১৯৭৩ সালের ৭ ডিসেম্বর মুক্তি পেয়েছিল আমজাদ হোসেনের কাহিনী ও খান আতাউর রহমানের পরিচালনায় চলচ্চিত্র 'আবার তোরা মানুষ হ'।
এর আগে কোনো চলচ্চিত্র এমন নাম দেখেনি। তুই সূচক শব্দ দিয়ে খান আতা মুক্তিযোদ্ধাদের ইঙ্গিত করেছেন এমন অভিযোগ উঠেছিল তখন। তবে সিনেমাটি সে সময় বেশ জনপ্রিয়তা পায়৷
এখানে খান আতা ছাড়াও ববিতা, সরকার ফিরোজ, চিত্রনায়ক ফারুক, রাইসুল ইসলাম আসাদ, আল মনসুর, বাবু, সুলতানা, রওশন জামিলসহ খ্যাতিমান অভিনয়শিল্পীরা অভিনয় করেন।
ফারুক, আসাদ, আল মনসুর নিজেরাও ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তবে খান আতা এই চলচ্চিত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের মানুষ হতে বলে অপমান করেছেন এমন দাবি বিভিন্ন সময় উঠেছে।
এ প্রসঙ্গে তারেক মাসুদের মূল্যায়ন ছিলো এমন (সচলায়তন ব্লগে প্রাপ্ত):
''১৯৭২-৭৩ সালে আসলেই কিছুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা আদর্শচ্যুত হয়েছিল। তারা যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা বটে, তবে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ৯ মাসের অস্ত্রের স্বাদ পাওয়ায় তারা শুধু অস্ত্রের ভাষায়ই কথা বলতে শিখেছিল। এর মানে কিন্তু এই নয়, তারা সবাই ‘পশু’ হয়ে গিয়েছিল। তাদের ভালোবাসার পাত্রীকেও অস্ত্রের ভাষায় প্রেম নিবেদেন করেছিল।”
“যুদ্ধ একটি ভাষা তৈরি করে দেয়। আর সেই ভাষাটি হলো অস্ত্রের ভাষা। এই জিনিসটি আমরা দেখেছি ১৯৭২-৭৩ সালে। এই ছবিটি সৃজনশীল ছবি হিসেবে না হোক, ওই সময়ের হিস্ট্রিক্যাল ডকুমেন্টেশন অব মাইন্ড, নট অনলি সেপস। সময়ের এবং মেন্টাল সেপস বা মেন্টাল যে টাইমটা ছিল, তা ওই জিনিসটাকে প্রতিনিধিত্ব করে। ব্যাপারটা আসলে তখনই জটিল হয়ে পড়ে, যখন যিনি নির্মাণ করলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর অবস্থানটা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল কি না। যখন দেখা যায়, তাঁর অবস্থানটাই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে বিভিন্নভাবে, তখন কিন্তু মানুষ সেটাকে প্রশ্ন করে এবং সেই হিসেবে কিন্তু ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ছবিটি বিতর্কিত হয়েছিল এবং এর সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল।''
মূলত খান আতার মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের কিছু কর্মকান্ড নিয়ে বিতর্কের প্রেক্ষিতে ছবিটির উদ্দেশ্য নিয়ে নাসিরউদ্দীন ইউসুফ, সৈয়দ হাসান ইমামসহ কেউ কেউ বিভিন্নসময় প্রশ্ন তুলেছেন।
