Loading...

বাংলাদেশের উপর বাড়ছে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ, সংকট কতটা গভীর?

| Updated: February 24, 2023 19:49:40


বাংলাদেশের উপর বাড়ছে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ, সংকট কতটা গভীর?

বাংলাদেশের অর্থনীতি বছরের পর বছর প্রবৃদ্ধি দেখে আসছে, দাঁড়িয়ে আছে বেশ শক্ত ভিতের উপরেই। তাই হঠাৎ করেই বড় রকমের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা তেমন নেই। 

তবে বৈশ্বিক অর্থনীতির হালচাল, দেশি ব্যাংকে তারল্য সংকট, ডলার সংকট, মূদ্রাস্ফীতি- সবকিছু মিলিয়ে যখন কপালে খানিক ভাঁজ, তখন বছর ঘুরতেই বাড়ছে বিদেশি দেনা। সেই অংক কতটা বড় এবং কেন অস্বস্তির কারণ হতে পারে, সেদিকে আলোকপাত করা যায়।

২০১১ অর্থবছর থেকে ২০২১ অর্থবছর পর্যন্ত ১০ বছর সময়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ২৭.০৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ৯১.৪৩ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকেছে, বেড়েছে ২৩৮ শতাংশ। গত দশ বছরে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক বিনিয়োগ, রপ্তানি আর রেমিট্যান্স বৃদ্ধি, সবকিছুর পরও বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ এভাবে বেড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক, বিশেষ করে আঞ্চলিক অন্যান্য সদস্যের সাথে যদি তুলনা করা হয়। এই একই সময়ে ভারত ও পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে যথাক্রমে ৮৩ ও ১০১ শতাংশ। এমনকি, অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে মুখ থুবড়ে পড়া শ্রীলংকারও এই বৃদ্ধি আমাদের তুলনায় অনেক কম, মাত্র ১১৯ শতাংশ। 

এই বৃদ্ধিও অতটা মাথাব্যথার কারণ হতো না; যদি না সেখানে ব্যাপক পরিমাণে স্বল্পমেয়াদী বাণিজ্যিক লোন থাকত। দেশের অর্থনীতি নিয়ে ওয়াকিবহাল ব্যক্তি মাত্রই খবর রাখেন যে বাংলাদেশের ঋণ প্রদানের সবচেয়ে বড় উৎসগুলো কারা- জাইকা, বিশ্বব্যাংক, এডিবি (এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক), আইএমএফ। কিন্তু গত এক দশকে এ দৃশ্যপটে পরিবর্তন এসেছে। জাতীয় অর্থনীতির সম্প্রসারণের চাহিদা মেটাতে দেশে হয়েছে বেশ কিছু মেগাপ্রজেক্ট, যেসবের অর্থায়নের জন্য বড় অংকের লোন প্রয়োজন হয়েছে।  এসব লোন বাংলাদেশ পেয়েছে তিনটি দেশের কাছে - ভারত, চীন এবং রাশিয়া; সবগুলো স্বল্পমেয়াদী, বাণিজ্যিক এবং জটিল শর্তসাপেক্ষ।

বিশ্বব্যাংক বা এডিবির ঋণ পরিশোধে গড়পড়তা সময় পাওয়া যায় ৩০-৩৫ বছর। কিন্তু ভারত বা চীন থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতে হয় কেবল ১৫-২০ বছরের মাঝে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এ সময় আরো কম। কিছু উদাহরণ দিয়ে আরো সহজে ব্যাপারটা বোঝানো যায়।

গত এক দশকে বাংলাদেশ ১২টি প্রকল্পের জন্য চীনের কাছে ঋণ সহায়তা পেয়েছে ১,৭৫৪ কোটি ডলার, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য রাশিয়া ঋণ দিয়েছে ১,১৩৮ কোটি ডলার, আর ৩টি লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) মাধ্যমে ভারত থেকে আসছে ৭৩৬ কোটি ডলার। তিন দেশের কাছ থেকে নেওয়া ৩,৬২৮ কোটি ডলারের ঋণ পরিশোধ শুরু হচ্ছে শীঘ্রই। 

