বাংলা ভাষা কতটা আত্মত্যাগের ফসল স্বাধীনতার বহু বছর পেরিয়ে গেলেও ক'জন তা ভাবেন, চিন্তার নয়, লজ্জার ব্যাপার। লজ্জার প্রায়শ্চিত্ত সারতে মোহাম্মদ আমীন শুদ্ধ বানান প্রচারের লক্ষ্যে মাঠে নামেন। ২০১৪ সালে ফেসবুকে খোলেন গ্রুপ। নাম দেন - শুদ্ধ বানান চর্চা বা সংক্ষেপে 'শুবাচ'। বর্তমানে যার সদস্য প্রায় আট লাখ ছাড়িয়ে।
শুদ্ধীকরণের প্রেরণা ও প্রারম্ভিক ধাক্কা
চাকুরিতে প্রবেশের পর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বাংলায় অহরহ ভুল এবং সংশোধনের প্রয়াসকে পদমর্যাদার দোহাই দিয়ে এড়িয়ে যাওয়ার রীতি মোহাম্মদ আমীনকে যন্ত্রণা দিত। শুদ্ধিকরণের কথা বলায়, অপমান কিংবা বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে অবমূল্যায়নের মতো ঘটনাও তার জীবনে ছিল।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মাতৃভাষার প্রতি এমন অবজ্ঞা থেকেই শুদ্ধীকরণের প্রেরণা পাই।’ প্রেরণা আরো জোরালো করতে খ্যাতিমান কূটনীতিক মোস্তফা ফারুকের অবদান নতশিরে স্বীকার করেন তিনি। প্রারম্ভিক ধাক্কা প্রসঙ্গে তার জোরালো কোনো অভিযোগ নেই। তিনি মনে করেন, যেকোনো ভালো উদ্যোগে বাধাবিপত্তি খুব সাধারণ বিষয়। শুরুর দিকে 'শুবাচ' গ্রুপে সদস্য কম হওয়ায় খুব ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয়নি। তবে সদস্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাষা এবং ধর্মকে এক করে কেউ কেউ সাম্প্রদায়িক বিতর্ক তৈরির চেষ্টা করে। যা আরও পাঁচজন ভাষাপ্রেমিকের প্রেমের শক্তিতে গুঁড়িয়ে গেছে।
প্রতিনিয়ত সংশোধন, প্রজন্মের অনীহা এবং ভুলের ছড়াছড়ি
'সংশোধন' শব্দটিকে জীবিত জীবের অনিবার্য শর্ত হিসেবে ভাবেন তিনি। বাংলা ভাষা জীবিত ও বর্ধিষ্ণু ভাষা। সুতরাং সংশোধন বা পরিবর্তন প্রয়োজন ও স্বাভাবিক ঘটনা।
এ প্রসঙ্গে চমৎকার উদাহরণ টেনে বলেন "গরুর গাড়ি ছেড়ে বিমানে, চিঠি ছেড়ে ই-মেইলে, চিৎকার ছেড়ে মোবাইলে যাওয়ার মতো পরিবর্তন যদি মেনে নেওয়া যায়, তবে বাংলা ভুল শব্দের সংশোধন মেনে নিতে এত সমস্যা কোথায়।" সঠিক পরিবর্তনে যারা বিভ্রান্ত হয় কিংবা অনীহা প্রকাশ করে তাদের অলস বলেও আখ্যা দেন মোহাম্মদ আমিন। তবে তিনি এ-ও স্বীকার করেন, পরিবর্তন বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালি মনোভাগই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দায়ী৷
প্রচারোদ্যোগের অভাবে, অনেকেই এখন সঠিক শব্দ দেখে আঁতকে উঠেন। অনেকেই জানে না, সংশোধনের পর যে শব্দগুলো (অধিকাংশ শব্দ) বিভিন্ন জায়গায় ভেসে বেড়ায় তা মূলত নতুন শব্দ নয় বরং প্রাচীন শুদ্ধ বানান। এমন গুরুতর সমস্যার কারণ হিসেবে বাংলা একাডেমির স্রেফ পুস্তক বিক্রেতা বা অভিধান বিক্রেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া নিয়ে ক্ষোভ ছিল তার কন্ঠে।
তিনি মনে করেন, জটিল বা সংশয়মূলক বানানগুলোকে একটি পুস্তিকায় আবদ্ধ করে বিনামূল্যে সর্বস্তরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিতরণ না করতে পারা লজ্জাজনক। এছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে খুব সাধারণ বানানে ভুলের মাখামাখি মূলত মাতৃভাষার প্রতি ব্যক্তিগত, রাষ্ট্রিক ও জাতিক অবহেলা হিসেবেই দেখেন তিনি। দেশে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যাপার থাকলেও শুদ্ধ বানানে মাতৃভাষা উচ্চারণ বা লেখা শিখার মত কোনো প্রশিক্ষণকেন্দ্র না থাকা— সরকার তথা বাংলা একাডেমির খামখেয়ালি দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া আর কিছু নয় বলে মন্তব্য করেন মোহাম্মদ আমিন।
বাংলা ভাষার গৌরব, পারদর্শীতার অবমূল্যায়ন ও ভাষার যথার্থ প্রয়োগ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা
বাংলা নিয়ে গৌরবের অন্ত নেই। প্রতিবছর নির্দিষ্ট তারিখে বাংলা মায়ের রূপের শুধায় মুগ্ধ হওয়া বক্তৃতারও শেষ নেই। কিন্তু, বাংলা ভাষায় পারদর্শী কাউকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কতটা কী আয়োজন আছে দেশে, এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “পারদর্শীতার মূল্যায়ন শুধু ভাষার ক্ষেত্রে কেন, সবখানে একই অবস্থা। আসলে মূল্যায়ন বা পুরস্কার কেবল প্রতিভা বা কাজের ওপর নির্ভর করে না। রাজনীতি, মতবাদ, যোগাযোগ প্রভৃতিসহ আরও অনেক বিষয়ের উপর নির্ভর করে।’ এছাড়াও সাহিত্য পুরস্কারকে তিনি সাহিত্য কুলঙ্গারিত্বের নজির হিসেবে দেখেন, এবং যে বা যারা পুরস্কার লাভের জন্য তদবির বা হা-হুতাশ করেন, তাদের ফুটপাতের ভিক্ষুক বলে মনে করেন মোহাম্মদ আমীন।
বানান শুদ্ধীকরণ চর্চার বাইরে বাংলা ভাষার যথার্থ প্রয়োগ প্রসঙ্গে আরও নানা ভাবনার কথা জানান তিনি। দেশে বিদেশে শুবাচের কমিটি প্রতিষ্ঠা। বাংলাভাষী ও অন্যভাষীদের শুদ্ধ বাংলায় বুদ্ধিবৃত্তিক সহায়তা প্রদান এবং বাংলা বানানকে আরও জনপ্রিয় করে তুলতে 'শুবাচ রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিকেশন্স' প্রতিষ্ঠা করা, ইতোমধ্যে যেখানে প্রকাশ পেয়েছে পাঁচটি বই।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুদ্ধ বাংলা ব্যবহারে অনীহা
ভালো কাজে নেতিবাচক সমালোচনাকে বরং পরীক্ষামূলকভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রমাণ হিসেবে দেখেন তিনি । এ প্রসঙ্গে মোহাম্মদ আমীন আরও বলেন, “সুন্দর কাজে যখন নেতিবাচক মতামত আসতে থাকে তখন প্রত্যেকেরই ভাবা উচিত, ঈর্ষাপরায়ণ প্রতিপক্ষের বুক আপনার পদভারে ভেঙে খানখান হয়ে যাচ্ছে;আপনি তাদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছেন।” গঠনমূলক সমালোচনার বাইরে অন্যান্য সমালোচনাকে পাত্তা না দিয়ে পাথেয় গণ্যে এগিয়ে যাওয়া এবং ঈর্ষাপতিত বুকের ওপর সাফল্যের ভবন গড়ে তোলাই তো ভালো কাজে একমাত্র লক্ষ্য হওয়া দরকার।
শুদ্ধভাষা শুদ্ধ মনের পরিচায়ক। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মাতৃভাষার সঠিক প্রয়োগে অবহেলা প্রজন্মের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। ফলে লেখার পাশাপাশি অনেকের উচ্চারণগত ত্রুটি থাকে। যা ভাষার ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার পাশাপাশি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ভুল বার্তাও সরবরাহ করে। এ প্রসঙ্গে মোহাম্মদ আমীন বলেন: ‘ ভাষাপ্রেম ছাড়া দেশপ্রেম কখনোই জাগ্রত হয় না। ভাষা ধ্বংস হলে জাতিটাও ধ্বংস হয় বা অন্য জাতিতে একীভূত হয়ে যায়।’
১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১২ই মার্চ সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশে জারীকৃত এক পত্রে বঙ্গবন্ধু লিখেছিলেন, মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই, দেশের প্রতি যে তার ভালোবাসা আছে এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। সত্যিই তো তাই। যে ভাষার জন্য এতকিছু, তার মর্যাদা রক্ষায় যাদের মন খরচে অবহেলা, তারা আর যাই হোক, দেশকে কেবল স্বার্থপরের মতো ব্যবহার করছেন। নিঃসন্দেহে বলা চলে।
শুদ্ধিকরণ নিয়ে লক্ষ্য
মা যেমন নিঃস্বার্থ মহিমায় স্নেহ প্রদান করেন, ভাষাও তাই করে। যে বা যারা ভাষাকে শুধু বাণিজ্যিকভাবে ভাবেন, তাদেরকে তার মায়ের দিকে তাকাতে অনুরোধ করেছেন মোহাম্মদ আমীন। শুদ্ধিকরণ বা শুদ্ধ বাংলা সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে উদ্বুদ্ধকরণের ক্ষেত্র সৃষ্টি করা, এবং যারা স্বার্থপরের মতো বাংলাকে শুধু ব্যবহার করে কিন্তু তার মর্যাদা রক্ষায় কাজ করে না তাদের বুকে প্রায়শ্চিত্তের তাগিদ আনাকে লক্ষ্য ধরে আগানোর কথা জানান তিনি।
সঞ্জয় দত্ত ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে পড়াশোনা করছেন।