মার্কিন কোম্পানি ম্যাটেলের তৈরি স্বর্ণকেশী পুতুল বার্বি ডলের নাম শোনেনি বা দেখেনি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। সারা বিশ্বজুড়েই আছে এই পুতুলের সুনাম। নারী উন্নয়নের বিভিন্ন রোল মডেলকে মার্টেল নিয়ে এসেছে বার্বি হিসেবে। আর এই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন নিজের প্রচেষ্টায় মিলিয়নিয়ার হয়ে ওঠা প্রথম মার্কিন নারী, ম্যাডাম সি জে ওয়াকার।
১৮৬৭ সালে এক আফ্রিকান আমেরিকান পরিবারে জন্ম হয় সারাহ ব্রিডলাভের। কিন্তু জীবনের প্রথম ভাগে শুধু কষ্ট আর গ্লানিই হয়ে যায় ছোট্ট মেয়েটির জীবনসঙ্গী। মাত্র ৫ বছর বয়সে মাকে হারান সারাহ; ৭ বছরে বাবাকে। এরপর বড় বোনের সংসারে গিয়ে উঠলেও ভগ্নীপতির অত্যাচার ক্রমাগত বাড়তেই থাকে সেখানে। এক পর্যায়ে এই যন্ত্রণা থেকে বের হওয়ার লক্ষ্যেই মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিয়ের পিড়িতে বসেন সারাহ ব্রিডলাভ।
শৈশব থেকে দুঃখ-কষ্টের মধ্যে বড় হওয়া মেয়েটির ভাগ্যে বিয়ে খুব বেশি পরিবর্তন আনতে পারেনি। সারাহ ব্রিডলাভের বয়স যখন ২০, তখনই মৃত্যু হয় তার প্রথম স্বামী, মোজেস ম্যাকউইলিয়ামসের। দুই বছরের ছোট্ট মেয়ে লেলিয়াকে নিয়ে সারাহর সংগ্রাম শুরু তখন থেকেই।
এরপর ১৮৯৪ সালে আরো একবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, কিন্তু সে সংসারের ইতি টানেন বছর দশেক পরেই। সবশেষে বিয়ে করেন এক পত্রিকার বিজ্ঞাপন সংস্থার সেলসম্যান চার্লস জোসেফ ওয়াকারকে। আর এভাবেই সারাহ ব্রিডলাভ হয়ে ওঠেন মিসেস চার্লস জোসেফ ওয়াকার বা ম্যাডাম সি জে ওয়াকার।
সারাহ তার ব্যক্তিগত জীবনের সংগ্রামের শুরু করেছিলেন জন্মাবধিই। ১৮৮৮ সালে তিনি প্রথম কাজ শুরু করেন লন্ড্রিতে, যেখানে দিনে এক ডলারের সামান্য কিছু বেশি পেতেন তিনি। এসময় থেকেই নিজের খাবারে পুষ্টির অভাব, চুলের সঠিক যত্ন না নেয়ার কারণে চুলপড়া ও খুশকির সমস্যা খেয়াল করেন তিনি। এক পর্যায়ে তিনি অ্যানি ম্যালোন নামের একটি কোম্পানির কমিশন এজেন্ট হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীতে অবশ্য তাঁর নিজের কোম্পানি হয়ে উঠেছিল অ্যানি ম্যালোনের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী।
দা ম্যাডাম সি জে ওয়াকার কোম্পানির কারখানা ছবি: উইকিপিডিয়া
যদিও ম্যালোন সারাহর বিরুদ্ধে ফর্মুলা চুরির অভিযোগ তুলেছিল, তবুও তা ধোপে টেকেনি। ম্যাডাম সি জে ওয়াকার হয়ে ওঠার পর নিজেকে স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে আসা একজন নারী হিসেবে প্রচার করেন। মূলত তার লক্ষ্য ছিল আফ্রিকান আমেরিকান নারীদের জন্য হেয়ারড্রেসার ও প্রসাধনী সামগ্রীর প্রচার ও প্রসার। এই লক্ষ্যেই তিনি ধীরে ধীরে আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে তার পণ্যের প্রচারণা শুরু করেন।