আবার, সিনেমাটি কোনো কোনো সমালোচক থেকে অর্জন করেছে প্রশংসা। যেমন- ড. নাদির জুনাইদ তার 'প্রতিবাদের নান্দনিকতা: বাংলাদেশের প্রথাবিরোধী চলচ্চিত্র' বইয়ে ও সচলায়তন ব্লগে প্রকাশিত এক লেখায় সে সময়ের সামাজিক সমস্যাবলির বিস্তারিত উল্লেখ ও বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিকদের (যেমন- কাজী নূর-উজ জামান, আবদুল কাইয়ুম খান, মইনুল হোসেন চৌধুরী বিরবিক্রম ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়) লেখনীর সাপেক্ষে চলচ্চিত্রটির প্রাসঙ্গিকতা ও বক্তব্যধর্মীতার প্রশংসা করেন।
তার মতে, “প্রচলিত কাঠামোর মাধ্যমে কাহিনী এগিয়ে নেয়া হলেও সাম্প্রতিক বাস্তবতায় বিভিন্ন সমস্যা সরাসরি তুলে ধরা এবং কঠোর সামাজিক সমালোচনা প্রদানের কারণে ছবিটিকে অগতানুগতিক, সাহসী এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি চলচ্চিত্র হিসেবেই বিবেচনা করা যায়।”
সিনেমার একটি দৃশ্য। ছবি: সচলায়তন ব্লগ
এক্ষেত্রে চলচ্চিত্রটি কি নিছক প্রোপাগান্ডা নাকি এর সামাজিক সত্যতা আছে তা কিছু উদাহরনের সাহায্যে আমরা দেখতে পারি। যেমন- সেক্টর কমান্ডার কাজী নূর-উজ জামানের নির্বাচিত রচনা (২০১৪) গ্রন্থ থেকে জানা যায়,
দালালেরা নিজ নিজ এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি হওয়ায় ও যুদ্ধোত্তর দেশে প্রশাসনিক কাঠামোর বদল না ঘটায় তারা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি প্রতিহিংসা পরায়ণ কার্যক্রম চালু রাখেন।
মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শেষ দিকে সুবিধাবাদি একটি অংশের প্রকাশ ঘটে- যাদের নাম ছিলো সিক্সটিন ডিভিশন। পার্থ চট্টোপাধ্যায় তার 'ডেটলাইন ঢাকা' (২০১৫) বইতে লিখেছেন, “বাংলাদেশে একটি কথা তখনই বেশ চালু হয়ে গিয়েছিল, ষোড়শ ডিভিশন। ১৬ ডিসেম্বরের পরে যারা রাতারাতি মুক্তিবাহিনী সেজে যায়, হাতে রাইফেল নিয়ে, মাথায় হেলমেট পরে হাইজ্যাক করা গাড়িতে চড়ে শহর কাঁপাতে কাঁপাতে এরা সাধারণ মানুষের মনে ত্রাসের সৃষ্টি করে।”
আবদুল কাইয়ুম খান তার 'বিটারসুইট ভিকটরি: আ ফ্রিডম ফাইটার'স টেল' বইয়ে লিখেছেন জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী বাতিল হওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের এক মাসের বেতন নিয়ে চলে যেতে বলা ও সদ্য স্বাধীন দেশে পূর্বতন প্রশাসনিক কাঠামো বিদ্যমান থাকায় তাদের অসহায়ত্ব নিয়ে৷
এম.আর আখতার মুকুল এ নিয়ে 'আমি বিজয় দেখেছি' বইয়ে লিখেছেন, “বিশ্বে এমন দৃষ্টান্ত দেখা যায় না যে, একটি দীর্ঘ, রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন দেশে পুরনো শাসনের প্রতি অনুগত আমলা আর সামরিক অফিসারদের সম্মানের সাথে চাকরিতে টিকিয়ে রাখা হয়েছে আর দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের দূরে সরে যেতে হয়েছে।”
