Loading...
The Financial Express

আন্ধারমানিক ঘুরে এসে


আন্ধারমানিক ঘুরে এসে

বান্দরবানে থানচি উপজেলার রোমাঞ্চকর রহস্যময় দর্শনীয় স্থানের মধ্যে অন্যতম আন্ধারমানিক তবে আন্ধারমানিক যাবার ভাগ্যের টিকেট সবার জোটেনা! কথিত আছে এখানে নাকি কারো শাসন চলে না তাই দর্শনীয় স্থানটির সৌন্দর্যের রহস্য এখনো অনেকের কাছেই অজানা 

রহস্যে ঘেরা দর্শনীয় স্থান আন্ধারমানিক ভ্রমণে এবার বেরিয়ে পরলাম থানচিতে আন্ধারমানিকের পথে বাংলাদেশের শেষ সীমান্ত নিরাপত্তা চৌকি বড়মদক বিজিবি ক্যাম্প (ভিওপি) পেরিয়ে যেতে হবে আন্ধারমানিক নিরাপত্তাজনতি কারণে বিজিবি ক্যাম্পের পর কাউকে ওই পথে যেতে দেয়া হয়না অনেকটা নিষিদ্ধ আন্ধারমানিক পর্যন্ত যাওয়া তবে কখনো কখনো পরিস্থিতি বিবোচনায় বিজিবির নিরাপত্তা বলয়ের সাথে ভ্রমণপিপাসুদের যেতে দেয়া হয় রহস্যময় দর্শনীয় স্থান আন্ধারমানিকে 

শুরু হলো আমাদের যাত্রা চোখ মেলতেই দেখি বাস থেমে আছে, আশেপাশের সহযাত্রীরা নেই ভোর হয়ে এসেছে আলিকদম চলে এলাম নাকি!

 জানলা দিয়ে এদিক-ওদিক তাকাই কোনো দোকানের নামের নিচের ঠিকানায় বর্তমান অবস্থান খুঁজতে থাকি অপরিচিত কোনো জায়গায় কোথায় রয়েছি তা জানার জন্য আদি অকৃত্রিম কৌশল বরাবরের মতো এবারও অব্যর্থ প্রমাণিত কিন্তু অবস্থান জেনে ব্যাপক হতাশ! ঢাকা থেকে রাত সাড়ে ৯টায় ছেড়ে আসা বাস এখনো চট্টগ্রামে! হবেই বা না কেন, ১৬ ডিসেম্বর (২০২২) শুক্রবার পড়ায় শুক্র-শনি এবং বড়দিনের (রবিবার) ছুটি মিলিয়ে ছুটি হয়ে যায় মোট দিন রুদ্ধশ্বাসে ছোটাছুটির মধ্যে এমন দিনের ছুটি যেন খাঁচা থেকে পাখির মুক্তি পাওয়ার মতো

বলতে গেলে, এরপর দুপুর অব্দি বাস চললো হামাগুড়ি দিয়ে এত বিরক্তির মধ্যেও মনে প্রশান্তির বাতাস বয়ে যায় বান্দরবান ঢুকতেই আঁকাবাঁকা সাপের মতো পথ দুধারে পাহাড়ের হাতছানি পথে অফরোডার (জিপ নামে প্রচলিত) গাড়ির চল বেশি, ভেতরে মানুষ আর ছাদে কাঠ, সবজি বা ফল যে পাহাড়ের জন্য এতো অধীর অপেক্ষা, তার যতো কাছে যাচ্ছি ততোই চিত্ত প্রফুল্ল হয়ে উঠে বাস এগিয়ে চলে

এদিকে আজকের মধ্যে পাড়ায় না পৌঁছালে আন্ধারমানিক যাওয়াও পিছিয়ে যাবে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ফিরতে পারবো না জন্য রাতে ট্রেক করে আমরা আজকে যেভাবেই হোক রেম্বক পাড়ায় পৌঁছাব সেভাবে মানসিক প্রস্তুতি নেন' মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল হাওয়া আর অজানা শিহরণ খেলে গেল পাহাড়ে অফরুটে দিনের ট্রেকিংই বিপদসঙ্কুল, সেখানে রাতে না জানি কী অপেক্ষা করছে!