এর মাঝে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের রাশিয়ার ঋণ শোধ করার সময় কেবল ১০ বছর যার গ্রেস পিরিয়ড শেষ হচ্ছে ২০২৬ সালে। কর্ণফুলী টানেলের জন্য চীনের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে এ বছর থেকেই, যা শেষ করতে হবে ২০৩১ সালের মাঝে।

স্বল্পমেয়াদী এসব ঋণও বেড়েছে হু-হু করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২০ সালেও বাংলাদেশের মোট স্বল্পমেয়াদী ঋণ ছিল ১০.৯৯ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ১৮.০৯ বিলিয়ন ডলারে। 

গত বছর জুন মাসে বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণ দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৯৫.২৩ বিলিয়ন ডলার হয়, যা সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ ৯২.৬৯ বিলিয়নে নেমে আসে। চলতি বছর থেকে শুরু করে প্রতিবছরই এখন বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বাড়তে থাকবে। কেননা, এ বছরই বেশ কিছু বড় ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হচ্ছে। 

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইকোনমিক রিলেশনস ডিভিশন) এর তথ্য  অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ ২.৪ বিলিয়ন ডলার বিদেশী ঋণ পরিশোধ করেছিল; চলতি অর্থবছর পরিশোধ করতে হবে ২.৭৮ বিলিয়ন ডলার। এর পরিমাণ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বেড়ে হবে ৪.০২ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২৯-৩০ অর্থবছরে বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ ৫.১৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এরপর এই সংখ্যা কমে আসবে। 

৪৬০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির জন্য পরিশোধযোগ্য এই ঋণের পরিমাণ খুব বড় না হলেও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক হালহকিকত। করোনা অতিমারীর মাঝেও বাংলাদেশ প্রত্যাশিত মাত্রার চেয়ে বেশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেখেছে এবং করোনা-পরবর্তী সময়ে যখন অর্থনীতি নতুন উদ্যমে ঘুরে দাঁড়াবে, তখনই এসে হাজির হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা আর অস্থিতিশীল জ্বালানি তেলের বাজার।

এসবের টানাপোড়েনে বাংলাদেশ পড়েছে নানামুখী সংকটে। ডলার সংকটের জন্য দেশের আমদানিতে ভাটা পড়েছে, দ্রুত পড়তে থাকা টাকার মান ধরে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে খরচ করেছে। এর ফলে রিজার্ভ নেমে এসেছে কয়েক বছরের মাঝে সর্বনিম্নে; বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার ৮০ শতাংশ যোগান দেয়া রেডিমেড গার্মেন্টসের বাজার ঝিমিয়ে পড়েছে, রপ্তানির সবচেয়ে বড় দুই গন্তব্য আমেরিকা এবং ইউরোপ উভয়েই মন্দার ভয়ে ‘ধীরে চলো’ নীতিতে চলছে, ফলে গার্মেন্টসের উৎপাদন কমছে, দেশে ডলার আসাও কমে যাচ্ছে। 

এসবের মাঝে কমেছে রেমিট্যান্সও। ২০২১ সালে প্রবাসীরা ২২.০৭ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন, যা গতবছর ২১.৫৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। একদিকে বাড়ছে ঋণ পরিশোধের চাপ, অন্যদিকে কমছে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয়। সংকট থেকে উত্তরণের উপায় কী তাহলে বাংলাদেশের?