কাজেই এটা বোঝা যায় যে, সদ্য স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের আশাহত হবার মতো কারণ ছিলো। তবে সেসব কারণকে কেউ কেউ যে অতিরঞ্জিত করে তোলেননি এমন নয়। যেমন - বাসন্তীর জাল পরা যে ছবি সে সময় আলোড়ন তোলে, তা পরে সাজানো প্রমাণিত হয়।
তবে এই ছবিতে এমন বিষয় এসেছে যা উপরে উল্লেখিত বইগুলোর ঘটনাগুলোকে সমর্থন করে। যেমন - সিনেমায় বঙ্গবাণী কলেজের সাত পড়ুয়া যারা প্রত্যেকে মুক্তিযোদ্ধা, তাদের সদ্যস্বাধীন দেশের জীবনগত সংকট তুলে ধরা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা সোনা, হীরা ও কাঞ্চন রেশনের দোকান, ওষুধের দোকান ও কেরোসিনের দোকানে গিয়ে দেখতে পায় পর্যাপ্ত চাল, ওষুধ থাকার পরও মুনাফালোভি ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে দ্বিগুণ দামে তা বিক্রি করছে। কেরোসিন পাচার করছে। মুক্তিযোদ্ধারা তখনো অস্ত্র জমা দেননি, তাই তারা রুখে দাঁড়ান।
মুক্তিযোদ্ধা মানিকের প্রেমিকা নীলার বাবা আফাজউদ্দীন চৌধুরী কিংবা কলেজের আদর্শবান প্রিন্সিপালের বখে যাওয়া ছেলে মিজান লুটেরাদের প্রতিনিধিত্ব করে। কাঞ্চন বা মানিক যেখানে পয়সার অভাবে নতুন কাপড় কিনতে পারেনা, সেখানে আফাজ চৌধুরীদের সম্পদ আরো বাড়তেই থাকে।
সিনেমার হল পোস্টার। ছবি: বিএমডিবি
মুক্তিযোদ্ধা সোনা বন্ধুদের বলে, 'ভালো কাকে বলে রে?..... কিন্তু আমার বাপ কী বলে জানিস? আমি চাল নিয়ে আসিনি কেন? আমি পারি না লক্ষ মণ চালের পাহাড় তৈরি করতে?'
মুক্তিযোদ্ধা চুনি ও পান্না এক টাকার একটা সিগারেট দুজন মিলে ভাগ করে কিনে খায়। অপরদিকে এক তরুণ দামি ফাইভ ফিফটি ফাইভ সিগারেট নেয় এক প্যাকেট। সে ছিলো সেই ষোড়শ ডিভিশন ধরনের যোদ্ধা৷ তার তখন অস্ত্র ও দামি গাড়ি দুই-ই আছে।
সে চলে যাবার প্রাক্কালে সিগারেট বিক্রেতার বলা, 'কী দ্যাখতাছেন, স্যার? দ্যাশ স্বাধীন হইছে তো ওগো জন্যেই। আপনি আর আমি তো মশা আর মাছি।'- সংলাপগুলো আবারো ইঙ্গিত করে বৈষম্যহীন, শোষণহীন দেশ বিনির্মাণ থেকে আমাদের দূরে সরে যাওয়াকে। এক্ষেত্রে আবদুল কাইয়ুম খান ও কাজী নূর-উজ জামানের সেই লেখাগুলো আবারো আমাদের সামনে সত্য হয়ে ধরা দেয়।
সদ্য স্বাধীন দেশে আমরা দেখি মুক্তিযোদ্ধা রতনের অস্ত্র জমা দিতে অনাগ্রহের কারণ। তার বন্ধু মুক্তিযোদ্ধা চুনি শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের বাসায় অপারেশন চালিয়েছিলো। সেই রাজাকারের ছেলে এখন সিক্সটিন ডিভিশন হয়েছে৷ চুনিকে মারার পরিকল্পনা করছে! তাই অস্ত্র জমা দিতে তাদের আশংকা হয় অনিরাপত্তার।
এখানে এসেছে পরীক্ষার হলে নকলসহ শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটির প্রসঙ্গও। মুক্তিযোদ্ধা সেই তরুণেরাও নকল করতে বাধ্য হয় ফল ঠিক রাখতে। এত আদর্শবান সেই প্রিন্সিপালও নকল ঠেকাতে পারেন না তার কলেজে।