সকালে পৌঁছানোর বাস শেষমেশ আলিকদম বাজারে ঢুকলো দুপুর আড়াইটায় ততক্ষণে সব কিছুতে দেরির সব সময়সীমা পার ইঞ্জিন লাগানো দুটি নৌকা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল ভ্রমণসঙ্গী মোট ১১ জন এবার তৈন খালে জার্নি বাই বোট দুধারে সবুজ পাহাড়, মাঝখানে বয়ে চলেছে খালের জলধারা খালে তেমন পানি নেই চরে বাদামের চাষ হচ্ছে জুমের কাজ শেষে পাড়ায় ফিরছে পাহাড়িরা যত সামনে এগোই পেছনে রেখে যাই নাগরিক কায়-ক্লেশ-কদর্যতা

পাহাড়ের নিজস্ব একটি গন্ধ রয়েছে জামপাতা হাতে কচলে নাকে শুঁকলে যেমন মনে হয় তেমনই সতেজ বাতাস প্রাণে এসে লাগে বুক ভরে শ্বাস নিই আহ! নিমেষেই সকল ক্লান্তি-গ্লানি-গরিমা উধাও হুট করে থেমে যায় ইঞ্জিনের ভটভট শব্দ নৌকা চরে বেধে গেছে লম্বা বাঁশ দিয়ে ঠেলে ঠেলে নৌকা নিয়ে আসা হয় মূল স্রোতে সব মিলে মিনিট পাঁচেকের মতো এই সময়টুকু মনে হয় স্বর্গীয় কেননা ইঞ্জিনের বিকট শব্দ এই পরিবেশে একদম বেমানান শব্দ বন্ধ হতেই শোনা যায় ঘরে ফেরা পাখিদের কলকাকলি দূরে কোথাও পাতাখসা শব্দ কলকল জলধ্বনি দুপাশের পাহাড়ি নিস্তব্ধতা আরও অপরূপ হয়ে উঠে

প্রায় ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে নৌকা এসে থামে তীর সংলগ্ন রেইছা ঝিরির গোড়ায় খাল ধরে আরও এগোলে দুছরি বাজার, এই পথে যাওয়া যায় ক্রিসতং-রুংরাং সাঁঝের চাদর টেনে সেদিনের মতো শুয়ে পড়লেন সুয্যি মামা তীর থেকেই উঠে গেছে ঝিরি প্রায় ঘণ্টা তিনেক হাঁটলে ঝিরি পেরিয়ে এরপর পাহাড়ি পথ পাহাড়ে সন্ধ্যা মানেই রাত নিশীথে দীর্ঘ এই পাথুরে পথ কীভাবে পাড়ি দেবো ভাবতে ভাবতেই হাঁটা শুরু

ঝিরি আসলে ঝরণার জলপ্রবাহ বা গতিপথ বান্দরবানের প্রায় সবগুলো ঝিরিই পাথুরে নুড়ি থেকে একেবারে বিশালাকৃতি পাথর এবড়ো-থেবড়োভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে ফাঁক গলে কলকল করে জল বয়ে যায় পানি কোথাও পা ডোবে তো কোথাও হাঁটু অব্দি শীতের রাতে প্রথমে পা ভেজাতে মন উসখুস করলেও খানিক বাদে অবশ হয়ে আসে তখন কীসের কী ঠান্ডা পানি! এছাড়া পাথরে গুঁতো খেয়ে পায়ের নখ ফাটা বা চামড়া ছিলে-ছড়ে যাওয়া তো ধর্তব্যেও আসে না!

ট্রেকিংয়ে প্রথম দিনটি বেশ কষ্টে যায় হঠাৎ করে চরম কষ্টকর চড়াই-উৎরাই হাঁটায় শরীর বিদ্রোহ করে বসে পরের দিন থেকে শরীর ধীরে ধীরে মানিয়ে নিতে শুরু করে দিনভর অসহ্য জ্যামে নাওয়া-খাওয়া ছাড়া শরীর এমনিতেই খুব ক্লান্ত, এর সঙ্গে যোগ হলো রাতের ট্রেক ঘণ্টাখানেক হেঁটেই মনে হলো সব দম শেষ যে যেখানে পারে শুয়ে-বসে পড়লো পাহাড়ে রাতের ট্রেকিং সব দিক দিয়েই যেমন বিপজ্জনক, তেমনি রোমাঞ্চকর কিন্তু প্রথম দিনেই এই রোমাঞ্চ নেওয়া যাচ্ছিল না!

