Loading...
The Financial Express

মাতৃভান্ডারের রসমালাই: নকলের ভীড়ে টিকে থাকার ৯৩ বছর


মাতৃভান্ডারের রসমালাই: নকলের ভীড়ে টিকে থাকার ৯৩ বছর

বাঙালির সাথে মিষ্টির যুগলবন্দী আদি ও অনন্ত। উৎসবমুখর বাঙালি জাতির জন্য যেকোনো আয়োজনে মিষ্টিমুখ করা চাই। পূজা হোক বা ঈদ, আয়োজনের খাবারের শুরু বা শেষে মিষ্টি না থাকলে যেন উৎসবের পরিপূর্ণতা পায় না। বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় ধরে হরেক রকম মিষ্টি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। রসমালাই এর মধ্যে অন্যতম। আর এই রসমালাই তৈরির অন্যতম আদি প্রতিষ্ঠান কুমিল্লার মাতৃভান্ডার। মাতৃভান্ডারের রসমালাই সারা দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী বাঙালিদের কাছে অন্যতম চাহিদাসম্পন্ন ও পছন্দের মিষ্টি।

মাতৃভান্ডারের রসমালাইয়ের আরেকটি আকর্ষণীয় দিক রয়েছে। আসলে এটি আকর্ষণীয় কি-না, তা পরিষ্কার করে বলা যায় না। কিন্তু অনন্যতা তো অবশ্যই রয়েছে। মাতৃভান্ডারের রসমালাই কুমিল্লার একটি ব্র্যান্ডের মতো। সারা দেশে কুমিল্লা জেলাকে এক নামে সবাই চিনতে পারে- এর পেছনে মাতৃভান্ডারের রসমালাইয়ের অবদান আছে বৈকি। আর এই কুমিল্লা জেলাতেই অন্তত ১০০-র কাছাকাছি নকল মাতৃভান্ডারের দোকান খুঁজে পাওয়া যাবে। বিশেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েতে আলেখারচর এলাকার আশেপাশে রয়েছে অন্তত ৫০টির বেশি দোকান। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হয় না তেমন ভাবে। কারণ কেউই তাদের দোকানের নাম শুধু মাতৃভান্ডার রাখে না। মাতৃভান্ডারের আগে বা পরে সবাই নিউ, দ্য, আদি, আসল, কুমিল্লার, সুইটস, খাঁটি বা ময়নামতি।

এত এত নকলের ভীড়েও যে আসল মাতৃভান্ডার রয়েছে, তার অবস্থান কুমিল্লা সদরের মনোহরপুর এলাকার রাজ রাজেশ্বরী কালীবাড়ির সামনে। কিভাবে মাতৃভান্ডারের রসমালাই বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাপী বাঙালিদের কাছে এত জনপ্রিয় হয়ে উঠলো, এর ইতিহাস জানতে হলে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে।

১৯৩০ সালে ফণীন্দ্র সেনগুপ্ত মনোহরপুরে প্রতিষ্ঠা করেন মাতৃভান্ডার। প্রথমে তারা রসে ডুবিয়ে ছোট ছোট মিষ্টি বিক্রি করতেন। যা পরিচিত ছিল ক্ষীরভোগ নামে। পূর্ব পাকিস্তান হওয়ার পর অবাঙালিরা একে ডাকতে শুরু করে রসমালাই হিসেবে। ১৯৫০ এর পর থেকেই এর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে ধীরে ধীরে।

মুক্তিযুদ্ধের পর বংশপরম্পরায় দোকানের হাল ধরেন মুক্তিযোদ্ধা শংকর সেনগুপ্ত। রসমালাইয়ের বিখ্যাত স্বাদের পিছে আছে এদের দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহৃত একই রেসিপি। এক মণ দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন ক্ষীর তৈরি করা হয় প্রথমে। তারপর সেই ক্ষীর দিয়ে তৈরি হয় ১৪ কেজি রসমালাই এর ছোট ছোট মিষ্টি। দুধের পরিমাণে বেশকম হলে রসমালাই এর আসল স্বাদ আর থাকে না।