নানাবিধ ঘাত প্রতিঘাতে একসময় কিছু কিছু অপকর্মে জড়াতে থাকা এই মুক্তিযোদ্ধারা শহিদ মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে বলছে-' শহিদ হয়ে তোরা ভালোই আছিস৷ আমরা বেঁচে থেকে নষ্ট হয়ে গেছি।'
শহিদ মিনারের সেই বিখ্যাত দৃশ্যে আসাদ, বাবু ও আল মনসুর। ছবি: সচলায়তন ব্লগ থেকে
এমন আরো অনেক ঘটনা ছবিতে এসেছে। যেমন- চোরাকারবারিদের অভিযোগ থানায় গৃহীত হলেও তাদের বিরুদ্ধে এই মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযোগ গৃহীত হয়না। বরং, চোরাকারবারিদের স্বার্থে এই মুক্তিযোদ্ধাদেরই গ্রেফতারের জন্য খোঁজা শুরু হয়।
এই সিনেমায় যা দেখানো হয়েছিলো সে সময়ে তা চাঞ্চল্য তৈরি করেছিলো। তবে সিনেমাটিতে একাধিক মুক্তিযোদ্ধার অভিনয়, এক নদী রক্ত পেরিয়ের মতো গান ও সমসাময়িক সংকট সিনেমাটিকে সমালোচক আনুকূল্য এনে দেয়। সিনেমাটি তিন শাখায় বাচসাস পুরস্কার পায়। পরের বছর নারায়ন ঘোষ মিতার 'আলোর মিছিল' সিনেমাটিও একই ধাঁচের থিমে ছিলো।
খান আতার এই সিনেমাটিকে সার্বিক বিচারে প্রোপাগান্ডা বলা যায়না। তার ৭১ এর ২৫ মার্চের পরের ভূমিকা প্রশ্নসাপেক্ষ, এ নিয়েও অতীতে মতভেদ হয়েছে। হাসান ইমাম ও ফারুক -আলাদা দুরকম মূল্যায়ন করেছেন। নাসিরউদ্দীন ইউসুফ সিনেমাটির নামকরণের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তবে ফারুক আনন্দ-আলো ম্যাগাজিনে ২০১৭ তে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন যে, ছবিটিতে মানুষ হতে বলা হয়েছে লুটেরা বা দুর্নীতিবাজদের। এখানে কোনো মুক্রিযোদ্ধা চরিত্রকে খারাপভাবে দেখানো হয়মি৷ তিনি আরো বলেন, ''১৯৭৩ সালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারই ক্ষমতায় ছিলো, তারাই সিনেমাটির ছাড়পত্র দিয়েছে।''
খান আতা এই সিনেমায় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি, বরং উপস্থিত সমস্যাগুলোকে প্রশ্ন করেছেন। হীরা,চুনি, পান্না, সোনা, মানিক, রতন, কাঞ্চন – এই সাতজনকে নিয়ে তার অভিনীত প্রিন্সিপাল চরিত্রটিও বলে- 'ওরা আমার বড় ভালো ছেলে । যে যাই বলুক, ওরা কোনো অন্যায় করেনা। ওরা নয় মাস যুদ্ধ করেছে। বাবা, মা, ভাই, বোন হারিয়েছে।' কাজেই এটি পরিষ্কার হয় যে, এখানে আর যাই হোক, মুক্তিযোদ্ধাদের গণহারে অমানুষ বা এমন কিছু প্রতিপন্ন করা হয়নি। বরং, তাদের প্রতি যথাবিহিত শ্রদ্ধা রেখে মানুষ হতে বলা হয়েছে আফাজউদ্দীন চৌধুরীর মতো চোরাকারবারি ও মিজানের মতো ভ্রান্ত পথে পা বাড়নো তরুণদের। তাই প্রোপাগান্ডা না বলে, এটিকে বরং একটি মানসম্পন্ন , সাহসী ও গুরুত্ববহ সিনেমা হিসেবেই দেখা যায়।
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী।