‘সেদিনও এমনি নীল গগনের বসনে শীতের শেষে
রাতজাগা চাঁদ চুমো খেয়েছিল হেসে;
পথে পথে ফোটে রজনীগন্ধা অলকনন্দা যেন–
এমন সময় ঝড় এলো এক, ঝড় এলো ক্ষ্যাপা বুনো।’
এই চরণগুলো সেই গানের অংশ, একুশে ফেব্রুয়ারির কথা এলে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই যেটি মনে পড়ে যায়। ভাষাপ্রেমী সকলে দৃপ্তকণ্ঠে গুনগুন করে ওঠেন, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’। ভাষার ইতিহাসকে যেমন ভোলা যায় না, তেমনি এই গানটিও আমরা ভুলতে পারি না। আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা এ গানে প্রথম সুরারোপ করেন শিল্পী আবদুল লতিফ। পরবর্তী সময়ে আলতাফ মাহমুদের সুর সংযোজিত এ গানে আন্দোলনের চেতনার সাথে ফুটে উঠেছে ভাষার উপর আঘাত হানা শাসক ও শোসকগোষ্ঠীর প্রতি তীব্র ক্ষোভ– ‘জাগো নাগিনীরা জাগো কালবোশেখীরা; শিশুহত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা’। শিল্পী আবদুল লতিফ নিজেও একটি গান লিখেছিলেন একুশের ভাবাবেগকে কলমে ধরে, যেটি পরবর্তী সময়ে মানুষের মুখে মুখে ফেরে–
‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়
ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে-পায়ে
কইতো যাহা আমার দাদায়,
কইছে তাহা আমার বাবায়
এখন কও দেখি ভাই,
মোর মুখে কি অন্য কথা শোভা পায়?’
বাংলার বুকে, বাংলা ভাষার বুকে ঝড় এসেছে বহুবার। সেইসব ঝড়ে পথে উপড়ে পড়েছে কত না রজনীগন্ধা, অলকনন্দা শহিদেরা। তবু তাদের বলিদানের চেতনা এখনো সুরভিত করে আমাদের চিন্তা-চেতনা। স্মৃতি ভাস্বর হয় একুশের ভাবনায়।
যেকোনো সংগঠিত সাংস্কৃতিক বা সামাজিক আন্দোলন– মানবজাতির উপর হওয়া সকল ধরন। শোষণ-নিপীড়নের ইতিহাসে সঙ্গীতের ভূমিকা সবসময়ই উল্লেখযোগ্য। বাঙালির জাতিগত ও ভাষাগতভাবে উপনিবেশবাদ থেকে মুক্ত হবার ইতিহাসেও সময়ে সময়ে বহু গান এসেছে। কিছু হারিয়ে গেছে, কিছু আবার সময়োত্তীর্ণ হয়ে রয়ে গেছে সেইসব দিনের সাক্ষী হয়ে। প্রতি একুশে ফেব্রুয়ারি, ভাষা শহিদ দিবসের ভোরবেলা নগ্ন পায়ে যে গানগুলো গাইতে গাইতে দলে দলে মানুষ যাত্রা করে শহিদ মিনারের দিকে– তাই তো আমাদের কাছে একুশের গান।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের পর সর্বপ্রথম যে গানটি এ প্রেক্ষাপটে উঠে আসে, তা ছিল এক ভাষা আন্দোলনকারীরই অবদান। গাজীউল হক লিখেছিলেন ‘ভুলব না, ভুলব না, একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না’ গানটি। এতে সুর দিয়েছিলেন তারই ছোট ভাই নিজাম উল হক। সূচনা পর্বে এ গান অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। একুশের প্রথম গান হিসেবে এ গানটি একুশের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনকারীদের স্মৃতিচারণে পরবর্তী সময়ে উঠে এসেছে। তবে প্রভাতফেরির প্রথম গান এটি নয়। বায়ান্ন’র আরো দুই বছর পর, ১৯৫৩ সালে প্রথমবার শহিদ দিবসের প্রভাতফেরি হয়। এবং সেবার প্রভাতফেরিতে গাওয়া হয় ‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল’ গানটি। এ গানের রচয়িতা ছিলেন আরেক ভাষা আন্দোলনকারী মোশারেফ উদ্দিন এবং এতে সুরারোপ করেন আলতাফ মাহমুদ।
হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশের বিভিন্ন রচনা নিয়ে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ নামে একটি সংকলনগ্রন্থ রয়েছে। সেখানে তিনি তোফাজ্জেল হোসেনের লেখা এই গানটিকেও ‘একুশের গান’ তকমা দিয়েছেন–
‘রক্তশপথে আমরা আজিকে তোমারে স্মরণ করি,
একুশে ফেব্রুয়ারি।
দৃঢ় দুই হাতে রক্তপতাকা ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরি–
একুশে ফেব্রুয়ারি।’
একুশের বহু গান এর পর আরো অনেকেই তাদের সৃজনীশক্তিতে নির্মাণ করেছেন। সে অর্থে সবগুলো গান প্রচলিত না হলেও ভাষার জন্য আবেগটা সেই একই। ‘ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রুগড়া এ ফেব্রুয়ারি’ বারবার ফিরে আসে, আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ভাষার সুরক্ষার জন্য, নিজস্বতায় বেঁচে থাকার জন্য আমাদের পূর্বজরা কীভাবে রাজপথে অকাতরভাবে বিলিয়ে দিয়েছিলেন নিজেদের জীবন।
অনিন্দিতা চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে সম্প্রতি মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। [email protected]