মোহাম্মদপুরের খাবারের কথা উঠলেই মাথায় ভেসে ওঠে বিরিয়ানী, চাপ, কাবাব, হালিমের কথা। তবে সহজেই মিষ্টির কথা আমাদের কারো মাথায় হয়তো আসে না। তবে এদিকে কাবাবের গলি বলে খ্যাত গলিটির মাথায় বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভান্ডারের সুবৃহৎ একটি শাখা, এর পূর্বে ভাগ্যকূল এর শাখা, টাউনহল ও মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে মুসলিম সুইটস এর শাখাও রয়েছে। তবে এরকম বড় চেইনশপগুলোর বাইরেও চোখে পড়ে কিছু দোকান। তেমনই একটি দোকান 'সুনীতি মিষ্টান্ন ভান্ডার।' এটির অবস্থান সলিমুল্লাহ রোডে বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভান্ডারের বিপরীত দিকে। কাবাবের গলি থেকে রাদতা পার হয়ে বিপরীর দিকে এলেই পাবেন দোকানটি।
দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা 'গরম মিষ্টির হেঁশেল।' তবে সব মিষ্টি একেবারে গরম পরিবেশন করা যায় তা নয়। সংরক্ষণের সুবিধার্থে ইরানি ভোগ, টক দই, রসমালাই, মিষ্টি দই রাখা হয় ফ্রিজে।
দোকানে ঢুকতেই চোখে পড়ে, বড় শো-কেসে তাকে তাকে সাজিয়ে রাখা রকমারি মিষ্টির সম্ভার। এর ভেতর আছে, বালুসাই, প্যারা সন্দেশ, গাজরের বরফি, মিহিদানা লাড্ডু, কাশ্মিরী চমচম, ল্যাংচা (সাদা), মাওয়া লাড্ডু, রাণী ভোগ, সরমালাই, ইরানী ভোগ, ছানার সন্দেশ(গুড়), ছানার সন্দেশ (চিনি) , টক দই, মিষ্টি দই, ছানার পোলাও, মৌচাক মিষ্টি, গোলাপজাম , চমচম (সাদা) , চমচম (লাল), কালোজাম, বেবি সুইটস, রসগোল্লা, কৃষ্ককলি, লালমোহন (শুকনা), বড় লালমোহন (রসের), পানিতোয়া (পান্তুয়া) ও রসমালাই।
দোকানের ক্যাশে বসা মো.আবদুল মান্নান জানালেন, "দোকানে আমি আছি ছয় মাস মতো হবে। মিষ্টি তো এগুলো একেকজনের কাছে একেকটা বেশি প্রিয়। তবে রসগোল্লা, কালোজাম, ছানার সন্দেশ, লাড্ডু, চমচম, লালমোহন- এসব তো সবসময়ই বেশি চলে।"
তার পাশে বসা ছিলেন সঞ্জয় ঘোষ। তিনিও এই দোকানের সাথে যুক্ত। তিনি জানালেন, " দোকানের বয়স খুব বেশিদিন হয়নি। একবছরের বেশি হবে, তবে দু বছর পূর্ণ হয়নি এখনো৷ দোকানের মালিক দিব্য জ্যোতি ঘোষ। ওনারা পারিবারিকভাবে মিষ্টির ব্যবসার সাথে যুক্ত, সেটা আরো চল্লিশ বছর বা তার বেশি হবে। "
মো.আবদুল মান্নান যোগ করলেন, " হ্যাঁ, ওনারা কলাবাগান থাকেন। সুনীতি ওনার মায়ের নাম। মা-র নামেই এই দোকান৷ আর বাবা মনোজ কুমার ঘোষ নিজেও এই ব্যবসার (মিষ্টি) সঙ্গে যুক্ত।"
সঞ্জয় ঘোষ জানালেন দোকানটি শুরু করার সময়ের কথা- " দিব্য জ্যোতি ঘোষ সেন্ট জোসেফে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে পড়াশোনা করেছেন। ওনার পিসেমশাই মানে ফুফা বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভান্ডারের কলাবাগান শাখার কর্ণধার। ১৯৮২ সাল থেকে সেই দোকান শুরু।"
