হাতুড়ি, কোদালের টুংটাং শব্দে মুখরিত প্রায় প্রতিটা সুড়ঙ্গ। সুড়ঙ্গের প্রবেশদ্বার দিয়ে যে আলো ভিতরে প্রবেশ করছে তাতে কেবল কিছুদূর পর্যন্তই আলোকিত হয়। এরপর সুড়ঙ্গ খুঁড়ে যতোই ভিতরে যাওয়া হয়, কৃত্রিম আলোর প্রয়োজনীয়তা ঠিক ততোটাই বৃদ্ধি পায়।
তবে কী কাজ হচ্ছে সেই সুড়ঙ্গগুলোর ভিতর? কারা-ই বা কাজ করছে সেখানে? সেই প্রশ্নের উত্তর পেতে শুরুতেই যেতে হবে ভারতের অঙ্গরাজ্য ঝাড়খন্ড ও বিহারে।
কাঁধে ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যাওয়ার বয়সে এখানকার শিশুরা স্কুল ব্যাগ ছেড়ে কাজ করছে মাইকা উত্তোলন খনিতে। পরিবারের হাল ধরতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলে যাচ্ছে গভীর সুড়ঙ্গের ভেতর। অর্থের অভাবে বাবা-মায়েদেরও সন্তানদের ঠেলে দিতে হচ্ছে মৃত্যুকূপে।
এখন, মনে প্রশ্ন আসতে পারে কী এই মাইকা?
মাইকা শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘মিক্যায়ের’ 'থেকে যার অর্থ চকমক করা। মাইকা হচ্ছে প্রাকৃতিক ভাবে উৎপাদিত এমন একটি খনিজ যেটি একটি নয় বরং অনেকগুলো খনিজের সমন্বয়।
এটি একধরনের স্বচ্ছ খনিজ যার প্লেটগুলোকে সহজেই আলাদা করা যায়। সাধারণত দুই ধরনের মাইকা পাওয়া যায়, যার মধ্যে একটি হচ্ছে প্রাকৃতিক অপরটি হচ্ছে সিনথেটিক।
বিশ্বজুড়ে প্রাকৃতিক মাইকার চাহিদা-ই সবচেয়ে বেশি। এটি প্রসাধনী ও নির্মাণশিল্পের মতো আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। প্রসাধনীর মধ্যে মাইকা ব্যবহৃত হয় আইশ্যাডো, ফাউন্ডেশান, ব্লাশ,লিপস্টিক ও হাইলাইটার- ইত্যাদি পণ্যে। মাইকার কারণেই এই পণ্যগুলো চকচক করে থাকে।
পশ্চিমা বিশ্বের সাথে এই মেকআপ জগতের সম্পৃক্ততা সবচেয়ে বেশি। কারণ বিশ্বের সব নামীদামী প্রসাধনী ব্র্যান্ড তাদের দ্বারাই তৈরি। কিন্তু এই মেকআপের ঝকঝক জগতের আড়ালে কতকিছু যে ঘটে যাচ্ছে সে খবর কেউ রাখেনা।
বিশ্বের অনেক দেশই মাইকা রপ্তানির সাথে যুক্ত। তবে এক্ষেত্রে ভারতের ঝাড়খন্ড ও বিহার রাজ্য সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে। কারণ পৃথিবীর প্রায় ৬০ শতাংশ মাইকা এই দুই অঙ্গরাজ্য থেকেই পাওয়া যায়। কিন্তু মেকআপের এই মূল উপাদান মাইকা উত্তোলনে শোষিত হচ্ছে ভারতের হাজার হাজার শিশু ও তাদের পরিবার।
সর্বনিম্ন ৫ বছর বয়স থেকে মাইকা উত্তোলন খনিতে কাজ করা শুরু করে ঝাড়খন্ড ও বিহারের শিশুরা। সেখানের সরকার আইন করে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করলেও অবৈধ উপায়ে শিশুদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ চলমান রয়েছে।
তবে কেন শিশুদেরই বেশি ব্যবহার করা হয় মাইকা উত্তোলন খনিতে? কারণ মাইকা যে সুরঙ্গগুলোর ভিতরে মাইকা পাওয়া যায় সেগুলো খুব সরু প্রকৃতির হয়ে থাকে। যেখানে একজন শিশুদের আকৃতি তুলনামূলকভাবে ছোট হওয়ার কারণে তারা সহজেই সুড়ঙ্গগুলোর ভিতরে গিয়ে কাজ করতে পারে। আর সেজন্যই দিনের পর দিন তাদের এমন পরিবেশে কাজ করতে হয় যেখানে পদে পদে রয়েছে মৃত্যুর আশঙ্কা।
