বছরের বেশিরভাগ সময় বায়ু দূষণে বিশ্বের শীর্ষ শহরগুলোর তালিকায় ঢাকা শীর্ষে থাকলেও গত সপ্তাহে তাতে দুই দিনের বিরতি মিলেছিল, ফলে স্বস্তিতে শ্বাস নিতে পেরেছে নগরবাসী। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
অক্টোবরের এই সময়টায় এমনিতে বাতাসে ধুলোর পরিমাণ বাড়তে থাকে, তাতে ঢাকার বাতাস হয়ে পড়ে অস্বাস্থ্যকর। কিন্তু গত সোম ও মঙ্গলবার ঢাকার বাতাসে দূষণ ছিল অনেকটা কম, যাকে ঋতুর বিবেচনায় ‘বিরল চিত্র’ বলছেন বায়ুমান পর্যবেক্ষকরা।
তারা বলছেন, অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুতে কয়েক দিনের ছুটি আর বৃষ্টি ঢাকার আশেপাশের এলাকায় বায়ুমানের উন্নতিতে ভূমিকা রেখেছে।
কিন্তু সামনে আসছে শীত, মানে ধুলার মৌসুম। শুষ্ক মৌসুমে বায়ু দূষণের মাত্রা বেড়ে যায় বলে বেড়ে যায় শ্বাসতন্ত্রের রোগ। সেই দুর্ভোগ কিছুটা কমাতে তদারক সংস্থাগুলোকে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ুন কবির।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “নভেম্বর থেকে ইটভাটাগুলোও পুরোপুরি চালু হবে। তখন বাতাসের ধূলিকণাও বাড়বে। সেজন্য নির্মাণকাজগুলোকে আইনের আওতায় আনতে হবে। নির্মাণ উপকরণ ঢেকে রাখতে হবে। অকেজো যানবাহন রাস্তায় চালানো যাবে না, ক্ষতিকর কালো ধোঁয়া নিঃসরণকারী যানবাহন যেন চলতে না পারে, সেজন্য আইনানুগ পদক্ষেপ নিতে হবে।
“রাস্তায় যে নির্মাণকাজগুলো চলছে, সেগুলো দ্রুত শেষ করে কার্পেটিং করে ফেলতে হবে। ঢাকার মেয়র এ সংক্রান্ত কাজগুলো করেছেন। এ কারণেও কিন্তু আমরা সুফল পাচ্ছি। ইটভাটাগুলোতেও সরকারের তদারকি থাকতে হবে। যেগুলো অবৈধ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এমন কিছু পদক্ষেপ নিলে সামনে শীতেও বায়ুমান ভালো রাখা সম্ভব। এতে মানুষের শ্বাসতন্ত্রের সমস্যাগুলো কম হবে। সবার জন্যই সেটা ভালো।”
দুদিনের ‘ম্যাজিক’
বাতাসের মান নির্ভর করে ভাসমান সূক্ষ্ম ধূলিকণার পরিমাণ (পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম-১০) এবং অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণার পরিমাণের (পিএম ২.৫) ওপর, যা পরিমাপ করা হয় প্রতি ঘনমিটারে মাইক্রোগ্রাম (পার্টস পার মিলিয়ন-পিপিএম) এককে।
পিএম ২.৫, পিএম ১০ ছাড়াও সালফার ডাই অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড ও গ্রাউন্ড লেভেল ওজোনে সৃষ্ট বায়ুদূষণ বিবেচনা করে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স বা একিউআই তৈরি হয়। একিউআই নম্বর যত বাড়তে থাকে, বায়ুমান তত ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচিত হয়।
একিউআই শূন্য থেকে ৫০ এর মধ্যে থাকলে সেই এলাকার বাতাসকে ভালো বলা যায়। ৫১-১০০ হলে বাতাসের মান মডারেট বা মোটামুটি গ্রহণযোগ্য ধরা হয়।
