সময়টা ১৯৪৩ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি। জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে আকাশ থেকে ঝড়ে পড়ছে হাজার হাজার প্যামফ্লেট। সেই প্যামফ্লেটগুলোতে ছাপানো ছিলো এডলফ হিটলারের সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদময় শব্দগুচ্ছ।
তবে কারা ছড়িয়ে দিচ্ছে এমন সব কাগজ? প্রতিটি প্যামফ্লেটের নিচে 'হোয়াইট রোজ' নামটি স্বাক্ষর করা থাকলেও এর পিছনের নায়কদের নাম ছিলো তখনও অজানা।
কিন্তু আড়াল থেকে এক জোড়া চোখ এসব কিছুর উপর নজর রাখছিলো। প্যামফ্লেটগুলো পাঠ করে শিক্ষার্থীদের মনে যে চেতনার আলো জ্বলে উঠছিলো সেটি স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছিলেন তিনি।
সেই তিনি ছিলেন সোফি শল। হোয়াইট রোজ আন্দোলনের মুখ্য সদস্য। তবে সেদিন সোফি বুঝতে পারেনি এই ঘটনার পর ই হোয়াইট রোজের সদস্যরা ধরা পরে যাবে। কিন্তু কেন এই আন্দোলন? কবে থেকেই বা এর সূচনা?
সে জন্য চলে যেতে হবে দশ বছর আগের প্রেক্ষাপট ১৯৩৩ সালে, যখন এডলফ হিটলার নির্বাচনে জয় লাভ করে পুরো জার্মানির দায়িত্ব গ্রহণ করে।প্রথম দিকে অনেকেই অন্ধভাবে হিটলারকে অনুসরণ করলেও, ধীরে ধীরে সবাই তার আসল উদ্দেশ্য বুঝতে শুরু করে।
সেই তালিকায় ছিলেন সোফি ও তার ভাই হান্স শোলও। তারা ভেবেছিলেন হিটলারের হাত ধরে হয়তো একটি সুন্দর জার্মানি উপহার পাবেন সবাই। কিন্তু তারা বুঝতে পারেন আসলে একনায়কতন্ত্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে দেশের সরকার ব্যবস্থা।
১৯৩৫ সালে জার্মানিতে চালু করা হয় নুরেমবার্গ আইন। যার বদৌলতে ইহুদিদের কোণঠাসা করা শুরু করা হয়। তাদের নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয় সরকারি কার্যালয় ও শহরের বিভিন্ন অংশ থেকে। সোফি তখনও হিটলারের বিরুদ্ধে কিছু ভাবতে নারাজ।
অপরদিকে সোফির ভাই হান্স শল এর জীবনেও চলছিল একই রকম ঘটনা। বোনের মতোই তিনিও হিটলারের ন্যাশনাল সোস্যালিজম দ্বারা অভিভূত ছিলেন। তবে তার এই ভুল ভাঙতে বেশি সময় লাগেনি৷
সময়টা ১৯৩৮ সাল, হান্স তখন মিউনিখে ডাক্তারী পড়তে আসেন। তখন জার্মান বাহিনী পোল্যান্ডে প্রবেশ করে। দেশের নবীনেরা যুদ্ধে যাবার ডাক পেলো। সবার মতো হান্সকেও সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হয়েছিলো৷
যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে ১৯৪২ সালে যখন আবার মিউনিখে ফিরে এলেন তখন তিনি অন্য চেতনায় অনুপ্রাণিত মানুষ। ইহুদিদের প্রতি হিটলারের বর্বরতা, সাধারণ জনগণের কণ্ঠরোধ, যুদ্ধ সম্পর্কে কোনো কিছু আলোচনা করতে না পারার নির্দেশনা সবকিছু হান্সকে ভাবিয়ে তুলেছিলো।
এই ভাবনা থেকেই সিদ্ধান্ত নিলেন নতুন কিছু করার। হিটলারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলো তার তরুণ রক্ত। তাই সাথে আরোও তিন বন্ধুকে নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করলেন কীভাবে এই অপশক্তির বিরূদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলা যায়। সাথে যুক্ত হলেন বোন সোফি। তৈরি করলেন 'হোয়াইট রোজ' নামক গোপন ছাত্র আন্দোলন সংগঠনের।
সোফি মিউনিখে পড়তে এসে জানতে পারলেন ভাইয়ের পরিকল্পনার কথা। হান্স ও সোফিরা প্রায়ই গোপনে রাজনৈতিক আলোচনা করতেন। সেই আলোচনায় হান্স একদিন বলে উঠলেন তাদের একটি ডুপ্লিকেটিং মেশিন দরকার। মেশিন জোগাড় হলো ঠিকই তবে প্রশ্ন ছিল এখন তারা কীভাবে কাজ করবে?
তাদের সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এলেন দর্শন বিভাগের অধ্যাপক হুবার। সোফিই হুবারকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। হুবারের সহযোগিতায় শুরু হলো 'হোয়াইট রোজ' এর কাজ।
প্রচারপত্র ছাপানো থেকে শুরু করে সেগুলো শহর জুড়ে বিলি করা, দেয়ালে দেয়ালে স্বাধীনতার বাণী অঙ্কন করা, দেশের বাইরে হিটলারের আসল কর্মকান্ডের নথি প্রেরণ করা সহ আরো নানাবিধ কর্মকান্ড শুরু করে হোয়াইট রোজের সদস্যরা।
১৯৪৩ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি সোফি ও হান্স যে প্যামফ্লেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদ থেকে উড়িয়েছিলেন সেটি ছিল তাদের ৬ষ্ঠ প্যামফ্লেট। অন্যান্য বন্ধুদের সতর্কতা সত্ত্বেও সেদিন দুই ভাই বোন ধরা পড়ে যান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্তৃপক্ষের নজরে তাদের কর্মকান্ড চোখে পড়ে এবং সাথে সাথে জার্মান গোয়েন্দা সংস্থা গেস্টাপোর কাছে সম্পূর্ণ ঘটনা জানিয়ে দেওয়া হয়। সোফি ও হান্স সবকিছু বুঝে উঠে পালানোর আগেই আটক হন।
আইনী হেফাজতে নিয়ে দুই ভাই বোনকে কঠোরভাবে জিজ্ঞেসাবাদ করা হলেও বাকি সঙ্গীদের নাম তারা প্রকাশ করেননি। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চোখে সুন্দর আগামীর স্বপ্ন লালন করেছেন সোফি ও হান্স।
আটক করার কিছুদিন পরেই ১৯৪৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শিরশ্ছেদ করে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। মৃত্যুর পূর্বে হান্সের শেষ কথাটি ছিলো 'স্বাধীনতা দীর্ঘজীবী হোক'।
অন্যদিকে দরাজ কণ্ঠে সোফি বলেছিলেন, 'এই রোদ ঝলমলে দিনেই যেতে হবে আমাকে! তবে আমার মৃত্যু যদি কয়েক হাজার মানুষের ঘুম ভাঙাতে পারে, তবে আপত্তি নেই’।
দেশের জন্য কতটুকু ভালোবাসা থাকলে বলি হয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তেও এমনভাবে প্রতিবাদের ভাষা ছুড়ে দেয়া যায় সেটি বোঝার অপেক্ষা রাখেনা। শল ভাই-বোনের মৃত্যুর পর হোয়াইট রোজের বাকি সদস্যরাও বেশিদিন লুকিয়ে থাকতে পারেনি। তাদেরও অচিরেই আটক করা হয় এবং জনসম্মুখে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
ফারজানা জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।