কখনো রাজমিস্ত্রীর, কখনো আবার রঙ বার্নিশের কখনোবা আবার টেক্সটাইল মিলসে কাজ করে উপার্জিত অর্থ দিয়ে তৈরি করেছেন ১৬টি পাঠাগার। জ্ঞান পিপাসুদের মাঝে জ্ঞানের আলো ভালোভাবে ছড়িয়ে দিতে নিজ উদ্যোগে এখনো পর্যন্ত ১৬টি পাঠাগার স্থাপন করেছেন জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ি উপজেলার বাসিন্দা শেখ মুহাম্মদ আতিফ আসাদ। তার এমন মহৎপ্রাণ উদ্যোগের কারণে মিলেছে এবার স্বীকৃতিও, তার প্রতিষ্ঠিত 'মিলন স্মৃতি পাঠাগার' পেয়েছে জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড -২০২২।
বইয়ের প্রতি ভালোলাগা
আতিফ আসাদ যখন মাজালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতেন তখন সেই বিদ্যালয় হতে প্রতি বৃহস্পতিবার গল্পের বই পড়তে দেয়া হতো। একটা বেঞ্চে তিনজন একসাথে বসতেন, সেখানে দেয়া হতো একটা মাত্র বই আর সেই বই তিনজনে মিলে পড়তেন তারা। বইয়ের প্রতি তার এতোটাই ভালোলাগা ছিলো যে, পড়ার জন্যে বিদ্যালয় হতে বই লুকিয়ে নিয়ে আসতেন। পরে অবশ্য তা আবার ফিরিয়েও দিয়েছেন। সেই থেকে শুরু বইয়ের প্রতি অগাদ ভালোবাসা।
মিলন স্মৃতি পাঠাগার
পাঠাগার স্থাপনে যিনি আতিফের প্রথম অনুপ্রেরণা ছিলেন, তিনি হচ্ছেন তার বড় ভাই মিলন। মাত্র ২০টি বই নিয়ে তখন বড় ভাইয়ের অনুপ্রেরণায় প্রতিষ্ঠা করেন পাঠাগার। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, পারিবারিক জমির বিরোধের কারণে নির্মমভাবে খুন হতে হয় তার ভাই মিলনকে। বড় ভাই মিলনের স্মৃতি হিসেবে তাই পাঠাগারের নামকরণ করা হয় 'মিলন স্মৃতি পাঠাগার'।
নিজ অর্থায়নে পাঠাগার প্রতিষ্ঠা
আসাদ যে গ্রামের বাসিন্দা সেখানকার মানুষ বসে থাকতে পছন্দ করেন না। পড়াশোনা যারা করেন, অনেক ছোটকাল থেকেই তারা কাযে যুক্ত হয়ে যান। আসাদও তার ব্যতিক্রম নন। প্রথম তিনি জেএসসি পরীক্ষার পরের সময়টায় কাজে যোগ দেন, এবং তখন তিনি বার্নিশের কাজ করেন। পরবর্তীতে তার যখন মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়, এরপরের সময়টায় তিনি করেছেন রাজমিস্ত্রীর কাজও। উচ্চমাধ্যমিকের পির করেছেন টেক্সটাইল মিলের কাজ, এরপর আবার রাজমিস্ত্রীর কাজ। এভাবেই তিনি তার পাঠাগার স্থাপনের মূল অর্থ জোগাড় করেন।
ইস্টিশন পাঠাগার স্থাপন
তার উদ্যোগে ইস্টিশন পাঠাগার তৈরি করা হয়। সরিষাবাড়ী স্টেশন, তারাকান্দি স্টেশন, এ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান স্টেশন, জামালপুর স্টেশন এবং ময়মনসিংহ স্টেশন। এখনো পর্যন্ত সর্বমোট তিনি এই পাঁচটি ইস্টিশন পাঠাগার স্থাপন করেছেন।
গ্রামে গ্রামে বই ফেরি
পড়াশোনার পাশাপাশি আসাদ মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সপ্তাহে ২/৩ দিন বই দিয়ে আসেন। ১০/১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করা মানুষরাও যদি তাকে কল করেন, তিনি সাইকেলে গিয়ে তাদেরদরজায়ও বই পৌঁছে দিয়ে আসেন। পাঠাগার শুরুর দিকে মানুষের মাঝে আগ্রহ বাড়াতে এই কাজ করতেন তিনি। এখন অবশ্য গ্রামে গ্রামে পাঠাগার তৈরি করায় তার এই কাজ তেমন করতে হয় না।
আগামীর স্বপ্ন
বর্তমানে তাদের ৩ টি থাকার রুমে ৪ টি বইয়ের তাক দিয়ে পাঠাগার চলছে। সেখানে বসে পড়ার মতো পর্যাপ্ত জায়গায় নেই এবং জরুরী ভিত্তিতে সেখানে একটা ঘর দরকার পাঠাগারের জন্য বলে জানান আসাদ, যেখানে বসে সবাই বই পড়তে পারবে এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও পাঠচক্র করতে পারবে।
যতগুলো গ্রামে তাদের পাঠক ছিটিয়ে আছে সব গ্রামেই ১ টি করে পাঠাগার স্থাপন এবং পাঠাগার আন্দোলনের যে ভীত সেটা সরিষাবাড়ির প্রত্যেক গ্রামে ছড়িয়ে দিতে চান আতিফ আসাদ। সারা বাংলাদেশের ১০০ টি রেলওয়ে স্টেশনে ইস্টিশন পাঠাগার স্থাপন করতে চান তিনি।
তিনি তার স্বপ্ন সম্পর্কে আরও জানান যে, নিজস্ব জমিতে পাঠাগারের একটা বড় ভবন হবে যেখানে বই পড়ার রুম, একটা অডিটোরিয়াম থাকবে। এখানে সবাই বই নিয়ে মেতে থাকবে। একটা ছোট হাসপাতাল থাকবে গরীবদের বিনামূল্যে চিকিৎসার জন্য, একটা বৃদ্ধাশ্রম থাকবে রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষের জন্য।
জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যওয়ার্ড অর্জন
জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যওয়ার্ড - ২০২২ অর্জন করেছে 'মিলন স্মৃতি পাঠাগার' যার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে এই স্বীকৃতি অর্জন আতিফ আসাদের। সম্মাননা পেয়ে কেমন লাগছে সে ব্যাপারে জানতে চাইলে আসাদ বলেন, "বাংলাদেশের তরুণদেরজন্য অন্যতম বড় প্ল্যাটফর্ম জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড পেয়ে অনেক আনন্দিত। এই পুরস্কার অর্জনের মধ্য দিয়ে পাঠাগারের কাজ করতে অনেক অনুপ্রােরনা পাচ্ছি। এরকম একটা প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে কাজ করে পুরস্কার পাওয়ায় আমার গ্রামের মানুষ জন্য আরো বেশি আনন্দিত।“
মাহমুদুল হাসান ফেনী সরকারি কলেজে হিসাববিজ্ঞান বিভাগে অধ্যয়নরত।