ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ‘একতরফা নিষেধাজ্ঞায়’ উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষতির কথা জাতিসংঘে তুলে ধরে সংকট সমাধানে আলোচনার ওপর জোর দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন জানান, আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাধারণ বিতর্ক পর্বে বক্তব্য রাখবেন সরকারপ্রধান।
প্রতিবারের মতো এবারও সেখানে বাংলায় বক্তৃতা দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বক্তব্যের বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “করোনা মহামারীর ক্ষতি কাটিয়ে না উঠতেই ইউক্রেইন সংঘাত বিশ্বকে সামষ্টিক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
“এ প্রেক্ষাপটে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে যে প্রতিকূলতার মুখামুখি হতে হবে সে বিষয়টি এবং সংকট মোকাবেলায় একতরফা জবরদস্তিমূলক পদক্ষেপ কিংবা নিষেধাজ্ঞার মতো সিদ্ধান্ত না নিয়ে সংকট সমাধানে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান এবং বহুপাক্ষিকতাবাদকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে গুরত্বারোপ করতে পারেন।”
এক প্রশ্নের জবাবে মোমেন বলেন, “প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে পাবলিকলি বলেছেন, ইউক্রেইন যুদ্ধের পর থেকে বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞার কারণে, নিষেধাজ্ঞা যাদেরকে আঘাত করার জন্য করা হয়েছিল, তার পরিবর্তে বিশ্ববাসী এর ফলে কষ্ট পাচ্ছে, অসুবিধায় পড়েছে। বিভিন্ন দেশ এর জন্য অসুবিধায় পড়েছে।
“উদ্দেশ্য ছিল যাকে শাস্তি দেওয়ার, সে অতো অসুবিধায় পড়ছে কি-না, আমি জানি না। কিন্তু অন্যান্য লোকজন বহু কষ্টে আছে।”
এর আগে অনেক যুদ্ধ হলেও ক্ষতির বিবেচনায় এবারের ভিন্ন পরিস্থিতির কথা তুলে ধরেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
তিনি বলেন, “যুদ্ধের তো শেষ নাই, ছোটখাটো যুদ্ধ লেগেই আছে। কিন্তু সে সমস্ত যুদ্ধ অনেক সময় আমাদের অর্থনীতিকে বা আমাদের মুদ্রাস্ফীতিকে ওভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে না।
“কিন্তু এবারে, বিশেষ করে নিষেধাজ্ঞার কারণে আমাদের জনজীবনে মুদ্রাস্ফীতি, সাপ্লাই চেইন, ট্রানজেকশন চেইন এগুলোতে বেশ প্রভাব পড়েছে। তো, সেটাই দুঃখজনক।
“এই জন্যে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় যাতে সবার সাথে আলোচনার করে সিদ্ধান্ত নিলে পরে এটা আরও ফলপ্রসু হবে এবং মানুষের অমঙ্গল কম হবে।”
জাতিসংঘে উচ্চ পর্যায়ের যত সভা
বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যাওয়ার আগে ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লন্ডনে অবস্থান করবেন তিনি।
১৯ সেপ্টেম্বর বাকিংহাম প্যালেসে ব্রিটিশ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ায় যোগ দেওয়ার পর নিউ ইয়র্কের উদ্দেশে যাত্রা করবেন প্রধানমন্ত্রী।
জাতিসংঘের বিভিন্ন উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে ১ অক্টোবর ওয়াশিংটন সফর করবেন।
নিষেধাজ্ঞার প্রভাবের পাশাপাশি বাংলাদেশের অভাবনীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং প্রযুক্তিখাত বিকাশে সরকারের কার্যক্রম বক্তৃতায় তুলে ধরবেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “করোনাভাইরাসের মতো ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যসংকট মোকাবেলার লক্ষ্যে টিকা এবং প্রতিষেধকের ন্যায্য ও আরও ন্যায়সঙ্গত বণ্টনের আহ্বান বক্তৃতায় পুনর্ব্যক্ত করতে পারেন শেখ হাসিনা।
“আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে উপায় খুঁজে বের করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহবান জানাতে পারেন।”
মোমেন জানান, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের বলিষ্ঠ অবস্থান, সন্ত্রাস ও সহিংস উগ্রপন্থার বিষয়ে বাংলাদেশের ‘জিরোটলারেন্স’ নীতি, সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ অভিবাসন অভিবাসীদের মৌলিক পরিষেবা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, জলবায়ুপরিবর্তন ও এর প্রভাব, জলবায়ু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, এবং ফিলিস্তিন সম্পর্কিত বিষয়সমূহ তার বক্তব্যে উঠে আসবে।
তিনি জানান, রানির শেষকৃত্যে যোগ দেওয়ার কারণে ১৯ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সদরদপ্তরে শিক্ষাব্যবস্থার বিবর্তন নিয়ে একটি শীর্ষ সম্মেলনে উপস্থিত থাকতে পারবেন না শেখ হাসিনা।
শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ওই সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধিত্ব করবেন বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
২০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্ল্যাটফর্ম অব উইমেন লিডার্স-এর উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর।
“সভায় প্রধানমন্ত্রী সংকট মোকাবেলায় তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীদের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে তার নেতৃত্বের সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপের কথা তুলে ধরতে পারেন।”