১৯১৩ সালে মেয়ের উৎসাহে ম্যাডাম ওয়াকার নিউ ইউর্কে গড়ে তোলেন তার অফিস এবং বিউটি স্যালন। পরবর্তীতে সেটি হয়ে ওঠে নিউইয়র্কে আফ্রিকান আমেরিকানদের জন্য এক সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের জায়গা। ইন্ডিয়ানোপলিসে নিজের কোম্পানির কারখানা নির্মাণের পর নতুন নতুন পণ্য তৈরি করতে শুরু করেন ম্যাডাম সি জে ওয়াকার। সাথে সাথে তিনি নিজের প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিতে থাকেন নারী কর্মীদের। ১৯১৭ সালের মধ্যে তাঁর কোম্পানিতে অন্তত ২০ হাজার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারী কর্মচারী ছিলেন বলে দাবী করে প্রতিষ্ঠানটি।
ম্যাডাম সি জে ওয়াকার ওয়ান্ডারফুল হেয়ার গ্রোয়ারছবি: আর্কপাবলিশিং
একদিকে ম্যাডাম ওয়াকার নজর দেন ব্যবসায়িক প্রচার প্রসার বাড়ানোর দিকে, অন্যদিকে নারীদের সাংগঠনিকভাবে এগিয়ে আনতেও তিনি কাজ করেন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ন্যাশনাল বিউটি কালচারিস্টস অ্যান্ড বেনেভলেন্ট অ্যাসোসিয়েশন অব ম্যাডাম সি জে ওয়াকার। এর বাইরেও তিনি অনুদান সংগ্রহে কাজ করেছেন, বিভিন্ন প্রয়োজনে মানুষকে দান করেছেন তাঁর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে।
একজন সাধারণ নারী থেকে স্বাধীন শিল্পপতি হয়ে ওঠার পথচলা সহজ ছিল না ম্যাডাম সি জে ওয়াকারের। সারাজীবনে মাত্র ৩ মাসের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের সুযোগ হয় ম্যডাম ওয়াকারের, তাও ছোটবেলায় চার্চের কল্যাণে। তাইবর্ণবৈষম্যের কারণে পিছিয়ে পড়া নারীদের শিক্ষার সুযোগ করে দেয়ার জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন সবসময়ই। এর বাইরেও আফ্রিকান আমেরিকান গোষ্ঠীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে তিনি গড়ে তুলেছিলেন ভিলা লেয়ারো।
ভিলা লেয়ারো ছবি: গুগল আর্টস অ্যান্ড কালচার
জীবনের শেষদিকে এসে রাজনীতির সাথেও সংশ্লিষ্টতা হয় ম্যাডাম সি জে ওয়াকারের। অনেক সভায় তিনি কথা বলেছেন রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজের অরাজকতা নিয়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সার্কেল ফর নিগ্রো ওয়ার রিলিফে নেতৃত্বদানের পাশাপাশি নিউ ইয়র্কে নীরব প্রতিবাদ মিছিলেও অংশ নেন তিনি। সারাজীবনই ওয়াই ডব্লিউ সি এর বিভিন্ন কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন তিনি।
কিডনি বৈকল্যের কারণে মাত্র ৫১ বছর বয়সে ১৯১৯ সালের ২৫ মে মৃত্যু হয় উদ্যোক্তা, অধিকারকর্মী ও মানবতাবাদী ম্যাডাম সি জে ওয়াকারের। মৃত্যুর পর তাঁর নাম আরো বেশি করে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।‘ম্যাডাম সি জে ওয়াকারস ওয়ান্ডারফুল হেয়ারগ্রোয়ারের’ব্যবসা ও সুনাম ছড়িয়ে পড়ে হাওয়াই, কোস্টা রিকা সহ বিভিন্ন দিকে।
ম্যাডাম সি জে ওয়াকার ও তার বার্বি সংস্করণ ছবি: দা টয় ইনসাইডার
ম্যাডাম সি জে ওয়াকারের এই বর্ণাঢ্য জীবন অনেকের কাছেই অনুপ্রেরণা ও আত্মবিশ্বাসের কেন্দ্রস্থল। আর সেটি মাথায় রেখেই সম্প্রতি বার্বি পুতুলের ইন্সপায়ারিং উইমেন সিরিজে যুক্ত করে সম্মানিত করা হলো তাকে। শুধু ঝলমলে সৌন্দর্য নয়, বরং অধ্যবসায় থাকলে কাজই মানুষকে বড় করে তোলে - সারাহ ব্রিডলাভ পরিচয় ছাপিয়ে ম্যাডাম সি জে ওয়াকার হয়ে ওঠার সংগ্রামী বার্বি পুতুল সবার কাছে এই বার্তাই প্রচার করবে।
সিরাজুল আরিফিন বর্তমানে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত।