Loading...
The Financial Express

১৬ ডিসেম্বরেও স্বাধীন হয়নি ঢাকার যে অঞ্চল

| Updated: December 15, 2022 19:32:42


মিরপুর বিহারী ক্যাম্প। ছবি: সাইফুল আমিন কাজল মিরপুর বিহারী ক্যাম্প। ছবি: সাইফুল আমিন কাজল

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ৯৩ হাজার সৈন্য নিয়ে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ইতিহাসের পাতায় ১৬ ডিসেম্বরই বিজয়। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর কি আসলেই মুক্ত হয়েছিল পুরো বাংলাদেশ?

দেশের কয়েকটি অঞ্চলে তখনো চলছিল যুদ্ধ। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর এ যুদ্ধ চালিয়ে যায় তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আল-শামস ও বিহারীরা। মূল বাহিনীর পরাজয়ের পরও তারা শাস্তির ভয়ে বিভিন্ন এলাকায় প্রতিরোধের ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যায়। ১৬ ডিসেম্বরের পরেও দেশের উত্তরাঞ্চলে যুদ্ধ চলতে থাকে। ১৭ ডিসেম্বর স্বাধীন হয় কিশোরগঞ্জ। ১৮ ডিসেম্বর স্বাধীন হয় বগুড়া, গাইবান্ধা, রংপুর, নাটোর ও নওগাঁ। ২২ ডিসেম্বর স্বাধীন হয় বরিশালের আগৈলঝড়া ও গৌরনদী।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিচ্ছিন্ন খণ্ড যুদ্ধ হয়েছিল বিজয়ের পরেও। কিন্তু খোদ ঢাকার একটি বৃহৎ এলাকা, মিরপুর ১২ নং সেকশন বিজয়ের পরও দীর্ঘ ৪৫ দিন ছিল পাকিস্তানপন্থী বিহারী ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পালিয়ে আসা পাক সেনা ও রাজাকারদের দখলে। ঢাকাবাসীরা বিজয়ের উল্লাসে মত্ত ছিল। কিন্তু মিরপুর তখনো সম্পূর্ণ স্বাধীন হয়নি। বিহারী ক্যাম্পে শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছিল স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার ৪৫ দিন পর মিরপুর শত্রুমুক্ত হয়েছিল এক তীব্র রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। সে যুদ্ধে ৪৮ জন সেনা সদস্য ও ৫৩ জন পুলিশ সদস্য শহীদ হন।

১৯৪৭ এ দেশভাগের পর ভারতের বিহার থেকে মুসলিম বিহারীরা পূর্ব পাকিস্তানে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের বসবাসের জন্য মিরপুরের আবাসিক এলাকা বরাদ্দ করা হয়। মেজর জেনারেল (অব.) মুহাম্মদ ইব্রাহিম তার 'সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে আটাশ বছর' বইতে লিখেছেন, "মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে উর্দুভাষী বিহারী মুসলমানরা বিনা দ্বিধাতেই পাকিস্তানকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের অনেক যুবক রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়। বিশেষ করে ঢাকা এবং চট্টগ্রামে পাক কর্তৃপক্ষ তাদের মধ্যে প্রচুর অস্ত্র বিতরণ করে।"

যুদ্ধের সময় পাকিস্তান বাহিনী প্রায় ২০ হাজার বিহারীকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে সিভিল আর্মড ফোর্স গঠন করে। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও বিহারীদের নিয়ে গঠিত সিভিল আর্মড ফোর্স আত্মসমর্পণ করেনি। তারা অস্ত্র নিয়ে মিরপুরে অবস্থান নেয়। মিরপুর হয়ে ওঠে বিহারীদের শক্ত ঘাঁটি।

১৬ ডিসেম্বরের পর ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলের নিরাপত্তার দায়িত্ত্বে ছিল ভারতের বিভিন্ন রেজিমেন্ট। মিরপুরের দায়িত্বে ছিল ভারতীয় বাহিনীর ১০০০ জন সৈন্য সম্বলিত ১০ বিহার রেজিমেন্ট। তাদের সাথে পাকিস্তানি বিহারীদের ভাষা ও সংস্কৃতির মিল ছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনী থাকায় মিরপুর নিয়ে কেউ ততটা চিন্তিত ছিল না বিজয়ের পর।

কিন্তু যখন দেখা গেল ১৬ ডিসেম্বরের পরেও বিহারীরা আত্মসমর্পণ করে অস্ত্র জমা দিচ্ছে না, তখন শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ এর ২৪ জানুয়ারি সেনাবাহিনী ও পুলিশের সমন্বয়ে একটি দল গঠন করে তাদের নির্দেশ দেন মিরপুর যেয়ে বিহারীদের থেকে অস্ত্র জমা নেওয়ার জন্য। তবে ২৬ জানুয়ারি ছিল ঈদ-উল-আযহা। তাই ২৭ জানুয়ারি মিরপুর যাবার সিদ্ধান্ত হয়।

২৭ তারিখ ক্যাপ্টেন হেলাল মোর্শেদের নেতৃত্ত্বে দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ও পুলিশ সদস্যরা মিরপুরের প্রবেশ মুখ টেকনিক্যালে অবস্থান নেয়। দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের অনুরোধে মিরপুরের দায়িত্ব তাদের হাতে ছেড়ে দেয় ভারতের বিহার রেজিমেন্ট। ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য মোখলেসুর রহমান জানান, “মিরপুরের প্রকৃত অবস্থা আঁচ করতে পারেনি ভারতীয় সৈন্যরা। বিহার রেজিমেন্টকে ধোকা দিয়ে রেখেছিল বিহারীরা। যেহেতু একই ভাষার লোক, তাদের ভুলিয়ে রেখেছিল। ভারতীয় রেজিমেন্ট আমাদের ভুল তথ্য দিয়েছিল। তারা বলে সেখানে মাত্র দুই-চারটা অস্ত্র থাকতে পারে, চাইলেই বিহারীরা ফেরত দিয়ে দিবে।”

২৯ জানুয়ারি মিরপুরে কারফিউ জারি করা হয়। সকাল সাতটায় মিরপুর ১২ নং পানির ট্যাংকের কাছে অবস্থান নিয়ে অভিযানের প্রস্তুতি নেয় দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ৮৬ জন সৈন্য ও ৬৩ জন পুলিশ। পুলিশ বিহারীদের উদ্দেশ্যে মাইকিং করে অস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু বিহারীদের পক্ষ থেকে শক্ত প্রতিরোধের মুখে পড়ে তারা।

বিহারীরা অভিযানের আশঙ্কায় ঘরের দেয়ালে ছিদ্র করে অস্ত্র তাক করে ছিল। ৩০ জানুয়ারি সকাল ১১টায় আকস্মিকভাবে একযোগে গুলি আসতে থাকে বিহারীদের দিক থেকে। হতভম্ব হয়ে যায় সেনা ও পুলিশ সদস্যরা। ধ্বংস হয়ে যায় তাদের ওয়্যারলেস যোগাযোগ ব্যবস্থা। তাদের ওপর বিহারীরা এমনভাবে আক্রমণ শুরু করে যে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা কঠিন হয়ে পড়ে।

মোখলেসুর রহমান জানান ৩০ তারিখ সন্ধ্যার পর শক্তি বৃদ্ধি করে সেনাবাহিনী। মর্টার ও আর্টিলারি ব্যবহার করা শুরু করে তারা। ৩০ জানুয়ারি বেলা ১১টা থেকে ৩১ জানুয়ারি সকাল ১০টা পর্যন্ত একটানা যুদ্ধ হয়। পরে ৩১ তারিখ বেলা ১১টায় সেনাবাহিনীর তীব্র আক্রমণের ফলে হার মানে বিহারীরা। আত্মসমর্পণ করে অস্ত্র জমা দিতে রাজি হয় তারা। সেদিন ১১ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার হয় বিহারী অধ্যুষিত এলাকা থেকে।

মিরপুর যুদ্ধে ঢাকার পুলিশ সুপার জিয়াউল হক লোদী, লেফটেন্যান্ট সেলিম সহ বাংলার অনেক সূর্য সন্তান শহীদ হন। এছাড়াও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান ৩০ তারিখ বিহারীদের অতর্কিত হামলায় নিহত হন। তিনি তার ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে মিরপুর গিয়েছিলেন।

মিরপুর মুক্তকরণ যুদ্ধে শহীদ লেফট্যানেন্ট সেলিম।   ছবি: ঢি.টি.

২০০১ সাল থেকে ৩১ জানুয়ারিকে ‘মিরপুর মুক্ত দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। মিরপুরের সাত্ত্বিক নাট্য সম্প্রদায় ২০০১ সালে সর্ব প্রথম এ উপলক্ষে তিন দিনের নাট্য উৎসবের মাধ্যমে এই আয়োজন শুরু করে। এ উপলক্ষে প্রতিবছর আলোচনা, গান, নাটক ও আলোকচিত্র প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধাকে দেয়া হয় সংবর্ধনা।

ফাইয়াজ আহনাফ সামিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।

[email protected]

Share if you like

Filter By Topic