এদিকে ঝিরি আর শেষ হয় না! অন্ধকার আরও জেঁকে বসে তাকালে পেছনে কিছু দেখা যায় না; মনে হয়, পথ মুছে গেছে সামনেও ঘুঁটঘুঁটে আঁধার এক ভৌতিক টানেল দিয়ে আলো হাতে হেঁটে চলেছে আঁধারের যাত্রীরা সবার সামনে গাইড হাঁক-ডাক দিয়ে সবাইকে নিয়ে চলতে হচ্ছে ছিলাম সারির পেছনের দিকে আলোর কোনো বালাই নেই তবুও দুয়েকটি ছবি তোলার চেষ্টায় পেছনে পড়ে গিয়েছি হঠাৎ সবাই দাঁড়িয়ে গেল কারও কোনো বিপদ হলো নাকি! পরিস্থিতি এমন, সবার আগে এই চিন্তাই মাথায় আসে নাহ, খবর ভালো, আজ রাতের মতো ঝিরিপথ শেষ এরপর পাহাড়ি পথ আহা, এই বুঝি কষ্ট দূর হলো!

পাহাড় চড়তে গিয়ে বিধিবাম সঠান খাড়া পাহাড় দলের একজন একটি অ্যাপসে লগবুকের মতো ভ্রমণের সব তথ্য রাখছিল, যেটা অফলাইনেও কাজ করে পরে জেনেছিলাম, প্রায় ৭৪ ডিগ্রি খাড়া পাহাড় বেয়ে আমরা সেদিন উঠেছি পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পায়ের তলা থেকে মাথা অব্দি ঘেমে উঠলো প্রতি পদে পদে হাঁটু বুকে এসে ঠেকে গলা শুকিয়ে কাঠ রুকস্যাকের সাইড থেকে বোতল বের করে গলা ভেজানোরও উপায় নেই 

পা ফসকালেই সোজা গড়িয়ে গিরিখাদে এদিকে পা চলছে না, একটু দাঁড়িয়ে যে থাকবো এরও উপায় নেই কারণ খাড়া পাহাড় একটানে উঠে গেলে ভালো দাঁড়ালে মাথা ঘুরতে থাকে উল্টে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি সামান্য সমতল জায়গায় মিলতেই পিঠের ব্যাগসহ শুয়ে পড়লো সবাই যার কাছে যা শুকনো খাবার রয়েছে সবাই গোগ্রাসে গিলছে পা লম্বা করে টান টান হয়ে শুয়ে পড়ি পৃথিবীর আর কিছু সত্য বলে মনে হয় না!

এরপর কতবার যে পাহাড়ে চড়লাম-নামলাম-উঠলাম এর ঠিক নেই আকাশ ভরা তারা আর তার গা বেয়ে পাহাড়ের সারি এমনিতে পা চলে না আবার হাঁটতে গেলে লতায় আটকে যায় হাঁটার কারণে শরীর গরম থাকে কিন্তু নাকে-কানে ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা ঠিকই জানান দেয় শীতের তীব্রতা কখন পৌঁছাবো? কতদূরে রেম্বক পাড়া? এই প্রশ্ন গাইডকে বোধ হয় করা হয়ে গেছে শতবার অল্পভাষী গাইড প্রতিবারই উত্তর দেন, আর আধঘণ্টা ঘড়ি ধরে ঘণ্টা হাঁটার পরও এই আধা ঘণ্টা শেষ হয় না! পথিমধ্যে কয়েকটি পাড়া পড়ে মুহূর্তে মন খুশিতে নেচে উঠলেও আবার মিইয়ে যায় এর কোনোটিই আমাদের কাঙ্ক্ষিত পাড়া নয় যেতে হবে আরও বহুদূর

এমনিতেই পাহাড়িরা সকাল সকাল জাগে আবার সন্ধ্যার পর খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে আমরা যখন পাহাড়ে পৌঁছাই তখন রাত ১০টা পার সবাই ঘুমে কাদা গাইড পরিচিত একজনকে ডেকে তুললো তাকে সঙ্গে নিয়ে গেল থাকার ব্যবস্থা করতে আজ রাতে আর হাঁটতে হবে না এই খুশিতে আমরা আর ঘরের অপেক্ষা করলাম না যে যেখানে পেরেছে এলিয়ে পড়েছি শরীরও আর পারছিল না এর মধ্যে ঘর পাওয়া গেল হেলান দিয়ে বসা গাছের নিচ থেকে ঘর অব্দি পথটুকু মনে হলো বহুদূর বিশুদ্ধ পানি বাদই দিলাম, দূষিত পানিও যে কত মূল্যবান তা রকম দুর্গম পাহাড়ে এলে বোঝা যায় 

