বাংলাদেশ পুলিশকে জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিশ্বমানের ‘স্মার্ট পুলিশ’ হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার জানিয়ে এ বাহিনীর সদস্যদের সেবার মাধ্যমে জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনে সচেষ্ট হতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেছেন, “বঙ্গবন্ধু সর্বদা এ দেশের পুলিশকে ‘জনগণের পুলিশ’ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অনুপ্রাণিত করতেন এবং আমি ধন্যবাদ জানাই আমাদের পুলিশ বাহিনী এখন জনগণের পুলিশ হিসেবেই তাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। আগে পুলিশের নাম শুনলে মানুষ ভয় পেত। এখন জানে পুলিশ সেবা দেয় ও তাদের পাশে দাঁড়ায়।”
বাসসের বরাত দিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানিয়েছে, মঙ্গলবার ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে ছয় দিনব্যাপী পুলিশ সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন সরকারপ্রধান।
তিনি বলেন, “আমাদের লক্ষ্য জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে একটি দক্ষ এবং বিশ্বমানের ‘স্মার্ট পুলিশ’ গড়ে তোলা।”
মহামারীর কারণে গত দুই বছর প্রধানমন্ত্রী পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে। এবার তিনি সরাসরি অংশ নিলেন অনুষ্ঠানে।
বাংলাদেশ পুলিশকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ বাহিনী তাদের সম্পর্কে জনগণের ভীতি দূর করে জনগণের সেবা করছে। তাদের এ ভালো কাজগুলো চালিয়ে যেতে হবে। পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থা অটুট রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিকল্পনা অনুযায়ী পুলিশ হবে জনগণের পুলিশ, শোষকের পুলিশ নয়।”
পুলিশ বাহিনীর উন্নয়নে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে বলেন, “আমাদের সরকার পুলিশ বাহিনীকে ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যানবাহন সরবরাহ করেছে। পুলিশের গতিশীলতা ত্রিমাত্রিক পর্যায়ে উন্নীতকরণে ইতোমধ্যে রাশিয়া থেকে দুটি হেলিকপ্টার ক্রয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পুলিশ বাহিনীর জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ এভিয়েশন ইউনিট গঠনের প্রক্রিয়া চলছে।”
প্রধানমন্ত্রী একটি খোলা জিপে করে পুলিশ সপ্তাহের কুচকাওয়াজ পরিদর্শন এবং সালাম গ্রহণ করেন। পরে তিনি ১১৭ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) এবং রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক (পিপিএম) দেন।
প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান এবং পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন তাকে স্বাগত জানান। মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, সংসদ সদস্য এবং ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “মানুষের তথা জনগণের আস্থা অর্জন করা যে কোনো বাহিনীর জন্যই গুরুত্বপূর্ণ এবং আপনারা তা করে যাচ্ছেন। অত্যন্ত মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেই আপনারা এই সেবা করে যাবেন। জনগণের মনে পুলিশের প্রতি যে আস্থা সৃষ্টি হয়েছে সেটা যেন অক্ষুণ্ন থাকে। আমরা চাই আমাদের পুলিশ বাহিনী জনবান্ধব পুলিশ বাহিনী হিসেবেই জাতির পিতার সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবে।”
প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বিপদ আপদে পুলিশ ‘সবসময় মানুষের পাশে আছে’ মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “পাশাপাশি মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগেও পুলিশের ভূমিকা রয়েছে। মানুষের জান-মাল বাঁচাবার জন্য নিজের জীবনকেও উৎসর্গ করেন। যে কোনো ঝুঁকি নিতে পিছপা না হওয়াটাই পুলিশের কাজ এবং সেটা তারা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গেই করে যাচ্ছেন।”
