Loading...

বিদেশি ফল চাষের প্রতি ঝোঁক বাড়ছে কৃষকদের

| Updated: February 24, 2023 17:52:35


বিদেশি ফল চাষের প্রতি ঝোঁক বাড়ছে কৃষকদের

বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের অন্যতম বড় অংশ হলো কৃষি খাত। ২০২০-২১ অর্থবছরে কৃষিখাত থেকে মোট জিডিপির ১৩.৪৭ শতাংশ এসেছে।

কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষিকাজে আসছে পরিবর্তন। বাংলাদেশে সাধারণত বিরাজ করে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া। কিন্তু গত দশকে জলবায়ু ক্রমাগত পরিবর্তনের কারণে এ দেশের আবহাওয়ায়ও বিরূপ প্রভাব পড়েছে। আগের তুলনায় এখন গ্রীষ্মকাল বেশি সময় ধরে বিরাজ করছে। গরমের পরপরই শীত চলে আসছে। শীতকালের স্থায়ীত্বের সময় ও বেশিদিন থাকছে না। আষাঢ় – শ্রাবণ মাস বর্ষা ঋতুর সময়। কিন্তু আষাঢ়ের আগেই পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে ঢল নেমে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলছে। ফসল ঘরে তোলার আগে জমিতেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে প্রায় অর্ধেক।

কৃষকদের লাভের অংশ উঠানো তো দূরে থাক, নিজেদের প্রতিদিনের খাদ্য সঞ্চয়েই টান পড়ে যাচ্ছে। এই সমস্যা চলছে বিগত দুই দশক ধরে। বর্তমানে তা আরো বিরূপ আকার ধারণ করেছে। ২০২২ সালের বন্যা যার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। এসব কারণেই কৃষকরা এখন দেশি ফসলের মায়া কাটিয়ে মনোযোগ দিচ্ছে বিদেশি ফসলের দিকে। এই বিরূপ আবহাওয়ার মধ্যে যেই ফসলেই তারা লাভের আশা দেখছে সেই ফসল চাষে তারা উদ্যোগী হচ্ছে। হোক না সে সুদূর চীনের ফসল।

এমনই কিছু বিদেশি ফলের চাষ বর্তমানে এতো বেশি বেড়েছে যে সাধারণ মানুষ প্রায় ভুলতে বসেছে যে আদতে এগুলো দেশীয় ফল না।

চায়নিজ কমলা 

এই কমলা কিন্তু বাংলাদেশের ফল না। কমলা আসলে চীনা ফল, যদিও কমলার অনেক জাত বাজারে দেখতে পাওয়া যায়। তবে চীনা কমলায় সারাবিশ্বে সমাদৃত। পূর্বে শুধু সিলেটেই দেশি কমলার চাষ হতো। এই চাষ সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই বহাল ছিলো। কিন্তু মাঝে চাষের পরিমাণ কমে যায় কারণ গাছ ৫ - ৬ বছরের বেশি বেঁচে থাকতো না। গাছে মড়ক লাগতো।

কমলা চাষে সিলেটের আধিপত্য কমে গিয়ে বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে কমলা চাষে পঞ্চগড় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এখন ইউটিউব দেখে চাষ পদ্ধতি জেনে নিয়ে অনেকে সফল হচ্ছে চাষকাজে।

মাশরুম

মাশরুম চাষ বাংলাদেশে একেবারেই নতুন ধারণা। বিগত কয়েক বছরের মধ্যেই মাশরুম চাষ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মাশরুম চাষ সহজ এবং সুস্বাদু হওয়ার কারণেই এর জনপ্রিয়তা বেড়েছে বেশি। বাংলাদেশের আবহাওয়ার উপর ভিত্তি করে ঘরে বসে চাষ করা সম্ভব।এই চাষে সফলতার হার অনেক বেশি হওয়াই বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলাতে মাশরুম চাষ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে উঠেছে।

স্ট্রবেরি

বিদেশি এই ফল অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই অদিকাংশ মানুষের পছন্দের ফলের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। জনসাধারণের চাহিদার উপর ভিত্তি করে কৃষকরাও এই ফল চাষের উদ্যোগ নিয়েছেন এবং তারা আশানুরূপ ফল ও পেয়েছেন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট স্ট্রবেরির তিন ধরনের জাত উদ্ভাবন করেছেনঞবাংলাদেশে সফলভাবে স্ট্রবেরি চাষের উদ্যোগ শুরু হয়েছে ২০০৭ সাল থেকে। এআইএস - এর তথ্যমতে বর্তমানে বাংলাদেশের ২৫টি জেলায় স্ট্রবেরির চাষ হচ্ছে।