রাস্তার বিপরীতেই তাদের সুবিশাল এক শাখা। সেটি দেখিয়ে বললেন, " এই ব্র্যান্ডটা তাদের পারিবারিক ব্র্যান্ড বলা যায়। মনোজবাবু অর্থাৎ, ওনার বাবা বিক্রমপুরের বনানী শাখার দায়িত্বে আছেন।"
শো-কেসে চার সারিতে সাজানো রকমারি মিষ্টির সম্ভার, ছবি: লেখক
তাহলে কলাবাগান নিবাসী হয়েও মোহাম্মদপুরকে দোকানের জন্য বেছে নেয়া হলো কেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে সঞ্জয় ঘোষ বললেন, " দিব্য জ্যোতির স্কুল-কলেজ যেহেতু এখানে ছিলো, ফ্রেন্ড-সার্কেল এখানে। যেসব স্যারদের কাছে প্রাইভেট পড়তেন, তারাও এদিকে। সহজ কথায়, পরিচিত মানুষ বেশি। আর বিক্রমপুরের এখানকার শাখা অনেক আগের, সেখানে অন্য একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত আছেনই। তাই ও ঠিক করে, নিজের মতো করে মিষ্টির দোকান করবে। নাম হিসেবে ওর মা-র নামে দেয় 'সুনীতি মিষ্টান্ন ভান্ডার।" গরম মিষ্টির হেঁশেল কথাটি যুক্ত করার কারণ হিসেবে তিনি জানালেন, " এখানে মিষ্টি সব টাটকা পাবেন৷ দই, রসমালাই এর স্বাদ ঠিক রাখার জন্য পরে ফ্রিজে রাখা হয়। তবে বাকি মিষ্টিগুলো শো-কেসে থাকে। রোজই নতুন তৈরি করা হয়। গরম মিষ্টি বলতে টাটকা-ই বোঝানো হয়।"
(ঘড়ির কাঁটার দিকে) লালমোহন, গোলাপজাম, মিহিদানা লাড্ডু, ছানার গুড় সন্দেশ, ইরানী ভোগ, ছবি: লেখক
এখানে রয়েছে প্রায় ২৫ পদের মিষ্টি, যেগুলোর নাম পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। মিষ্টিগুলোর ভেতর তাদের ইরানী ভোগ, ছানার গুড় সন্দেশ, মিহিদানা লাড্ডু, গোলাপজাম ও লালমোহনের স্বাদ নিয়ে দেখা হলো।
ইরানী ভোগ, সরমালাই ও রসমালাইয়ের মূল তৈরি প্রক্রিয়া প্রায় একই। এক্ষেত্রে গরুর দুধের সাথে গুঁড়ো দুধও ব্যবহার করা হয়। তবে ইরানী ভোগে আলাদা ঝোল থাকেনা, যা বাকিগুলোই থাকে। মিষ্টিটি বেশ নরম, পরিমিত মিষ্টতা থাকায় স্বাদ স্নিগ্ধ। যারা পরিমিত মিষ্টি পছন্দ করেন, তাদের ভালো লাগবে৷ ওপরে পাবেন একটি পেস্তাবাদামও।
ছানার সন্দেশে তারা খেজুরের গুড় ব্যবহার করেন। বেশিক্ষণ বাইরে রাখা যায়না। একারণে, পরে ফ্রিজে রাখা হয়। এটিও বেশ নরম, ছানার মান বেশ ভালো। খেজুর গুড়ের হালকা তেতো ভাবটিও আছে।
গোলাপজামের ভেতরটা গোলাপি। ফুড গ্রেড কালার ব্যবহার করেন বলেই জানান তারা। এটি বেশ নরম ও আনুপাতিকভাবে মিষ্টি, তবে একেবারে অতি মিষ্টি নয়। মিহিদানার লাড্ডু ও মাওয়া লাড্ডুর মূল প্রস্তুতিতে তেমন কোনো পার্থক্য নেই বলেই আবদুল মান্নান জানান। মাওয়া লাড্ডুতে আলাদাভাবে মাওয়া ব্যবহার করা হয়, তবে মূল প্রস্তুত প্রণালি কাছাকাছি। মিহিদানার লাড্ডুটি বেশ মোলায়েম ও বেশ মিষ্টি। অন্যান্য আইটেমগুলোর চেয়ে এর স্বাদ আলাদাভাবে মনোযোগ আকর্ষণ করার মতো।
