কখনো কি মাথায় এসেছে যে এলাকায় এখন বসবাস, শত বছর আগে সেখানে কী ছিল? দুইশো বছর আগে বা পাঁচশো বছর আগেই বা কী ছিল? এলাকায় তখনো কেউ না কেউ বসবাস করেছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজা, বাদশাহ, নবাবরা শাসন করে গেছেন। আবার যুগে যুগে তাদের পতন হয়েছে। সুলতান, বাদশাহ, নবাবরা চলে গেলেও তাদের রাজত্ব ও শাসনের সাক্ষী রয়ে গেছে।
যার একটি রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ‘সাত গম্বুজ মসজিদ’। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে চান মিয়া হাউজিং এলাকায় রয়ে গেছে প্রাক-ঐতিহাসিক যুগের অন্যতম নিদর্শন ‘সাত গম্বুজ মসজিদ’। মূল নামাজকক্ষের উপর তিনটি বড় গম্বুজ এবং বাইরে চার কোণায় মিনার আকৃতির ছোট চারটি গম্বুজ থাকায় মসজিদটি সাত গম্বুজ নামেই বেশ পরিচিতি লাভ করে।
মসজিদের নির্মাতারা কালের গর্ভে হারিয়ে গেলেও প্রায় ৩৫০ বছর ধরে মোঘল আমলের স্থাপত্যশৈলী ও ইতিহাসের কথা জানান দিচ্ছে মসজিদটি। ইতিহাসবিদদের মতে, ১৬৮০ সালের দিকে নবাব শায়েস্তা খাঁ’র পুত্র উমিদ খাঁ মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে, রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় মোঘল সুবাদার শায়েস্তা খাঁ রাজত্ব করে গেছেন। হয়ত এককালে সাত গম্বুজ মসজিদের আশপাশে কোথাও দাঁড়াত নবাবের ঘোড়া। রানি, রাজপুত্র, রাজকন্যারা ঘুরে বেড়িয়েছেন এখানকার পথ-প্রান্তর-নদীতে। এখানেই হয়ত দল বেঁধে ছোটাছুটি করেছে নবাবের সৈন্য-সামন্ত।
মসজিদটির অতীত ইতিহাস এটি হলেও মোহাম্মদপুরসহ আশপাশের কিছু এলাকায় মসজিদের ইতিহাসকে ঘিরে আছে নানা রকম কাহিনি। কারো কারো ধারণা, মসজিদটি ‘গায়েবি’! সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে এসব মনগড়া গল্পেরও অবসান হয়েছে। প্রচলিত আছে, এক সময় এখানে কোনো মসজিদ ছিল না। এক রাতের মধ্যে গায়েবিভাবে মসজিদটি জেগে ওঠে। মসজিদটি গায়েবি হওয়ায় এতে কোনো ধরনের রঙ করা সম্ভব হয় না।
যদিও এর ব্যাখ্যা আছে। ইতিহাসবিদদের মতে, মসজিদটি সিরামিক্স বা চুনামাটি দিয়ে তৈরি। ফলে এতে কোনো রঙ ধরার কথা না। মোঘল শাসনামল ও তার কাছাকাছি সময়ের অন্যান্য স্থাপনা দেখলেও দেখা যায়, সাত গম্বুজ মসজিদসহ সকল স্থাপনার নির্মাণ কৌশল প্রায় একই।
সেসময় মসজিদটির তীর ঘেঁষে প্রবাহমান ছিল বুড়িগঙ্গা নদী। তখনকার মানবরা বর্ষা মৌসুমে নদীপথে যাতায়াতের সময় মসজিদের ঘাটে তরী, লঞ্চ কিংবা বজরা ভেড়িয়ে সালাত আদায় করতেন।
স্যার চার্লস ডি ওয়াইলি ১৮১৪ খ্রিষ্টাব্দে সাত গম্বুজ মসজিদকে নিয়ে একটি ছবি আঁকেন। শিরোনামে লেখা ছিল ‘গঙ্গার শাখা নদী বুড়িগঙ্গার তীরে সাত মসজিদ’। চিত্রকর্মে শোভা পাচ্ছে মসজিদটি দাঁড়িয়ে আছে, নদীর তীর ঘেঁষে প্রবাহমান জলে চলছে তরী। মসজিদটি ছিল নৌকার ঘাট। নানান দিক থেকে নৌকা এসে ভিড়ত সেখানে।
কথিত আছে, মসজিদের চারদিকে চারটি মিনার রয়েছে। সেগুলোতে শায়েস্তা খাঁ’র সৈন্যরা থাকত। রাতের বেলা তারা এখানে থেকে আশপাশের এলাকা পাহারা দিত। তবে সেসময় আর এসময়ের ব্যবধানে পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছুর। নদী ভরাট করে বর্তমানে শোভা পাচ্ছে সুউচ্চ অট্টালিকা। নির্মাণ করা হয়েছে ছোট-বড় দোকানপাটসহ নানা স্থাপনা।
মসজিদের পশ্চিম পাশে রয়েছে বিশাল এক মাদ্রাসা। মাদ্রাসাটি শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক (র.) ১৯৮৬ সালে নির্মাণ করেন। স্থানীয়দের অনেকে সাত গম্বুজ মসজিদকে ‘গায়েবি মসজিদ’ আখ্যা দিয়ে বিভিন্ন ঝাড়ফুঁকের জন্য আসেন মসজিদের মুয়াজ্জিনের কাছে। স্থানীয় অন্য যেকোনো মসজিদের তুলনায় মুসলমানদের কাছে সাত গম্বুজ মসজিদের গুরুত্ব বেশি।
মসজিদের ভেতরের দিকটি দৈর্ঘ্যে ১৭ দশমিক ৬৮ মিটার এবং প্রস্থে ৮ দশমিক ২৩ মিটার। মোট চার সারিতে দাঁড়িয়ে প্রায় শখানেক মুসল্লির নামাজের ব্যবস্থা আছে। মসজিদের মূল অংশের বাইরেও নামাজের ব্যবস্থা আছে। এছাড়া মসজিদের সামনের বাগানটি সব সময় বন্ধ থাকলেও ঈদের নামাজের সময় খুলে দেয়া হয় বাগানটি।
ইতিহাসের সাক্ষ্য বহনকারী সাত গম্বুজ মসজিদটি সংরক্ষণের জন্য কাজ করছে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ। ৪০০ বছরের সাক্ষী মসজিদটি সংরক্ষণ ও সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ।
যেভাবে যাওয়া যায়
ঢাকার যেকোনো জায়গা থেকেই সড়কপথে মোহাম্মদপুর আসা খুব সহজ, কেননা যেখান থেকেই আসেন না কেন, নামতে হবে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে। সেখানে নেমে যেতে হবে বাঁশবাড়ি সড়ক। সড়ক ধরে এক বা দেড় মিনিটের পথ হাঁটলেই হাতের বাঁ-পাশে দেখা মিলবে ঐতিহাসিক সাত গম্বুজ মসজিদের। অথবা বাসস্ট্যান্ড থেকে রিকশায় চড়েও আসা যায়। গুনতে হবে দশ থেকে পনের টাকা।
মো: সাজ্জাদ হোসেন বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশোনা করছেন।