ড্রাগন

নামের কারণে চীনা মনে হলেও ড্রাগন ফল আসলে দক্ষিণ আমেরিকার ফল। ড্রাগন ফল বাংলাদেশের বাজারে এসেছে মাত্র কয়েক বছর কিন্তু এরই মধ্যে এর জনপ্রিয়তা সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে। উষ্ণ অঞ্চলের ফল হওয়ায় বাংলাদেশে এর চাষ সম্ভব। ইতোমধ্যে অনেক কৃষক ড্রাগনের চাষ করে সফলতা পেয়েছেন। বগুড়া সহ বেশ কয়েকটি অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে ড্রাগন ফলের চাষ শুরু হয়েছে। পুষ্টিগুণেও ড্রাগন অনেক সমৃদ্ধ।

আঙুর

বেশ আগে থেকেই বাংলাদেশে আঙুর চাষের কথা বলা হলেও সেভাবে চাষ কখনো হয়নি। যাও বা একটু চেষ্টা করা হয়েছে, অতিরিক্ত টক স্বাদ হওয়ার কারণে তা সফল হয়নি। কিন্তু কৃষিবিদেরা মনে করছেন বাংলাদেশে আঙুর উৎপাদন সম্ভব। আঙুর উৎপাদন করতে প্রায় ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার প্রয়োজন। বাংলাদেশের গ্রীষ্মকালীন তাপমাত্রা বর্তমানে ৩০ ডিগ্রি অতিক্রম করতে দেখা যায় অহরহ। মাটির গুণাগুণও আঙুর চাষ করতে সহনীয় বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এখনো পর্যন্ত আঙুর আমদানি নির্ভর একটি ফল হলেও কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ ও আঙুর উৎপাদন করতে পারবে বলে ধারণা করা যায়।

লিচু:

দেশের অন্যতম পরিচিতো ও জনপ্রিয় ফল লিচু। লিচু প্রধানত একটি দেশি ফল। দিনাজপুর, ঈশ্বরদী লিচু চাষে প্রসিদ্ধ। দেশি লিচু চাষের পাশাপাশি বিদেশি লিচু চাষের ঝোক ও লিচু চাষিদের মধ্যে আছে। অনেকে বানীজ্যিকভাবে বিদেশি লিচু চাষ ও করে থাকেন।

লিচুর প্রধান উৎপাদনকারী দেশ হলো চীন। বিগত দশক থেকে বাংলাদেশে লিচু উৎপাদন বেড়েছে। লিচু গরমের ফল। যে কারণে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান আবহাওয়ার সাথে এর ফলন সম্ভব হয়েছে আশানুরূপভাবে। এবং কৃষকরাও এই সম্ভাবনাময় ফসলের চাষ লুফে নিয়েছে। কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট কর্তৃক লিচুর অনেক জাত বের হয়েছে কিন্তু চায়না-৩ হলো সবচেয়ে ভালো জাত। বর্তমানে দেশের বহু জেলায় লিচুর চাষ হচ্ছে যার মাঝে রাজশাহী, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, পাবনা, যশোর, সুনামগঞ্জ, চট্টগ্রাম উল্লেখযোগ্য।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশীয় ফলের উপর অনেক প্রভাব পড়েছে। যেমন দেশি পেয়ারা বর্ষায় মিষ্টি হয়। কিন্তু বর্ষার পানি বেড়ে গেলে পেয়ারায় পোকা হওয়া শুরু হয়। বর্তমানে দেশি পেয়ারার পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবে বিদেশি পেয়ারার চাষও অনেক বেড়েছে।

দিনে দিনে এই বিদেশি ফল চাষের প্রতি ঝোক এবং এর উৎপাদন এ দেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাসের সাথে মিশে গিয়েছে। কয়েক বছর আগেও যে ফল মানুষের পরিচিত ছিলো না আজ সেই ফল পছন্দের তালিকায় উঠে যাচ্ছে। বিদেশি ফল চাষ দেশি চাষের উপর যেমন হুমকিস্বরূপ তেমন আবহাওয়া পরিবর্তনের দিকে তাকালে আশীর্বাদও বলা যায়। ঠিকভাবে পরিচর্যা করতে পারলে দেশি ফলের পাশাপাশি বিদেশি ফল দিয়েও জনগণের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব, যেন মৌসুমী ফল ছাড়াও বছরের বাকি সময় পুষ্টিকর ফল বাজারে মজুদ থাকে।

সুরাইয়া ফাতিমা বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে অধ্যয়নরত।

[email protected]

Share if you like

Filter By Topic