একিউআই ১০১-১৫০ হলে সেই বাতাস স্পর্শকাতর শ্রেণির মানুষের (শিশু, বৃদ্ধ, শ্বাসকষ্টের রোগী) জন্য অস্বাস্থ্যকর এবং ১৫১-২০০ হলে তা সবার জন্যই অস্বাস্থ্যকর বিবেচিত হয়। আর একিউআই ২০১-৩০০ হলে তা খুবই অস্বাস্থ্যকর এবং ৩০১ পেরিয়ে গেলে সেই বাতাসকে বিপদজনক ধরা হয়।
সুইস সংস্থা আইকিউ এয়ার নিয়মিত বিভিন্ন শহরের বায়ুমানের তথ্য তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। তাদের তথ্য বলছে, গত ১০ অক্টোবর ঢাকার বাতাসের একিউআই নেমে আসে ৩১ এ। পরদিন তা আরও কমে ২৫ হয়।ওই দুই দিনে টানা ৪২ ঘণ্টা ঢাকার বাতাসের মান ছিল ‘ভালো’।
এর আগে গত বছরের জুলাই মাসে ঢাকার বায়ুমানে অভূতপূর্ব উন্নতি দেখা গিয়েছিল। সেসময় বৃষ্টি, লকডাউন ও ঈদের ছুটি মিলিয়ে দুই ধাপে বেশ কয়েক দিন করে ভাল বায়ু পাওয়া গিয়েছিল।
ঢাকার বায়ুমানের জন্য সেই সময়কে ‘ম্যাজিক্যাল উইক’ হিসেবে বর্ণনা করে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, “২০১৬ থেকে ২০২১ ছয় বছরে আমরা ঢাকায় মাত্র ৩৮ দিন নির্মল বায়ু সেবন করেছি।
“গত সপ্তাহের দুই দিন আমরা যে বায়ু সেবন করেছি, সেটা ঢাকা শহরের মানুষের জন্য কাম্য হলেও খুবই দুষ্প্রাপ্য।”
কীভাবে সম্ভব হল?
বছর জুড়ে বায়ু দূষণের সঙ্গে লড়ে যাওয়া ঢাকার মানুষ বর্ষা মওসুমে কিছুটা স্বস্তি পান। জুন থেকে সেপ্টেম্বরে দূষণের তীব্রতা কমে আসে, মাঝে মাঝে নির্মল বায়ু পাওয়া যায়। অন্যদিকে অক্টোবর থেকে দূষণ বাড়তে থাকে, শুষ্ক মৌসুমে নগরবাসীকে ভুগিয়ে মে মাসের দিকে একিউআই কমতে থাকে।
এবার অক্টোবরের ১৪ দিনের মধ্যেই ঢাকাবাসী দুই দিন ভালো বাতাস পেয়েছে। এর আগের ৬ বছরে অক্টোবরে ঢাকায় ভালো বাতাস ছিল মাত্র তিনদিন, যার দুদিন ছিল ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে।
এবারের বায়ুমানের উন্নতিতে বৃষ্টির যোগ দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমান এবং পরিবেশগত দূষণ গবেষণা কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী নুরুল হুদা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সাধারণত এই সময়ে আমাদের দেশে এত বৃষ্টিপাত থাকে না। বৃষ্টি বেশি হলে বাতাসের সূক্ষ্ম ধূলিকণাগুলো মাটির সঙ্গে মিশে যায়। বাতাসটা তখন পরিষ্কার থাকে শুষ্ক মৌসুমের তুলনায়।”
লম্বা ছুটিও এর পেছনে কারণ হতে পারে জানিয়ে হুদা বলেন, “কলকারখানাগুলো থেকে যে দূষণ হয়, সেটাও ছুটিতে কম হয়। বিশাল সংখ্যক মানুষ ঢাকার বাইরে গেছে, সে কারণেও দূষণ কম হতে পারে।”
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কামরুজ্জমান বলেন, বায়ুদূষণ তৈরি হয় যেভাবে, এটি তত তাড়াতাড়ি কমে যায় না; কমার জন্য কিছুটা সময় নেয়।