প্রথমত, বৈশ্বিক মন্দা শুরু হলে তার প্রভাব সারা বিশ্বেই পড়বে, কেবল বাংলাদেশ একা ভুগবে না, তাই সেই অনুযায়ী প্রস্তুত থাকাই শ্রেয়। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) - এর ৬ষ্ঠ বাৎসরিক অর্থনৈতিক কনফারেন্সে খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদুদ্দিন মাহমুদ বলেন, “রিজার্ভ বাড়তে থাকায় আমরা আত্মতুষ্টিতে ভুগতে শুরু করেছিলাম, যে কারণে (বড় বড় ঋণের মাধ্যমে) রিজার্ভের একটা অংশ প্রজেক্ট অর্থায়নে ব্যয়ের সিদ্ধান্ত এসেছে। কিন্তু রিজার্ভ কেবল চরম পর্যায়ের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের জন্যই সংরক্ষণ করা উচিৎ, প্রজেক্ট অর্থায়নে নয়।” 

ঋণ বনাম জিডিপির অনুপাত এখনও বিপদসীমা অতিক্রম না করলেও তিনি মনে করেন এখন থেকেই সাবধান হতে হবে।

একই কনফারেন্সে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের চেয়ারম্যান, অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বলেন, “সকল মেগাপ্রজেক্ট অত্যন্ত সাবধানতার সাথে সময়, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং খরচ উঠে আসবে কিনা  - এসব বিবেচনায় রেখে হাতে নিতে হবে।” 

অন্যদিকে, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর একটি জাতীয় দৈনিককে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, কঠিন শর্তে নেয়া ঋণের বেশকিছু বড় প্রকল্প থেকে বিনিয়োগ উঠে আসবে না। অন্যদিকে অর্থনীতির অবস্থাও বর্তমানে নাজুক। তাই আগামী পাঁচ-সাত বছর বাংলাদেশের এধরনের বাণিজ্যিক ঋণ নেয়া থেকে বিরত থাকা উচিৎ। সব মিলিয়ে অর্থনীতিবিদদের পরমার্শ - এখন ধীরে চলো নীতিতেই চলতে হবে। 

একদিকে সরকারের কৃচ্ছতা সাধনের প্রচেষ্টায় ইতোমধ্যে আমদানি কমেছে উল্লেখযোগ্যহারে, বাণিজ্য ঘাটতিও নেমে এসেছে অনেকটা। এখন মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে স্থানীয় বাজার চাঙা রাখা জরুরি। পাশাপাশি দেশে ডলার আনয়ন বৃদ্ধিতে নজর দিতে হবে। 

গতবছর বাংলাদেশ রেকর্ড ১১.২৫ লাখ কর্মী বিদেশে পাঠিয়েছে। এবছর তাই রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ার আশা করতেই পারে সরকার। এর পাশাপাশি, রপ্তানি বাজার বহুমুখীকরণের এখনই উপযুক্ত সময়। সাথে বিদেশ থেকে আমদানি করা জ্বালানির উপর নির্ভরতা কমাতে দেশে গ্রিন এনার্জির উৎস বাড়াতে হবে। 

চাল, গমের মতো অধিক প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যে আমদানি খরচ বাঁচাতে দেশীয় উৎপাদন, সংরক্ষণ এবং বাজারজাতকরণ ঠিকঠাক করতে হবে। বিদ্যুতের পুনঃপুনঃ দাম বৃদ্ধিতে স্থানীয় অর্থনীতি অস্থিতিশীল হতে পারে। তাই বিদ্যুতে ভর্তুকি কমাতে অপচয় রোধ এবং কুইকরেন্টালের বিলোপ করতে হবে। সর্বোপরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়ানোর জন্য দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা, দেশের অর্থনৈতিক খাতে বিদেশীদের অন্তর্ভুক্তি সহজ করা, বিনিয়োগ ও ব্যবসাবান্ধব নীতি প্রণয়ন করাসহ বিভিন্ন বহুমুখী প্রকল্প হাতে নিতে হবে। তবেই বাড়তে থাকা ঋণের বোঝা সামলে নিয়ে এগিয়ে যাবে দেশের অর্থনীতি। 

[email protected]

Share if you like

Filter By Topic