এজন্য পুলিশ বাহিনীকে তিনি ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানান এবং ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে বিএনপি-জামায়াতের ‘অগ্নিসন্ত্রাসের’ সময় পুলিশ সদস্যদের বলিষ্ঠ ভূমিকার প্রশংসা করেন।
তিনি বলেন, সে সময় প্রায় সাড়ে ৩ হাজার মানুষ অগ্নিদগ্ধ এবং ৫ শ মানুষ নিহত হয়েছিল। পুলিশ বাহিনীও রেহাই পায়নি। ২৯ জন পুলিশ সদস্যও নির্দয় নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেন এবং অনেকে আহত হন।
“খুব নির্দয়ভাবে পুলিশকে বিএনপি-জামাত-শিবিররা যেভাবে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করেছে, তা কোথাও দেখা যায় না। এদের হামলায় সাড়ে তিন হাজার বাস-ট্রাক, ১৯টি ট্রেন, ৯টা লঞ্চ পুড়ে ধ্বংস হয়। ৭০টি সরকারি অফিস ও স্থাপনা ভাঙচুর করে এবং ৬টি ভূমি অফিস সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দেয়।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “পুলিশের সদস্যগণ জীবন বাজি রেখে দায়িত্ব পালন করে তাদের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড রুখে দিয়েছিল এবং জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করে।”
এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে যেন আর না ঘটে, সে বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করেন শেখ হাসিনা। তিনি জঙ্গি প্রতিরোধে পুলিশ সদস্যদের ভূমিকার প্রশংসা করেন এবং হলিআর্টিজন বেকারির জঙ্গি হামলার ঘটনায় নিহত দুই পুলিশ সদস্যের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার দেশকে জঙ্গিবাদ থেকে রক্ষায় ‘সবরকম ব্যবস্থা’ নিয়েছে এবং পুলিশ বাহিনী জঙ্গি, সন্ত্রাস, মাদক, চোরাচালানি বা মানুষ পাচারের বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
“পাশাপাশি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনেও আমাদের পুলিশ বাহিনী বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। এজন্য পুলিশের, বিশেষ করে মহিলা কন্টিনজেন্ট আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও ভূয়সী প্রশংসা পাচ্ছে।”
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ পুলিশের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’ ব্যবহার করে এখন খুব সহজেই বিপদাপন্ন মানুষজনকে উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে। জনগণ ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স ও পুলিশের সেবা পাচ্ছে এই ‘৯৯৯’ ব্যবহার করে।
নারী, শিশু, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সেবাপ্রাপ্তি সহজ করতে প্রতিটি থানায় নারী-শিশু-বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ডেস্ক স্থাপন, নারীবান্ধব বিভিন্ন অ্যাপ চালু করা এবং অনলাইন জিডি কার্যক্রম ও অন্যান্য অনলাইনভিত্তিক সেবার মাধ্যমে পুলিশের সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়ার কথাও তিনি বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে ইতোমধ্যে পুলিশে এন্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ) এবং কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) গঠন করেছে সরকার। পুলিশের জন্য ডিএনএ ল্যাব, আধুনিক ফরেনসিক ল্যাব, অটোমেটেড ফিঙ্গার প্রিন্ট আইডেন্টিফিকেশন (এএফআইএস) এবং আধুনিক রাসায়নিক পরীক্ষাগার স্থাপন করা হয়েছে। ভবিষ্যতে প্রতিটি বিভাগীয় সদর দপ্তরে এ ধরনের ল্যাব স্থাপন করা হবে।
“সাইবার অপরাধ মোকাবেবলায় আমরা সিআইডিতে একটি ‘সাইবার পুলিশ সেন্টার স্থাপন’ করেছি। এছাড়া, ডিএমপির ‘সিটিটিসি’সহ পুলিশের অন্যান্য ইউনিটও সাইবার অপরাধ দমনে কাজ করছে। অচিরেই আমরা বাংলাদেশ পুলিশে একটি পূর্ণাঙ্গ সাইবার পুলিশ ইউনিট স্থাপন করব এবং জেলা পর্যায় পর্যন্ত এ ইউনিটের শাখা বিস্তৃত করা হবে।”