ভাষা হিসেবে বাংলা হাজার বছরের পথ পেরিয়ে এসে হয়েছে সমৃদ্ধ। নদীর স্রোতের মতো দীর্ঘ পথচলায় বাংলার সঞ্চয়ও কম না। এমনই এক চমৎকার অলঙ্কারের নাম প্রবাদ প্রবচন। আজ কথায় কথায় সবাই বলে ফেলি ‘মান্ধাতার আমলের’ কথা, সেসব শুনে অনেকের হয়ে যায় ‘আক্কেল গুড়ুম’। কিন্তু কীভাবে এলো এসব প্রবাদ, কীভাবে তা হয়ে উঠলো বাংলার সম্পদ - সেসব গল্প হয়তো অনেকের কাছেই অজানা।
বাংলা প্রবাদের একটা বড় অংশই এসেছে পৌরাণিক উদ্ধৃতি থেকে। রামায়ণ, মহাভারতের সাথে পৌরাণিক কাহিনির মিশ্রণ এবং অনেক ক্ষেত্রে লোককথা, পুরনো সাহিত্য এমনকি মঙ্গলকাব্যের সাথেও এসব প্রবাদ প্রবচনের সূত্র মেলে।
মান্ধাতার আমল
মান্ধাতা নামের উৎস রামায়ণ। রামায়ণে বর্ণিত সূর্যবংশের এই রাজা ছিলেন দিগ্বিজয়ী। সমগ্র পৃথিবী জয় করার পর তিনি স্বর্গ জয় করার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন কিন্তু দেবরাজ ইন্দ্রের কৌশলে মধু নামক রাজার পুত্র লবণের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হন মান্ধাতা। কিন্তু এই কাহিনি হাজার হাজার বছর আগের। এতোই আগের যে অধিকাংশ মানুষই জানেন না এই যুদ্ধের কথা। আর একারণেই অতি প্রাচীনকাল বুঝাতে ব্যবহৃত হয় মান্ধাতার আমল।
পটল তোলা
প্রচলিত প্রবাদের মধ্যে পটল তোলার পরিচিত বেশ। সাধারণত মারা যাওয়া অর্থে পটল তোলা ব্যবহৃত হয়। এর পেছনের ব্যাখ্যা অবশ্য খুবই সহজ। ফলবান পটল গাছ থেকে পটল তুলে ফেললে গাছ আর বাঁচেনা। একারণেই পটল তোলার সাথে মৃত্যুর সম্পর্ক উঠে এসেছে বাংলা প্রবাদে।
ত্রিশঙ্কু দশা
রাজা মান্ধাতা স্বর্গ জয় করতে পারেননি। কিন্তু আরেক পৌরাণিক রাজা ত্রিশঙ্কু স্বর্গ জয় করতে গিয়ে আকাশ আর পৃথিবীর মাঝে আটকে গিয়েছিলেন। পৃথিবী থেকে ঋষি বিশ্বামিত্র চেয়েছিলেন ত্রিশঙ্কুকে স্বর্গে পাঠাতে, ওদিকে ইন্দ্রের নেতৃত্বে স্বর্গের দেবতারা ত্রিশঙ্কুকে ঠেলে দিতে চাইলেন মর্ত্যলোকে। দেবতারা বিশ্বামিত্রের কাছে সমাধান চাইলে তিনি স্বর্গ ও পৃথিবীর মাঝখানে নতুন এক আকাশ সৃষ্টি করলেন ত্রিশঙ্কুর জন্য। এভাবেই কোন দিকে যে যাবে, তা স্থির করতে না পারার সাথে ত্রিশঙ্কুকে স্মরণ করা হয়।
আটঘাট বেঁধে নামা
পুরাণ থেকে বেরিয়ে এলে চারপাশে তাকালেই আটঘাট বাঁধার অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়। মূলত কোনো কাজে নামার আগে সবরকম প্রস্তুতি নিয়ে নামলেই বলা হয় আটঘাট বেঁধে নামা। এটি এসেছে তবলার মতো বাদ্যযন্ত্র থেকে। তবলার প্রতিটি ঘুটির উপর চামড়ার যে দুটি চ্যাপ্টা দড়ি থাকে তার মাঝের অংশকে ঘাট বলা হয় আর এমন ঘাট তবলায় থাকে আটটি। তবলা বাজানোর আগে এই আট ঘাট ভালোমতো বেঁধে নেয়া থেকেই এসেছে এই প্রচলিত প্রবাদ।
নখদর্পণে থাকা
সরাসরি কোনো উদ্ধৃতি না থাকলেও নখদর্পণ ভারতীয় পুরাণেরই গল্প। সিদ্ধপুরুষ বা সাধুরা সাধনার সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে গেলে হয়ে উঠতেন ত্রিকলাজ্ঞ। তাঁরা কিছু জানতে চাইলে তাঁদের কষ্ট করা লাগতো না। নিজেদের বুড়ো আঙ্গুলের নখে তাকালেই তাঁরা সবকিছু দেখতে পেতেন। নখের এই দর্পণ বা আয়নার মতো সবকিছু তুলে এনে দেখানোর ক্ষমতা থেকেই কোনো বিষয়ে সবকিছু আয়ত্তে থাকাকে বলা হয় নখদর্পণে থাকা।