কিন্তু রসমালাই তৈরির এই রেসিপি মোটেও কোনো গোপন রহস্য নয়। এটা সবাই জানে। তবুও এত এত নকল দোকান মাতৃভান্ডারের রসমালাই বলে যা বিক্রি করে, তার স্বাদ আসলটার ধারে কাছেও আসে না। ঘন ক্ষীর থেকে ছোট ছোট মিষ্টি মুখে দিলেই যেন গলে যায় এমন তুলতুলে নরম হয় আসল মাতৃভান্ডারের রসমালাই।

নকল মাতৃভান্ডারের রসমালাই মুখে দিলেই একটা কড়া মিষ্টি স্বাদ অনুভব করা যায় রসনায়। বুঝাই যায় যে হয় অনেক চিনি নয় স্যাকারিন দিয়ে মিষ্টি করা হয়েছে। অন্যদিকে আসল মাতৃভান্ডারের মিষ্টির ক্ষীর অসাধারণ স্বাদের। হালকা মিষ্টি, মুখে নিলে কড়া লাগে না একদমই।

মাতৃভান্ডারের বর্তমান স্বত্বাধিকারী শংকর সেনগুপ্তের ছেলে অনির্বাণ সেনগুপ্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষার্থীকে নকল মাতৃভান্ডারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান যে তারা নিজেরাই মিষ্টি বিক্রি করে কূল পান না প্রতিদিন, আর বাইরের কেউ যদি তাদের নাম ব্যবহার করে ঘর চালায়, তবে তাদের আপত্তি নেই। তিনি আরো বলেন যদি কেউ বড় ধরনের প্রতারণা করে থাকে, তবে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।

মাতৃভান্ডার প্রতিদিন সাত সকাল থেকে মিষ্টি বিক্রি শুরু করে থাকে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রথম ব্যাচের মিষ্টি শেষ হয়ে যায়। প্রতিদিনই দোকানের সামনে লেগে থাকে ক্রেতাদের দীর্ঘ লাইন। আর যদি এটি হয় ঈদ বা পূজার সময়, তবে ক্রেতাদের চাপ থাকে অস্বাভাবিক বেশি। এমনও হয়েছে যে ৪-৫ ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও মিষ্টি পায়নি অনেকে। এছাড়াও যেকোনো পাবলিক পরীক্ষার রেজাল্টের পর থাকে মিষ্টির জন্য দীর্ঘ লাইন।

বিদেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রদূত, সরকারী অতিথি বা গুরুত্বপূর্ণ উচ্চপদস্থ কেউ কুমিল্লা এলে তারা মাতৃভান্ডারের রসমালাই চেখে দেখেন একবার। ২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা সফরে এসেছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার। তিনি টুইট করেছিলেন যে, ‘কুমিল্লা ভ্রমণ সম্পূর্ণ হয় না, যদি না সেখানে গিয়ে রসমালাই খাওয়া হয়। কুমিল্লার প্রাচীনতম ও সর্বাধিক জনপ্রিয় রসমালাইয়ের দোকান মাতৃভান্ডারের মিষ্টির স্বাদ গ্রহণ করে আমি নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করছি।’

মাতৃভান্ডারের রসমালাই কারো কাছে চার কেজির বেশি বিক্রি করা হয় না। কারণ বেশি পরিমাণে নিলে বাইরের নকল দোকানগুলোতে সরবরাহ করার আশঙ্কা থাকে। এছাড়াও কর্তৃপক্ষ চায় যেন সবাই-ই রসমালাইয়ের স্বাদ উপভোগ করতে পারে। কারো কাছে বেশি বিক্রি করে অন্যদের কপালে না জুটুক, এমনটি চায় না মাতৃভান্ডার। বর্তমানে প্রতি কেজি রসমালাই বিক্রি করা হয় ৩০০ টাকা করে।

 

ফাইয়াজ আহনাফ সামিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।

[email protected]

Share if you like

Filter By Topic