এরকম বিপজ্জনক ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করে শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে যক্ষ্মা, হাঁপানি, ত্বক ও শ্বাসযন্ত্রের ইনফেকশন - এর মতো জটিল ব্যধিতে। এমনকি হাত-পা ভেঙে পঙ্গু হয়ে যাওয়া, মাথায় আঘাত পেয়ে মৃত্যুবরণ করার ঘুটনাও নতুন নয়।
২০২১ সালে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রবন্ধে উঠে এসেছে, ঝাড়খন্ড ও বিহারের আশে পাশের এলাকা মিলিয়ে প্রায় ২২ হাজার শিশু এই খনিতে কাজ করে। সবচেয়ে ভালোভাবে কাজ করলেও প্রতিদিন ২০-৩০ রূপির বেশি আয় করতে পারেনা খনিতে কর্মরত শিশুরা।
খনিতে কাজ করতে গিয়ে শিক্ষার দিক থেকেও তারা পিছিয়ে পড়ছে। অনুমান করা হয় ঝাড়খন্ড ও আশেপাশের অঞ্চলের প্রায় ৪,৫৪৫ জন শিশু স্কুলে যায়না। সন্তানদের স্কুলে না পাঠিয়ে কাজ করতে পাঠানোর একটি বড় কারণ সেখানের মানুষদের দারিদ্র্য।
পুরো ভারতে দারিদ্র্যতার দিক থেকে ঝাড়খন্ড ২য় ও বিহার ৫ম স্থানে অবস্থান করছে। উল্লেখ্য, ঝাড়খন্ডের দারিদ্র্যের হার ৪২.১৬% এবং বিহারে তা ৩৩.৭৪%।
সরকারের তরফ থেকে মাইকা মাইনিং নিষিদ্ধ করা হলেও সেখানকার স্থানীয় ক্ষমতাধর লোকজন ও কর্মকর্তাদের প্রভাবে মাইনিং পুরোপুরি বন্ধ করা হচ্ছেনা।
মাইকা উত্তোলন করতে গিয়ে যে শিশুরা দুর্ভাগ্যবশত মারা যায় তাদের মৃত্যুর জন্য দেওয়া হয়না তেমন কোনো ক্ষতিপূরণ। এমনকি তাদের মৃত্যুর বিষয়টিও সম্পূর্ণ চেপে যাওয়া হয়। নিহতদের পরিবারের উপরও চাপ প্রয়োগ করা হয়, যাতে করে তারা প্রশাসনের কাছে মুখ না খোলে।
এবার এশিয়ার দেশ ভারত থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আলোকপাত করা যাক আফ্রিকার দেশ মাদাগাস্কারে। কারণ মাইকা মাইনিং এর ক্ষেত্রে মাদাগাস্কারের অবস্থা কিছুটা ভারতের মতোই।
ধারণা করা হয়, দেশটির দক্ষিণাংশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় ১০ হাজার শিশু এই মাইকা উত্তোলন কাজের সাথে সম্পৃক্ত। যাদের অবস্থা ভারতের শিশুদের অনুরূপ।
মাদাগাস্কারে যে মাইকা উত্তোলন করা হয় তার প্রায় ৯০ শতাংশ রপ্তানি করা হয় চীনে। কিন্তু এই আমদানিকৃত মাইকার পিছনে কতো হাজার শিশুকে যে দিনের পর দিন নির্বিচারে শোষণ করা হচ্ছে সে সম্পর্কে জানারও চেষ্টা করেনা কোম্পানিগুলো।
তবে আশার কথা হচ্ছে বর্তমানে মাইকা উত্তোলনে শিশুদের নিয়োগ বন্ধ করার বিষয়টি কঠোরভাবে দমন করার জন্য কাজ চলছে। আন্তর্জাতিকভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে আইন-কানুন। প্রাকৃতিক মাইকার পরিবর্তে ল্যাব এ তৈরি সিনথেটিক মাইকা ব্যবহারের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করা হচ্ছে।
আবার জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি এনজিও কাজ করছে শিশুদের মাইকা মাইনিং নামক মৃত্যুফাঁদ থেকে বের করে আনার জন্য।
ফারজানা জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।