শ্রীলঙ্কার সংকটে যুদ্ধবিধ্বস্ত তামিলরা খাদের কিনারে


এফই অনলাইন ডেস্ক | Published: September 16, 2022 16:19:55 | Updated: September 17, 2022 11:23:44


ফাইল ছবি (সংগৃহীত)

শ্রীলঙ্কার ৪৪ বছর বয়সী এক তামিল কৃষক জ্বলন্ত সূর্যের নিচে তার বর্গা নেওয়া এক টুকরা বাদামের ক্ষেতের পরিচর্যা করছিলেন, যে মূল্যস্ফীতির কারণে নিত্য প্রয়োজনীয় অসংখ্য জিনিস এখন নাগালের বাইরে তার করালগ্রাস মোকাবেলার দৈনন্দিন সংগ্রামে মাটিতে সজোরে কোদাল চালাচ্ছিলেন তিনি।

“দিনমজুরদের চেয়েও কষ্টে কাটছে এখন,” বলেন দুই হাতের তালুর ওপর ভর করে চলাফেরা করা সিঙ্গারাম সুসাইয়ামুত্থু; ২০০৯ সালে সরকারি বাহিনীর এক বিমান হামলা তার দুই পা কেড়ে নিয়েছিল, আঘাত লেগেছিল বাম বাহুতেও।

সেটা ছিল শ্রীলঙ্কার সরকার ও তামিল বিদ্রোহী গোষ্ঠী লিবারেশন টাইগারস অব তামিল ইলমের মধ্যে ২৬ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।

ওই যুদ্ধের চূড়ান্ত আক্রমণ তামিল জনগোষ্ঠীর অধিকাংশকে বিপর্যস্ত করে দেয়, এরপর এবারের অর্থনৈতিক সংকট সুসাইয়ামুত্থুর আবাস উত্তরের উপকূলীয় মুল্লাইতিভু জেলার জন্য দ্বিতীয় ধাক্কা হিসেবে এসেছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

এখানকার অনেক বাসিন্দাই এখন দিনমজুরি করে জীবন চালাচ্ছেন, তবে সুসাইয়ামুত্থু সেটাও পারছেন না।

“আমি যদি দিনমজুরি করতে যাই, কেউ আমাকে নেবে না। আমাদের মতো কারও সেখানে যাওয়া এবং সেরকম কাজ করতে পারাও সম্ভব নয়। সম্ভব কী?,” বলেন তিনি।

সাত দশকের মধ্যে শ্রীলঙ্কার দেখা সবচেয়ে বাজে অর্থনৈতিক সংকটের আগে তিনি মৎস্যজীবী ছিলেন। জ্বালানি সরবরাহ প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সুসাইয়ামুত্থুকে এখন অর্থের জন্য মাছ ধরার বদলে বাদাম চাষ করতে হচ্ছে।

“নিজেদের ক্ষুধা হয়তো নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। কিন্তু সন্তানদের তো বলতে পারিনা- ‘দেখো বাচ্চাকাচ্চা, এই যৎসামান্য খাবারই আছে, এখন ঘুমাতে যাও’, বলতে তো পারিনা, তাই না?,” বলেন তিনি।

গত মাসে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ৯৩ দশমিক ৭ শতাংশে উঠে যাওয়ার পর যারা ব্যাপক খাদ্য সংকটে ভুগছে বলে জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থা অনুমান করছে সুসাইয়ামুত্থুর পরিবার শ্রীলঙ্কার সেই ৬২ লাখ নাগরিকের অংশ।

অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে দেশটির সবচেয়ে বড় রাজস্ব আয়ের খাত পর্যটন ধ্বসে পড়ার কারণে শ্রীলঙ্কাকে এখন ভয়াবহ অর্থনৈতিক দুর্দশার মোকাবেলা করতে হচ্ছে।

এ কারণে কয়েক মাস ধরে সোয়া দুই কোটি জনসংখ্যার দেশটিকে তুমুল ‍লোডশেডিং, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, রুপির (শ্রীলঙ্কার মুদ্রা) ভয়াবহ অধোগতি এবং বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ঘাটতির কারণে খাবার, জ্বালানি ও ওষুধ আমদানির বিল মেটাতে না পেরে ব্যাপকভাবে ভুগতে হচ্ছে।

মুল্লাইতিভু শ্রীলঙ্কার দ্বিতীয় দরিদ্রতম জেলা, যেখানকার ৫৮ শতাংশ পরিবারই দারিদ্র্যপীড়িত বলে জুনে সেইভ দ্য চিলড্রেনের করা এক জরিপে উঠে এসেছিল। জেলাটির প্রায় এক চতুর্থাংশ বাসিন্দা জানিয়েছেন, এবারের অর্থনৈতিক সংকটে তারা তাদের সমস্ত আয় হারিয়েছেন।

সুসাইয়ামুত্থুর মতো জরিপে অংশ নেওয়া শ্রীলঙ্কার ৩১ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্কই বলেছেন, বাচ্চাদের খাওয়াতে তারা নিজেদের খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন।

“এই অর্থনৈতিক সংকট তাদেরকে খারাপ থেকে আরও খারাপ অবস্থায় নিয়ে গেছে। যুদ্ধের পর তারা যে অবস্থায় ছিলেন, কার্যত তারা এখন সেই অবস্থাতেই ফিরে গেছেন,” বলেছেন ওই এলাকার মানুষজনকে সহায়তা করা দাতাসংস্থা টিয়ারস অব ভান্নির প্রতিষ্ঠাতা অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বাসিন্দা সোমা সোমানাথান।

দেশটির সামাজিক ক্ষমতায়ন মন্ত্রণালয়ের সচিব নিল হাপুহিনে জানিয়েছেন, অর্থনৈতিক সংকটে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় শ্রীলঙ্কা ৪০ লাখ বাড়িকে সামাজিক কল্যাণ কার্যক্রমের আওতায় আনার উদ্যোগ এবং আরও ৬ লাখ মানুষকে নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে।

“সবচেয়ে বেশি দরকার যাদের, তাদের চিহ্নিত করে সহায়তা দেওয়া হবে,” চলতি বছরই ৩২ লাখ পরিবারের মধ্যে ৫ হাজার ১৩০ কোটি শ্রীলঙ্কান রুপি বিতরণ করার পর বলেছেন তিনি।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের কাছ থেকে আসা ২০ কোটি ডলারের ঋণও খাদ্য সংকট প্রশমণে ভূমিকা রাখবে; দ্বীপদেশটির সরকার এখন বিশ্ব ব্যাংক এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার সহায়তার দিকেও তাকিয়ে আছে।

মুল্লাইতিভুতে সন্ধ্যা, দিনের কাজ শেষে কোদাল নামিয়ে রাখলেন সুসাইয়ামুত্থু; বাদাম চাষের ফসল গোলায় তুলতে তার আরও দুই মাস সময় লাগবে।

“জিনিসপত্রের দাম কমলে, আমাদের এমন কষ্ট করতে হত না। এখন ১০ শতাংশ ঠিক থাকাও কষ্টের হয়ে দাঁড়িয়েছে, জিনিসপত্রের যে দাম,” বলেন তিনি।

 

Share if you like