দিষ্ট করে বললে ষোড়শ শতকের শেষভাগে। সেসময় ইউরোপীয় বণিকেরা পৃথিবীর নানা প্রান্তে আফ্রিকান দাস কেনাবেচা করতো। এই বাণিজ্যের কল্যাণেই রিও দ্য লা প্লাতায় – আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স এইরেস আর উরুগুয়ের রাজধানী মন্টেভিডিওর মাঝে অবস্থিত একটি দ্বীপ – প্রথমবারের মতো আফ্রিকান দাস নিয়ে আসে ইউরোপীয়রা।
কয়েক দশকের মাঝেই আর্জেন্টিনার কর্দোবা লাতিন অঞ্চলের দাস বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়। কঙ্গো, রুয়ান্ডা, মোজাম্বিক, এঙ্গোলা সহ বিভিন্ন আফ্রিকান দেশ থেকে এখানেই দাসদের চালান আসতো যাদেরকে স্থানীয় বণিকরা কিনে নিয়ে লাতিনের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রয় করতো। ১৭ এবং ১৮ শতকজুড়ে এই সংখ্যা কেবল বেড়েই চলে এবং কৃষিকাজের সূত্রে আর্জেন্টিনার প্রায় সকল প্রদেশেই মিশ্রবর্ণের দাসেরা ছড়িয়ে পরে।
১৭ শতকের শুরুতে আর্জেন্টিনায় কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৪০% শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়। এদিকে ১৮১০-১৬ পর্যন্ত চলা স্পেনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে আনুপাতিক হারে সবচেয়ে প্রাণ দেয় আর্জেন্টিনার এই কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীই। যদিও যুদ্ধের মাঝেই দাসবাণিজ্য নিষিদ্ধ করে আর্জেন্টিনা, কিন্তু ব্রিটিশ উপনিবেশিকরা এই প্রথা চালিয়ে যায় আরো বহুদিন। ১৮৫০ এর পরেও দাসব্যবসার অস্তিত্ব ছিল আর্জেন্টিনায়।
আর্জেন্টিনায় কৃষ্ণাঙ্গ নিধনের প্রথম ধাপ বলা হয়ে থাকে ১৮৭০’এর দশকের প্যারাগুয়ে যুদ্ধকে। এই যুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গদের বাধ্যতামূলক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করানো হয়। সামান্য প্রশিক্ষণ কিংবা অনেক ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ ছাড়াই যুদ্ধে অংশ নিয়ে এই কৃষ্ণাঙ্গরা নিজেদের বর্ণের দাম দিয়েছিল জীবনের বিনিময়ে।
আর্জেন্টিনার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ডমিঙ্গো ফস্তিনো সারমিয়েন্তো ছিলেন চরম কৃষ্ণাঙ্গ বিদ্বেষী। তিনি প্রকাশ্যে কৃষ্ণাঙ্গদের ‘পরজীবী’ বলে আখ্যা দিতেন। শুধু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করিয়ে হাজারো কৃষ্ণাঙ্গকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিয়েই ক্ষান্ত হননি এই বর্ণবাদী প্রেসিডেন্ট, তিনি আফ্রো-আর্জেন্টাইনদের (আফ্রিকা থেকে আসা যে আর্জেন্টাইনরা সেদেশে বসবাস করছিল কয়েক শতাব্দী ধরে) আইন করে বসবাসের অনুপযোগী গহীন জঙ্গলে বসতি গড়তে বাধ্য করেন।
এর ফলে কয়েক দশকের মধ্যেই পীতজ্বর আর কলেরায় ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। আর এসবের সাথে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর অত্যাচার এবং কারণে অকারণে কৃষ্ণাঙ্গদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর তো ছিলই।
মূলত ১৮৫০-১৯০০ সাল সময়টুকু জাতিগত নিধনের একটি কালো অধ্যায় হিসেবে ইতিহাসে ঠাই পেয়েছে। ২০ শতকের শুরুতেই আর্জেন্টিনায় কালো মানুষের সংখ্যা অনেক কমে যায়। তখন আবার জাতীয় আইন করে ইউরোপ ও অন্যান্য দেশের সাদা চামড়ার মানুষকে স্বাগত জানানো হয় আর্জেন্টিনার নাগরিকত্ব প্রদান করার জন্য।
২০ শতকজুড়েই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বর্ণবাদ বিরোধী লড়াই হয়েছে, মার্টিন লুথার কিং কিংবা নেলসন মেন্ডেলারা যখন বিশ্বজুড়ে বর্ণবাদ বিরোধী শ্লোগান ছড়িয়ে দিচ্ছেন, তখনো আর্জেন্টিনায় কালো রঙের প্রতি ঘৃণা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অব্যহত ছিল। গত শতাব্দীর ৯০’র দশকে আর্জেন্টাইন রাষ্ট্রপতি কার্লোস মেনেম তো গর্ব করেই বলেছিলেন - “আর্জেন্টিনায় কোনো কালোমানুষ নেই। ওটা কেবল ব্রাজিলেরই সমস্যা!”
১৭ শতকের শুরুতে আর্জেন্টিনার মোট জনসংখ্যার ৪০% কৃষ্ণাঙ্গরা এখন সংখ্যায় ৫% এরও কম। এই সংখ্যাটাও মূলত মিশ্র বর্ণেই। শ্যামল বর্ণ, এমনকি উজ্জ্বল শ্যামল বর্ণ হলেও আর্জেন্টিনায় সেসব মানুষ হুট করেই ‘নিগ্রো’ হিসেবে তাচ্ছিল্যের স্বীকার হন এখনো। এভাবেই সময়ের সাথে একটি দেশের রঙ বদলে যায় শোষণ আর বৈষম্যের মধ্য দিয়ে।
চে গেভারার মতো মুক্তিকামীর দেশ আর্জেন্টিনা, ম্যারাডোনা আর মেসির মতো ফুটবল জাদুকরের দেশ আর্জেন্টিনা, ট্যাঙ্গো নৃত্যের দেশ আর্জেন্টিনা, সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ইতিহাসের দেশ আর্জেন্টিনা, সাথে বর্ণবৈষম্যের অন্ধকার ইতিহাসের দেশও আর্জেন্টিনা। প্রদীপের নীচে অন্ধকারের মতোই যেন আর্জেন্টিনার বর্ণবৈষম্য।
“আমরা সবাই সাদা আমাদের এই সাদার রাজত্বে” - স্কুলে এরকম কোরাসও হয়তো গেয়ে থাকে আর্জেন্টাইন শিশুরা, কিন্তু প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই বর্ণবিদ্বেষ ধরে রেখে আধুনিক সমতাকামী বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে পারবে কি দেশটি? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা বোধহয় জরুরি হয়ে পড়েছে।