লালমোহন মিষ্টি এখানে চিনি দিয়েই করা হয়। তবে জ্বালের কারণে লাল রংটা আসে। শীতের সময় নলেন গুড়ের স্পেশাল রসগোল্লা পাওয়া যায়, যা এখন নেই। তবে লালমোহন দুরকম আছে- শুকনো ও রসের।
রসের লালমোহন প্রকৃতপক্ষেই রসালো ও খুবই নরম। উল্লেখিত অন্যান্য মিষ্টিগুলোর তুলনায় সরস ও বেশি মিষ্টি। যারা একটু তীব্র মিষ্টি পছন্দ করেন, তাদের আলাদাভাবে ভালো লাগবে।
এছাড়াও, এখানে গাজরের বরফি, মৌচাক মিষ্টি, কৃষ্ণকলি নামের গাঢ় লাল রঙা মিষ্টি আছে। এগুলো তুলনামূলক কম চলায় অল্পই বানানো হয় বলে জানালেন সঞ্জয় ঘোষ।
বড় লালমোহন (রসের) ও পানিতোয়া (পান্তুয়া) , ছবি: লেখক
অন্যান্য মিষ্টির ভেতর চমচম আছে তিন প্রকারের, তার ভেতর স্পেশাল একটি আছে- কাশ্মিরী চমচম। অন্যগুলোর তুলনায় আকারে বড় ও এতে বেশ ভালো পরিমাণে মাওয়া ব্যবহার করা হয়। টক দই ও মিষ্টি দই তৈরিতে তারা গরুর দুধ ব্যবহার করেন। টক দই অনেকে স্বাস্থ্যের জন্য, আবার অনেকে বিভিন্ন উৎসবে রান্নার জন্য নেন। মিষ্টি দই উৎসবে, পার্বণে বেশি বিক্রি হয় বলে জানা গেলো।
বর্তমান সময়ের মিষ্টির বাজার ও চাহিদার ব্যাপারে বললেন, " মিষ্টি এখনো মানুষ বেশ ভালোই খায় তো। বিক্রি ভালোই হয়। বিশেষ করে, রসগোল্লা, কালোজাম, লাড্ডু, লালমোহন এগুলো তো সবসময়ই চলতে দেখেছি। তবে ইদানীং ব্যবসার অবস্থা ভালো না, কারণ চিনির দাম বেশি, গ্যাসের দাম বেশি।"
দোকানে মিষ্টি মূলত পার্সেলই হয়। কেউ কেউ বসে খান। ভেতরে ছয়জনের বসার ব্যবস্থা আছে। তবে এখানে শুধু মিষ্টিই বানানো হয়। লুচি বা পুরি ধরনের কিছু তারা বানান না।
আবদুল মান্নান বলছিলেন, "দোকান সকাল দশটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত খোলা থাকে। বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান, বিয়ে-জন্মদিন, ঈদ-পূজার সময় বিক্রি বা অর্ডার বেশি থাকে। অন্য সময় মোটামুটি ভালোই বিক্রি হয়।"
সঞ্জয় ঘোষ যোগ করলেন," বিক্রিতে তো ওঠা-নামা থাকে। কোনোদিন কোনো মিষ্টি তিন কেজি বা পাঁচ কেজি যেতে পারে, কোনোদিন আবার দেখা যাবে এক কেজি যায়। কিন্তু আমরা মিষ্টি প্রতিদিন বানাই, দুধটা ভালো দেই। মিষ্টির রং হিসাবে ফুড গ্রেড কালার দেই। নামে যেমন আছে- গরম মিষ্টির হেঁশেল- সেই টাটকা স্বাদ সবসময় ধরে রাখতে চাই।"
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে স্নাতকোত্তর করছেন।