চ্যাম্পিয়ন্স অব দ্য গ্লোবাল ক্রাইসিস রেসপন্স গ্রুপের (জিসিআরজি) উচ্চ পর্যায়ের সভা অনুষ্ঠিত হবে ২১ সেপ্টেম্বর। এ গ্রুপে ছয়জন চ্যাম্পিয়নের মধ্যে ধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্যতম।
চলতি বছরের মার্চে জাতিসংঘ মহাসচিব খাদ্য, জ্বালানি ও আর্থিক বিষয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শেখ হাসিনাসহ মোট ছয়টি দেশের রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানগণের সমন্বয়ে এ গ্রুপটি গঠন করেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “উচ্চ পর্যায়ের এ সভায় বর্তমান প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী তার সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করবেন। উক্ত বৈঠকে জি-৭, জি-২০ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত থাকবেন।”
২২ সেপ্টেম্বর অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিট্যান্স (এএমআর) বিষয়্ক একটি উচ্চপর্যায়ের সভা অনুষ্ঠিত হবে। ওই সভায় কো-চেয়ার হিসেবে অংশ নেবেন প্রধানমন্ত্রী।
এবারের অধিবেশনে দ্য ফিউচার অব ডিজিটাল কোঅপারেশন: বিল্ডিং রেজিলিয়েন্স থ্রু সেইফ, ট্রাস্টেড অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ডিজিটাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার এবং ‘বহুপাক্ষিকতাবাদ ও খাদ্য নিরাপত্তা’ বিষয়ক আলাদা দুটি উচ্চ পর্যায়ের সভা অনুষ্ঠিত হবে।
এ দুটি উচ্চ পর্যায়ের সভায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন শেখ হাসিনা। প্রথম সভায় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় অংশ নিতে পারেন বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
মোমেন জানান, কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে এবার কোনো পার্শ্ব অনুষ্ঠান জাতিসংঘ সদর দপ্তরের ভেতরে হবে না। তবে, রোহিঙ্গা সমস্যা ও টেকসই আবাসন নিয়ে আলাদা দুটি অনুষ্ঠান আয়োজন করবে বাংলাদেশ।
“পাশাপাশি জাতিসংঘ সদর দপ্তরের ভেতরে পদ্মা বহুমুখী সেতু বিষয়ক একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী আয়োজন করা হয়েছে।”
রোহিঙ্গা বিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের পার্শ্ব অনুষ্ঠান ২২ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হবে, যাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অংশ নেবেন।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ওআইসি সেক্রেটারিয়েট, কানাডা, সৌদি আরব, তুরস্ক, গাম্বিয়া, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়া রোহিঙ্গা বিষয়ক পার্শ্ব অনুষ্ঠানটি কো-স্পন্সর করবে।
জাতিসংঘ শরনার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার, জাতিসংঘ মহাসচিবের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত, এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার মহাপরিচালক অনুষ্ঠানে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ব্রিফ করবেন।
২১ সেপ্টেম্বর টেকসই আবাসন বিষয়ক পার্শ্ব অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ এবং জাতিসংঘ আবাসন সংস্থা যৌথভাবে এর আয়োজন করছে।
কসভোর প্রেসিডেন্ট, ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট, স্লোভেনিয়ার প্রেসিডেন্ট, ক্যাম্বডিয়ার প্রধানমন্ত্রী, জাতিসংঘ মহাসচিব, জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটর, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের নির্বাহী পরিচালকের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন শেখ হাসিনা।
মোমেন জানান, প্রতিবারের ন্যায় এবারও যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের আয়োজনে একটি গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণ করবেন প্রধানমন্ত্রী।
বৈঠকে দেশের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধাগুলো উপস্থাপন করবেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগ প্রস্তাব বাংলাদেশের কাছে তুলে ধরবেন।
প্রতি বছরের মত এবারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশিদের আয়োজনে অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘সবই উপরআলার ইচ্ছা’
গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভারত সফরে যাওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়নি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর। সেসময় ‘শারীরিক অসুস্থতার’ কথা বলেছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
জাতিসংঘে সফরে শিক্ষামন্ত্রী, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীসহ নিজেও প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হবেন বলে বুধবার জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন।
ভারত সফরে না যাওয়ার প্রসঙ্গ টেনে বুধবারের সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জানতে চান, এবারের সফরে তার যাওয়া হচ্ছে কি-না?
উত্তরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “ইনশাআল্লাহ যাচ্ছি। সবই উপরআলার ইচ্ছা। আমরা জানি না, হঠাৎ করে যদি আমার খুব অসুবিধা হয়ে যায়, মরেও যেতে পারি…”
ভারত সফরে না যাওয়ার পর তার মন্ত্রিত্ব থাকা নিয়েও বিভিন্ন ধরনের আলোচনা উঠেছিল। এ বিষয়ে আব্দুল মোমেন বলেন, “কেউ কেউ বাড়ন্তভাবে এগুলো বলে থাকেন। আমি আশা করি, তারা বুঝতে পারবে।”