গৎবাঁধা ক্যারিয়ার গ্রাফের বাইরে এখন অনেকেই ঝুঁকে পড়ছেন সমান্তরাল ধারায়। আর সেই ধারায় রয়েছে সামাজিক মাধ্যমে ইনফ্লুয়েন্সিং, ব্লগ বা ভ্লগ তৈরি ইত্যাদি। এই সবগুলো কাজের জন্যই বেশ প্রাথমিক একটি ধাপ হিসেবে থাকে নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল। তাতে নিজের তৈরি ভিডিওগুলো প্রচারের মাধ্যমে অডিয়েন্সের সাথে সংযুক্ত হবার পাশাপাশি থাকে উপার্জনের উদ্দেশ্যও।
যদিও ইউটিউব ভিডিও থেকে ঠিক কেমন উপার্জন হয়, তা নিয়ে একটু ঝাপসা ধারণা থাকে অনেকের। অনেকেই ভাবেন, ইউটিউবে প্রচার শুরু করলেই রাতারাতি বড়লোক হওয়া যাবে, তো অন্যরা ভাবেন, এসবই ভুয়া কথা। আসলে সত্যটা কী? ইউটিউব ভিডিওতে ভিউয়ের মাধ্যমে কেমন উপার্জন করা যায়? এ নিয়েই আজকের লেখা।
প্রথমেই অনুমোদন
ইউটিউবে উপার্জনের প্রথম শর্ত হচ্ছে মানিটাইজেশনের জন্য অনুমোদন পাওয়া। এর জন্য প্রয়োজন হয় অন্তত ১০০০ জন সাবস্ক্রাইবার এবং ৪ হাজার ওয়াচ আওয়ার– অর্থাৎ, ইউটিউবে থাকা ভিডিওগুলো অন্তত ৪ হাজার ঘণ্টা দেখা হয়েছে।
মানিটাইজেশন বা ইউটিউব পার্টনারশিপের জন্য অনুমোদন পাবার যোগ্যতা, অর্থাৎ যথেষ্ট সংখ্যক সাবস্ক্রাইবার ও ওয়াচ আওয়ার যোগাড় করার পর গুগল অ্যাডসেন্স অ্যাকাউন্ট খুলে সেখানে আবেদন করতে হবে। গুগল অ্যাডসেন্স দল নির্দিষ্ট ইউটিউব চ্যানেলটি পরখ করে অনুমোদন দেবার পর মূলত টাকা উপার্জনের পথ প্রসারিত হবে।
প্রভাবকারী বিষয়গুলো
কিছু নির্দিষ্ট বিষয় ইউটিউবে আসা অর্থকে প্রভাবিত করে। প্রথমত, কোনো ভিডিওর ‘ভিউ’ অপশনে ক্লিক করলেই তা থেকে টাকা আসবে, এটা ভুল ধারণা। ভিডিওতে থাকা বিজ্ঞাপন অন্তত ৩০ সেকেন্ড ধরে দেখা হলে তবেই তা থেকে টাকা আসা সম্ভব। কতবার ‘ভিউ’ অপশনে ক্লিক করা হচ্ছে বা কতবার ভিডিওতে প্রবেশ করা হচ্ছে, তা থেকে কতক্ষণ ধরে ভিডিওটি দেখা হচ্ছে– তা বেশি জরুরি। তাই দর্শকদের যাতে ইউটিউব থেকে মজাদার বিজ্ঞাপন দেখানো হয়, এ আশা করা ছাড়া এখানে করার তেমন কিছু নেই।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি ইউটিউবে অর্থোপার্জনকে প্রভাবিত করে, তা হচ্ছে সিপিএম-এর হার। সিপিএম বলতে বোঝায় প্রতি এক হাজারটি বিজ্ঞাপনের জন্য কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে বিজ্ঞাপনদাতা কতটুকু অর্থ বিনিয়োগ করেন। সিপিএম এর হার যেখানে বেশি, সেখানে অপেক্ষাকৃত উপার্জনও বেশি; যেমন– নরওয়ে এবং জার্মানির সিপিএম হার সবচাইতে বেশি।