তার ভাষায়, ঢাকা ও এর আশেপাশের এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টি এবং বায়ুপ্রবাহ ভাল থাকায় উপরিভাগের দূষণকণা পরিষ্কার হয়ে গেছে বা উড়ে গেছে। ঢাকার দূষণের জন্য অন্যতম দায়ী আশেপাশের অনেক ইটভাটা বৃষ্টির কারণে বন্ধ ছিল। দূষণের আরেক বড় উৎস ঢাকার নির্মাণযজ্ঞ, ভূমিতে এখন নির্মাণ কাজ তুলনামূলক কমে উপরের দিকে হওয়ায় দূষণ কমছে।
লোডশেডিং না থাকলে ঢাকার বায়ুমান আরও ভালো থাকত মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এখন যে জেনারেটর চলছে, প্রতিটি জেনারেটর ঘণ্টায় ১০ লিটারের মত ডিজেল পোড়ায়। এতে কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনো অক্সাইড- এগুলো তৈরি হবে, কিছু ব্ল্যাক কার্বন তৈরি হবে। বায়ুদূষণ হচ্ছে, শব্দদূষণ হচ্ছে- এটি স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।”
ভালো বায়ুর জন্য ‘অসময়ের বৃষ্টির’ পাশাপাশি সরকারের তৎপরতাকেও কারণ হিসেবে দেখাতে চান পরিবেশ অধিদপ্তরের ঢাকা অঞ্চলের পরিচালক জিয়াউল হক।
“এসময় তো বৃষ্টি হয় না। এবার হচ্ছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় ঢাকার আশেপাশের ইটভাটা একটু কম চালু হয়েছে, কারণ বৃষ্টি।
“আরেকটি হল, পরিবেশ অধিদপ্তর কড়াকড়ি করে অবৈধ ইটভাটা ভেঙে দিচ্ছে। কিছু মালিক বোঝার চেষ্টা করছে, অবৈধ ইটভাটা চালু করলে কী হবে। তারা ভয়ে আছে এবং কেউ কেউ ইটভাটা চালু করে নাই।”
ঢাকায় দূষণের পেছনে দেশের বাইরের কারণের কথাও বললেন জিয়াউল। তার দাবি, “ঢাকার বায়ুদূষণের ২৫ ভাগ দায়ী যেটা দেশের বাইরে থেকে দূষণ আসে, ভারত থেকে। ওখানে দূষণ কম থাকলে, ঢাকাতেও এর প্রভাব পড়ে।”
‘বায়ুমান সতকর্তা’
বৃষ্টির প্রভাব কেটে যাওয়ার মধ্যে বুধবার থেকেই আবার দূষণ বাড়তে শুরু করেছে ঢাকার বাতাসে। সামনে শীত মৌসুমে বাতাসে বিষ যে আরও বাড়বে, সে কথা মনে করিয়ে দিলেন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. লেলিন চৌধুরী।
তিনি বললেন, “সামনের শুষ্ক মৌসুমে ধূলিকণা বাতাসে উড়ে বায়ুমান অস্বাস্থ্যকর হয়ে যাবে। এমনিতে শীতের দূষণে নাক, চোখ ও শ্বাসতন্ত্রের অসুখ নিয়ে ঢাকার হাসপাতালে প্রতিবছরই রোগীদের ভিড় থাকে।
সেজন্য ঘূর্ণিঝড় বা জ্বলোচ্ছ্বাসের মত বায়ুমান নিয়ে সতর্কতা সংকেত জারির পাশাপাশি দূষণপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করার তাগিদ দেন এই চিকিৎসক।
“যেদিন বায়ুমান খারাপ থাকবে, সেদিন রেডিও-টেলিভিশনে তা প্রচার করতে হবে। শিশু ও বয়স্করা খুব বেশি প্রয়োজন না হলে বাইরে যাবে না। বাইরে যেতে হলে মাস্ক পরতে হবে। যারা শ্বাসতন্ত্রের সমস্যায় ভুগছে, তাদের জন্য এই সংকেত অনেক উপকারী হবে।
“আমরা আশা করব, অচিরেই পরিবেশ অধিদপ্তর বা মন্ত্রণালয় এটি প্রচারের ব্যবস্থা করবে। নাগরিকদের উদ্বুদ্ধ করবে। যেসব জায়গায় বায়ুমান খুব খারাপ সেটা চিহ্নিত করে প্রচার করা এবং যারা সংবেদনশীল তারা যেন এই এলাকাগুলো এড়িয়ে চলেন।”