অকালকুষ্মাণ্ড
অকালকুষ্মাণ্ড শুনলেই সবাই একবাক্যে এটার অর্থ বলে ফেলতে পারবেন। অপদার্থ বা অকাজের বুঝাতে এর ব্যবহার দীর্ঘদিনের। তবে এর বুৎপত্তি খুঁজে বের করা অতোটাও কঠিন নয়। অকাল মানে অসময় আর কুষ্মাণ্ড অর্থ কুমড়া। অনেক সময় দেখা যায় যে, মৌসুম শেষ হওয়ার পর বা অন্য মৌসুমে গিয়ে কুমড়া ফলছে। এইসব কুমড়া যতই ফলন দিক, এগুলোর স্বাদ উপভোগ্য হয় না। এভাবেই তৈরি হয়েছে অকালকুষ্মাণ্ড।
ধুন্ধুমার কান্ড
আবার পুরাণে ফিরে যাওয়া যাক। ধুন্ধু নামের এক অসুর তপস্যার পর পেয়েছিলেন এক অমর বর যে বরের জোরে দেবতা বা ঋষি কেউ তাঁকে হত্যা করতে পারবে না। কিন্তু এই বর পাওয়ার পর থেকেই ধুন্ধু সবার ওপর অত্যাচার করা শুরু করে। এক পর্যায়ে তাঁকে হত্যা করার জন্য অযোধ্যার রাজা কুবলাশ্ব একুশ হাজার পুত্র ও অসংখ্য সৈন্যের বিশাল এক বাহিনি নিয়ে আক্রমণ করতে আসেন। কিন্তু ধুন্ধুর তেজে শুরুতেই প্রাণ হারায় আঠারো হাজার পুত্র এবং সব সৈন্য। তখন ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপে ধুন্ধুকে হত্যা করেন কুবলাশ্ব। কুবলাশ্বের নতুন নাম হয় ধুন্ধুমার এবং এক অসুরকে হত্যায় এরকম অনেক বড় ঘটনাই ধুন্ধুমার কাণ্ড হিসেবে পরিচিতি পায়।
গদাই লশকরী চাল
প্রাচীন ভারতের এক মুগুড়সদৃশ অস্ত্রের নাম গদা। যুদ্ধক্ষেত্রে বিশাল বিশাল গদা বয়ে নিয়ে যেতো যেসব সৈন্য, স্বভাবতই ভারী অস্ত্র বহনের কারণে তাদের পথচলা অন্যদের চেয়ে একটু ধীরে থাকতো। কিন্তু এই ধীর পথচলাই পরবর্তীতে আলসেমির সমার্থক হয়ে যায়। গদা বহনকারী লোক-লশকর থেকে চলে আসে গদাই লশকরী চাল।
অক্কা পাওয়া
বাগধারা বা প্রবাদ প্রবচনের সব গল্পই যে প্রাচীন ভারতের, এমনটাও না। ফারসি ভাষায় ‘আকা’ অর্থ ঈশ্বর। সেটি বাংলায় মুসলিম শাসনামলে বাংলায় যখন প্রচলিত হয়, তখন বিকৃতির কবলে পড়ে হয়ে যায় ‘অক্কা’। মৃত্যুর পর মানুষ ঈশ্বরের সাক্ষাৎ পাবে এমনই ধর্মীয় বিশ্বাসের জায়গা থেকে অক্কাকে পাওয়া বা ঈশ্বরের সাথে সাক্ষাৎকে মৃত্যুর সমার্থক ধরে নেয়া হয়। একারণেই অক্কা পাওয়া অর্থ মারা যাওয়া।
সাত খুন মাফ
হাজার বছরের পুরাণ বা লোককথা ছাড়িয়ে অনেকটাই আধুনিক সময়ের প্রবাদ সাত খুন মাফ। সাত খুন মাফের মূল ইতিহাস কী তা নিয়ে সামান্য দ্বিমত আছে। দুটোই ইংরেজ শাসনামলের। প্রথম গল্পটি এমন যে, ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতবর্ষের খাজনা আদায়ে জমিদাররা লাঠিয়াল ব্যবহার করতেন এবং সেখানে জোর জবরদস্তি খুনোখুনিতেও পৌঁছে যেতো।
অনেকের মতে, এরকম ঘটনায় সাত জনকে খুন করলে তার জন্যে কোনো বিচারের সম্মুখীন হওয়া লাগতো না বলেই এসেছে সাত খুন মাফ। তবে অন্য মতে, নীলচাষের বিদ্রোয় দমন করতে যতো খুশি মানুষকে মেরে ফেলার সুযোগ ছিল ব্রিটিশদের হাতে। যেহেতু যতোখুশি খুন করা যায়ই, সেজন্য সাতটা খুন করলেও মাফ পাওয়া যেতোই।
সিরাজুল আরিফিন বর্তমানে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত।