হেরাক্লিওন: পানির নিচে ঘুমন্ত এক শহর


শবনম জাবীন চৌধুরী  | Published: September 04, 2022 18:02:18 | Updated: September 05, 2022 11:04:13


ছবি: দা ভিনটেজ নিউজ 

হারিয়ে যাওয়া জাহাজ বা গুপ্তধন - এ বিষয়গুলো নিয়ে সবারই যেন কৌতূহল থাকে তুঙ্গে। আর যদি এমন হয় যে সাগরের অতলে হারিয়ে যাওয়া এক আস্ত শহরের সন্ধান মিলেছে, তাহলে সেই সুদূর অতীতের রহস্য উন্মোচনে মন অস্থির হয়ে ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কালের স্রোতে বা কোনো পরিস্থিতির কবলে পড়ে হারিয়ে যাওয়া এই জিনিস বা স্থাপনাগুলো হয়তো একসময় ধ্বংসাবশেষ হিসেবে পুনরুদ্ধার হয়।   

সাগরের অতল জলরাশির নীচে সন্ধান পাওয়া এই শহরের নাম হেরাক্লিওন। অনেকে অবশ্য একে ‘ক্লিওপেট্রার শহরও’ বলে থাকেন। আজ থেকে প্রায় ২,০০০ বছর পূর্বে এই শহরটি মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরের নিকটস্থ ভূমধ্যসাগরের একটি উপসাগর ‘আবু কির বাউতে’ তলিয়ে গিয়েছিল।  

প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, ভূমিকম্প ও সুনামির আঘাতে এবং সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কারণে ক্রমশ শহরটির ভিত দুর্বল হয়ে পড়েছিল। খুব সম্ভবত, খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষের দিকে প্রবল কোনো বন্যার কবলে পড়ে পুরো শহরটি পানির নীচে তলিয়ে গিয়েছিল।  

২০০০ সালে ইউরোপিয়ান ইন্সটিটিউট ফর আন্ডার ওয়াটার আর্কিওলোজিতে কর্মরত ফ্র্যাংক গোডিও নামের একজন ফরাসি আন্ডার ওয়াটার এক্সপ্লোরার তার টিমকে নিয়ে ভূমধ্যসাগরে হারিয়ে যাওয়া একটি ফরাসি যুদ্ধজাহাজের ধ্বংসাবশেষের অনুসন্ধান করছিলেন। এই অনুসন্ধান করতে গিয়েই খোঁজ মেলে হাজার বছর পূর্বে বিলীন হয়ে যাওয়া এক আস্ত শহরের।  

বড় বড় পাথরের চাঁই ও কাদার স্তর সরাতেই বেরিয়ে আসে ঘুমিয়ে থাকা এক নীরব রাজ্য। ফ্র্যাংক গোডিও ও তার দল এই শহরের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়েন। তাদের মতে, বেশ ছিমছাম আর সাজানো গোছানো শহরটির প্রায় সবকিছুই অক্ষত ও অবিকৃত রয়েছে যেন কালের সাক্ষী বহন করে চলেছে আজও।  

সেখানে পাওয়া গেছে ৬৪ টি জাহাজ, ৭০০ টি নোঙ্গর, স্বর্ণমুদ্রার ভান্ডার, ১৬ ফিট উঁচু একটি মূর্তি, দেবতাদের রাজা আমুনের উপাসনার জন্য নির্মিত মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ, লাল গ্রানাইটের তৈরি দেবতা হাপির একটি প্রতিকৃতি, ব্রোঞ্জের তৈরি রাজা ওশিরিসির একটি মূর্তি, ফেরাউনসহ নানা দেব-দেবীর মূর্তি, গয়নাসহ আরো অনেককিছু।   

যে মূর্তি বা বস্তু সামগ্রীগুলো গ্রানাইট ও ডায়োরাইটের তৈরি ছিল সেগুলো এতো বছর পানির নীচে থাকলেও অনেকটা অক্ষত অবস্থায় রয়েছে।  

যেসকল জিনিস এ পর্যন্ত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে সেগুলো কায়রোতে অবস্থিত গ্র্যান্ড ইজিপশিয়ান মিউজিয়ামে রাখা হয়েছে।  

এই শহরের সাথে প্রাচীন গ্রীক ইতিহাসের অনেকগুলো অধ্যায় জড়িয়ে রয়েছে। হেরাক্লিওন শহরের কোনো এক মন্দিরে ফারাও রাজবংশের সর্বশেষ রাণী ক্লিওপেট্রার রাজ্যাভিষেক হয়েছিল।  

আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট তার নামের সাথে মিল রেখে আলেকজান্দ্রিয়া নামের একটি শহর গড়ে তুলেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের সময় বেশকিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সেই শহরটি প্রচন্ড রকমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে তিনি আলেকজান্দ্রিয়া থেকে বন্দর স্থানান্তর করে হেরাক্লিওনে নিয়ে আসেন। প্রাচীন মিশরের প্রধান  বন্দর নগরী ছিল এই হেরাক্লিওন শহর। তৎকালীন গ্রীক বিশ্বের সব এলাকা থেকে বিভিন্ন জাহাজ এসে ভিড়ত এই বন্দরে।  

আমুন, মিশরীয়রা যাকে দেবতাদের রাজা বলে মানত (গ্রীকদের কাছে যার পরিচয় ছিল হেরাকলস নামে) তার উপাসনার জন্য খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে এখানে একটি বিশাল মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল।  

কয়েকটি দ্বীপকে ঘিরে হেরাক্লিওন শহরটি গড়ে উঠেছিল এবং এর মাঝে বেশকিছু খাল ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। এই শহরে গড়ে উঠা বিভিন্ন মন্দির ও বাড়িঘরে যাতায়াতের জন্য সেতু গড়ে তোলা হয়েছিল এবং পারাপারের জন্য খেয়া নৌকা ও ফেরির ব্যবস্থা ছিল।  

শবনম জাবীন চৌধুরী ইউনিভার্সিটি  অব এশিয়া প্যাসিফিকের ফার্মেসি বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। 
zabin860@gmail.com 

Share if you like