গামছা ভিজিয়ে কোনো রকম গা মুছে সটান শুয়ে পড়ি খেয়াল হয়, আমাদের তো রাতে খাওয়া হয়নি গাইডও বসে নেই এর মধ্যেই পাড়ার দু-একজনের সাহায্য নিয়ে রান্না চড়িয়ে দিয়েছে ধোঁয়া ওঠা জুম, আলু-চাল কুমড়ার তরকারি আর ডাল মনে হলো অমৃত এতোক্ষণ অদৃশ্য কোনো যাদুবলে যেন শরীর চলছিল পেটে দানাপানি পড়তেই গোটা ব্রহ্মাণ্ডের ঘুম যেন আমার চোখে

ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছি প্রায়, কানে এলো হোস্টের নির্দেশনা, আগামীকাল সকাল ৭টার মধ্যে খেয়ে-দেয়ে এই পাড়া থেকে রওনা না দিলে মাইকোয়া পাড়া পৌঁছাতে রাত ১২টা বাজবে আন্ধারমানিক মাইকোয়া পাড়া থেকে আরও অর্ধবেলা হাঁটার পথ। 

এবার সাঙ্গুর উজানপানে চলতে শুরু করল ইঞ্জিন নৌকাআবারও সেই চোখ জুড়িয়ে দেওয়া সবুজ, বিশাল পাহাড় মেলে ধরে আছে রহস্যময়তা, নীরব পাথরের গায়ে বাড়ি খেয়ে ফিরে আসা ইঞ্জিন নৌকার শব্দ। 

প্রায় দেড় ঘণ্টা পর মাঝি একটা টানেলের মতো জায়গায় নৌকা থামালেনইঞ্জিনের শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই জানালেন, ‘এহান থাইকা আন্ধারমানিকে যাওয়ার পথ শুরু।’

নীরবতা জেঁকে বসেছে যেনভরদুপুরে মনে হচ্ছিল আসন্ন সন্ধ্যানীরব প্রকৃতির ঘুম ভাঙাতে সময়ে সময়ে ঝিঁঝি পোকাদের আওয়াজ, নিয়ম মেনে নাম নাজানা পাখির কিচিরমিচির, তার সঙ্গে টানেলের মুখ থেকে ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসা অদ্ভুত শব্দসব শব্দ মিশে ভয়জাগানিয়া এক মুহূর্ত

শুরুতে গোড়ালি পর্যন্ত পানি ছিল, যতই সামনের দিকে এগোলাম, পানির পরিমাণ বাড়তে থাকলসামনের বাঁক পেরোতেই খুব সুন্দর একটা ঝরনার দেখা মিললসবার মুগ্ধতা দেখে গাইড জানালেন, রকম অসংখ্য ঝরনার দেখা মিলবে সামনেইঠিক তখনই লম্বা একটা সাপের সঙ্গে সাক্ষাৎএঁকেবেঁকে এগিয়ে যাচ্ছে আপনমনেসাপ দেখে অনেকের তো পা আটকে গেল

মাঝি তখন সৌন্দর্যের লোভ দেখালেনবললেন, সামনেই তো সেই মনমাতানো ঝরনাপ্রায় দশ মিনিট যাওয়ার পর সত্যিই সবার চোখজোড়া ছানাবড়া হওয়ার জোগাড়নাম নাজানা সেই পাহাড়ি ঝরনা বেণির মতো পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এসেছে

ঝিরির দুই পাশ প্রায় ৬০/৭০ ফুট পাথরের দেয়াল সমান্তরাল ভাবে অনেক দূর চলে গেছেমনে হল ঢালাই দিয়ে কেউ বানিয়ে রেখেছেএক অদ্ভুত সৃষ্টি এই আন্ধারমানিক। 

মো: সাজ্জাদ হোসেন বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত।

[email protected]

Share if you like

Filter By Topic