এদিকে বাংলাদেশে ইউটিউবের সিপিএম হার হিসেব করে দেখা গেছে প্রায় ৬৪ টাকা। উন্নত দেশগুলোর তুলনায় এটি খুব একটা বেশি নয়, তবে নিয়মমাফিক কাজ চালিয়ে গেলে ইউটিউব থেকে যথেষ্ট অর্থোপার্জন সম্ভব।
যতই ভালো চলুক, ইউটিউবে উপার্জন কোনো নির্দিষ্ট মাসিক বেতনের মতো করে আসবে না, এ বিষয়ে সবসময় সচেতন থাকতে হবে। তাই উপার্জনের জন্য শুধু এই পেশার উপর নির্ভর করলে নিজের সঞ্চয় নিয়ে সতর্ক থাকলে ভালো। তৃতীয় বিষয়টি অবশ্যই দর্শক বা সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা বৃদ্ধি। কেননা স্বাভাবিকভাবেই যত বেশি মানুষ ভিডিও দেখবে, তত বেশি বিজ্ঞাপন দেখারও সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে প্রত্যক্ষভাবে আয় বৃদ্ধির কোনো সংযোগ নেই।
কত টাকা আসবে?
ইউটিউব থেকে প্রতি হাজার ভিউর মাধ্যমে ঠিক কত টাকা আসবে, তা স্পষ্টভাবে বলা সম্ভব নয়। কেননা পুরো বিষয়টিই নির্ভর করে ভিডিওগুলোতে থাকা বিজ্ঞাপনের উপর এবং দর্শকের বিজ্ঞাপন দেখার সময় ও পরিমাণের উপর। তারপরও একটি হিসাবনির্ভর অনুমান দেয়া যায়।
গড় যে টাকা ইউটিউব প্রতিটি ভিউ থেকে কেটে নেয়, গুগল অ্যাডসেন্সের মাধ্যমে তার ৬৮ শতাংশ দেয়া হয় ইউটিউবারদের। তাই সে হিসেবে প্রতি এক হাজার ভিউতে একজন ইউটিউবারের পাবার কথা ১২২ মার্কিন ডলারের মতো। কিন্তু বাস্তবের হিসেবটা বেশ আলাদা।
কেননা অনেকেই বিজ্ঞাপন ব্লকের জন্য ‘ইউটিউব ভ্যান্সড’-এর মতো আলাদা অ্যাপ বা ‘ব্রেভ’ এর মতো আলাদা ব্রাউজার ব্যবহার করেন। এতে করে ইউটিউবে ভিডিওর প্রতি হাজার ভিউতে উপার্জন এসে দাঁড়ায় তিন থেকে পাঁচ মার্কিন ডলারে। নিজের সম্ভাব্য অর্জনের জন্য ইউটিউবাররা অ্যাডসেন্স রেভিনিউ ক্যালকুলেটর ব্যবহার করে একটা অনুমেয় হিসাব জেনে নিতে পারেন, যদিও তার সাথেও বাস্তবের গরমিল রয়েছে।
তাই ইউটিউব চ্যানেল পরিচালনার ক্ষেত্রে খুঁটিনাটি সবকিছু জেনে, নির্দিষ্ট বিষয় ও অঞ্চলের উপার্জনের হার সম্পর্কে সতর্ক হয়েই এ কাজে নামা উচিত। সর্বোপরি নিজের ভিডিওর মান বৃদ্ধি, দর্শকের আগ্রহের দিকে খেয়াল রাখা এবং ভিউর উপর নির্ভর না করে অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং বা অন্যের পণ্যের প্রমোশন, বিভিন্ন পণ্যের রিভিউ প্রদান বা নিজস্ব পণ্য বিক্রয়ের মতো বিষয়গুলোর দিকে নজর দেয়া গেলে ইউটিউবে আয় বৃদ্ধি হওয়া সম্ভব।
অনিন্দিতা চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে সদ্য মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন।